খবর যখন যেমন তখন তেমন, আর যখনকার খবর তখনই। এটাই অনলাইনের খবর পরিবেশনার স্টাইল।
সংবাদকর্মী খবর সংগ্রহ করে, আর বার্তাকক্ষ তা পরিবেশন করে নানা ঢঙে। এই ঢঙটা একেক সংবাদমাধ্যমের একেক রকম। যারা দৈনিকের সংবাদকর্মী তারা খবরটাকে সময় নিয়ে সংগ্রহ করে, আদ্যোপান্ত বিচার করে পরের দিন সকালের পাঠকের (এখনও যারা বাসি খবর পড়তে অভ্যস্ত) জন্য প্রস্তুত করে। টেলিভিশনের খবরের দুটি দিক আছে- এক. লাইভ সম্প্রচার। ঘটনা যেমনটা ঘটে চলে তার ওপর ক্যামেরা ধরা থাকে, দর্শক নিজ দায়িত্বে বুঝে নেয়, যখন যেভাবে ক্যামেরা প্যান করা হয় তার ভিত্তিতে। আর যারা খবর সংগ্রহ করে তা পরে প্রচার করার ব্যবস্থা নেন তাদের জন্য সকালের খবর দুপুরের বুলেটিনে, দুপুরের খবর বিকেলের বুলেটিনে দিতে হয়, আর বিকেলেরটা সন্ধ্যায়। হ্যাঁ স্ক্রল করে খবরের চুম্বক কথাটি দেওয়া সম্ভব সারাক্ষণই। বেতারের ব্যবস্থাটিও বুলেটিন নির্ভর। যারা চব্বিশ ঘণ্টার খবরের চ্যানেল তাদের জন্যও বুলেটিনের একটি শিডিউল থাকে। হয়তো প্রতি ঘণ্টার শুরুতে, কিংবা অন্য কিছু। কিন্তু অনলাইনে? উত্তরটা প্রথমেই বলে রেখেছি- ‘যখনকার খবর তখনই’। আর যখন সময়ের খবর সময়েই প্রকাশ করতে হয়, তখন একটি বিষয় অনিবার্যভাবে আসে খবরটি যখন যেমন, তখন তেমনই প্রকাশ করা।
যখন যেমন’র একটু ব্যাখ্যা প্রয়োজন। উদাহরণ দিয়েই বলা যায়।
পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের ঘটনাই যেহেতু এই লেখার উপজীব্য তাই সবগুলো উদাহরণ সেখান থেকেই থাকুক।
রাত ১২টায় যখন তথ্য আসে রাতে বাবুল আক্তার আটক হতে পারেন তার স্ত্রী হত্যার ঘটনায়। তখন একটি মূলধারার সংবাদমাধ্যম সতর্ক হবে সে নিয়ে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়।
প্রথম কাজটিই ছিলো সন্দেহ করা। তবে এই সন্দেহ নিয়ে বসে থাকা যাবে না। কারণ একটি অনলাইনের জন্য ওই সময়ে এটিই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের কাজ। রাত সাড়ে ১২টার মধ্যে আপনি যখন দায়িত্বশীল সূত্রে নিশ্চিত হবেন, হ্যাঁ ঘটনাটি ঘটতে যাচ্ছে! তখনই আপনি ভেতরে একটা চাপ অনুভব করতে থাকবেন- কখন প্রকাশ করে দেওয়া যায় খবরটি। এই চাপ কেবল একজন অনলাইন সংবাদকর্মীরই থাকে। বাবুল আক্তারের ঘটনায়ও ছিলো।
অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলে রাখি, অনেক সময়ই অনেক অ্যাসাইনমেন্ট কাভার করতে গিয়ে দেখেছি, ব্রিফিং নিয়ে কিংবা সংবাদ সম্মেলন শেষ করে যখন অন্য অনেকে খাবার টেবিলের দিকে অগ্রসর হন, বাংলানিউজের কর্মীরা তখন এক কোনায় লিখতে বসেন। এই সংবাদকর্মীরা এমনভাবেই তৈরি, ‘খবর মিলেছে, তো প্রকাশ করার ব্যবস্থা নাও। ’
