ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

কর্নেল তাহের আজও কেন প্রাসঙ্গিক?

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১০০ ঘণ্টা, জুলাই ২১, ২০১৬
কর্নেল তাহের আজও কেন প্রাসঙ্গিক?

আজ ২১শে জুলাই মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার শহীদ লেঃ কঃ আবু তাহের বীরউত্তমের ৪০তম আত্মদান দিবস। ১৯৭৬ সালের এই দিনে অবৈধ সামরিক ট্রাইব্যুনালে প্রহসনের রায় প্রদানের মাত্র ৩ দিনের মাথায় অবিশ্বাস্য দ্রুততায় রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে কর্নেল তাহেরকে হত্যা করা হয়।

কর্নেল তাহের প্রাণভিক্ষা না চেয়ে প্রকৃত বীরের মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নিজে মহিমান্বিত হয়েছেন, তার আদর্শকে সমুন্নত রেখেছেন এবং তার সহযোদ্ধাদের গৌরবান্বিত করেছেন। সে কারণেই আজকের দিনটি তার সহযোদ্ধাদের জন্য যতোনা শোকের, তারচেয়েও বেশি গৌরবের। একই সাথে তা জিয়াউর রহমানের বিশ্বাসঘাতকতায় এক প্রচন্ড চপেটাঘাতও বটে। ক্র্যাচে ভর দিয়ে ফাঁসির মঞ্চে উঠার আগে তাহের বলে গিয়েছেল ‘ইতিহাস আমাকে মুক্তি দেবে’। আদালতের রায়ে প্রহসনের বিচার অবৈধ ঘোষিত হওয়ায় তার সে বিশ্বাস যথার্থ প্রমাণিত হয়েছে।
 
কর্নেল তাহের সমাজ বদলের সংগ্রামের এক পর্যায়ে যে রাজনৈতিক ও কর্মকৌশল গ্রহণ করেছিলেন তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও  তার দেশপ্রেম ও শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তির মধ্যে কোন সন্দেহ নেই। তবে বাংলাদেশের সমকালীন রাজনীতিতে তিনি আজও প্রাসঙ্গিক কিনা, তা নিয়ে সম্প্রতি সবিশেষ আলোচনা দেখা যায়নি। অথচ ৪০তম তাহের দিবসে এই প্রসঙ্গটিই গুরুত্বের সাথে আলোচনা করা উচিত।  
 
সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহের দিকে দৃষ্টি দিলেই আমাদের সমাজ ও রাজনীতিতে আজও কর্নেল তাহেরের প্রাসঙ্গিকতা সহজেই বোধগম্য হবে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসী ঘটনাবলী আমাদের সমাজের ভিতই নাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু এসব ঘটনাক্রম হঠাৎ করেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেনি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্রকরে তাদের প্রত্যক্ষ মদদে এই সন্ত্রাস বিস্তার লাভ করলেও সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানের এই ধারাবাহিকতা শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের পরপরই। সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে একটি জাতির মুক্তিলাভের পর দেশের প্রাশাসনিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা যেভাবে ঢেলে সাজানোর প্রয়োজন ছিল বিভিন্ন কারণে সেভাবে তা সাজানো হয়নি বা সাজানো যায়নি। একটি স্বাধীন দেশের প্রশাসনে ঔপনিবেশিক আচার ব্যবস্থা ও