অনলাইনের জন্য চলমান ঘটনার প্রতিটি আপডেটই একেকটি খবর। আর তা সময় মতো প্রকাশ করে যাওয়াই অনলাইন সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব। দুই ভাবে এই প্রকাশ হতে পারে। আপনি যদি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষে জানতে পারেন তাহলেতো কথাই নেই। আর যদি দায়িত্বশীল সূত্রে নিশ্চিত হতে পারেন তাহলেও তার ভিত্তিতেই আপনি খবরটি প্রকাশ করবেন। এতে কোনও অন্যায় নেই, সাংবাদিকতার নীতিমালার নেই সামান্যতম ব্যত্যয়।
কিন্তু ঘটনার ঘটমান প্রক্রিয়ার মধ্যে যেহেতু সংবাদকর্মীর কোনও হাত নেই, তাই এটাও মেনে নিতে হবে, ঘটনাটি পাল্টেও যেতে পারে যেকোনও সময়। তাই বলে ওই পাল্টে যাওয়া অবধি আপনি অপেক্ষা করতে পারবেন না।
হ্যাঁ স্পষ্টই বলছি, অনলাইন সংবাদমাধ্যমের কাজের ধরণ ধারন যাচাই করে, পর্যেবেক্ষণ ও অধ্যয়ন করেই বলছি, এই সময়ের জন্য যতটুকু তথ্য আপনার হাতে ততটুকুই একটি অনলাইন সংবাদ মাধ্যমের জন্য খবর। পরের আপডেট যা আসবে তা পরেই জানাতে হবে।
ব্রেকিংনিউজের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, A breaking story is a news story which is still happening as you report it.
মজার ব্যাপার হচ্ছে ব্রেকিং নিউজে ভুলকেও গ্রাহ্য করে নিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। দিন কয়েক আগে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার অরল্যান্ডোতে নাইট ক্লাবে গুলিতে হতাহতের ঘটনার পর বিভিন্ন মিডিয়ায় ভুল খবর আসে। পরে ওই প্রসঙ্গে সংবাদমাধ্যম নীতি বিশেষজ্ঞ ও ফ্লোরিডার সাংবাদিকতা বিষয়ক বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান পইন্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক কেলি ম্যাকব্রাইড তার একটি আর্টিকেলে লেখেন- Breaking News is a developing story. Some things that get reported by the media may later turn out to be wrong.
ঘটনার ধারাবাহিকতার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি আপডেট পাঠককে জানিয়ে দেওয়া যখন কাজ তখন এই ঝুঁকি থেকেই যায়। এর কারণ এক প্রতিবেদককে নির্ভর করতে হয়, সূত্রের ওপর। সূত্র ভুল করলেই খবর ভুল, যার ওপর প্রতিবেদকের হাত নেই। তবে দায়িত্বশীল সূত্রে খবরটি নির্ভুল করতে পারাটা সংবাদকর্মীর দায়িত্ব, আর সেরা যোগ্যতাও বটে।
বাবুল আক্তার প্রসঙ্গে ফিরি। এই পুলিশ সুপারের স্ত্রী হত্যার বিষয়ে যে খবরটি বাংলানিউজে প্রকাশিত হওয়ার পর ব্যাপক ‘ধামাকা’ তৈরি হয়, আর সমালোচনার ঝড় ওঠে, সেটি ছিলো দায়িত্বশীল সূত্রের পাক্কা খবর। পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েই বাংলানিউজ খবরটি প্রকাশ করে। কিন্তু খবরটি প্রকাশের এক ঘণ্টার মধ্যেই বাবুল আক্তার তার বাসায় ফিরে যাওয়াতে তৈরি হয় কনফিউশন। যা সমালোচকদের অনেক বেশি সক্রিয় করে তোলে।
তবে ওই খবরটি কতটা সত্য তা কিন্তু গত দুই দিন ধরে অন্য সংবাদমাধ্যমে যা কিছু প্রকাশিত হচ্ছে তার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। একটি খবরে সোমবার বলা হয়েছে, আসামিদের কাছ থেকে এমন তথ্য পাওয়া গেছে, যা পুলিশ বিভাগকে বিষ্মিত করেছে। আর সে কথাটিই বাংলানিউজ লেখে শনিবার এইভাবে, ‘আসামিদের দেওয়া তথ্যে কর্মকর্তাদের চক্ষু চড়কগাছ। ’
যাইহোক এই ঘটনা প্রমাণ করলো, দায়িত্বশীল সূত্রেও মেলে সঠিক খবর। যা যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পেতে লেগে যায় আরও দুই-চার দিন।
আরেকটি প্রসঙ্গ, খবরটি প্রকাশের ঘণ্টা দুয়েক পরে বাংলানিউজের পাতায় তা না রাখার কারণে সমালোচনা। সে প্রসঙ্গেও একটি কথা স্পষ্ট করে বলা যায়, অনলাইন সংবাদমাধ্যম আপনাকে সুযোগ দিয়েছে একটি খবর আপনি কতক্ষণ ধরে প্রকাশ করবেন সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার। আপনি চাইলে এখন প্রচার করছেন, এরপর আর করবেন না। সেতো হতেই পারে। আপনি যতজন পাঠককে জানিয়েছেন, এর বেশি পাঠককে জানাতে চান না, সেটাও আপনার সিদ্ধান্ত।
সংবাদপত্রে যদিও এই সুযোগ নেই। একবার প্রকাশিত হয়ে গেলে তা থেকেই যায়। কিন্তু টেলিভিশনের খবরে তো আমরা তেমনই চর্চা দেখি। কোনও খবর তারা একটি বুলেটিনে প্রচার করে পরের বুলেটিনে আর নাও থাকতে পারে।
এটি তাদের যেমন সিদ্ধান্ত। সংবাদ প্রকাশ করে তা সরিয়ে নেওয়াও অনলাইন সংবাদমাধ্যমের নিজস্ব সিদ্ধান্ত, নিজস্ব নীতির বিষয়। এতে সমালোচনায় মুখর হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ অনলাইনটি তার নিজস্ব নিয়মেই ফোকাসড লাইন নির্ধারণ করবে।
তবে হ্যাঁ সকল কিছুর মূলে পাঠক। পাঠকের সন্তুষ্টি এখানে মুখ্য বিষয়। পাঠকের জন্যই এই সকল আয়োজন। আর ওই যে সরিয়ে দেওয়া, তাতেও পাঠকের বিষয়টিই ছিলো বিবেচ্য।
ঘটনার সত্যতা শতভাগ নিশ্চিত হওয়ার পরেও বাবুল আক্তার যখন তার বাসায় ফিরে এলেন আর বাংলানিউজকে নিজেই ফোন করে জানালেন, আসামিদের সঙ্গে কথা বলতেই তার ১৫ ঘণ্টা গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে অবস্থান। সেটিই ছিলো তখনকার সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। আর সে খবরই বাংলানিউজ পরিবেশন করেছে।
পুরোনো খবরটি সত্য হওয়া সত্বেও নতুন খবরের সঙ্গে তার দ্বান্দ্বিক একটা দিক ছিলো যা পাঠকের মাঝে কনফিউশন তৈরি করতে পারে। এ কারণেই বাংলানিউজ তার কোটি কোটি প্রিয় পাঠকের মাঝে আরও বেশি করে পুরোনো খবরটি ছড়াতে চায়নি। সে কারণেই খবরটি তুলে নেওয়া হয়।
তবে স্পষ্ট করে বলা যায়, যারা ততক্ষণে খবরটি জেনে গেছেন তারা নির্ভুল একটি খবরই জেনেছেন তাতে ছিলো না লেশমাত্র সন্দেহ। যা এখন ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে অন্য সংবাদমাধ্যমের খবরে।
এই ধীরে ধীরে জানানোর প্রক্রিয়াটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমের জন্য প্রযোজ্য নয় বলেই তৎক্ষণাৎ জানিয়ে দেওয়া হয়েছিলো।
প্রিয় পাঠক, আপনারা বাংলানিউজের প্রাণ। আপনাদের জন্য কোনও ঘটনার প্রতিমূহূর্তের আপডেট দেওয়াটাই আমাদের অঙ্গীকার।
বাংলাদেশ সময় ১৩১৩ ঘণ্টা, জুন ২৭, ২০১৬
এমএমকে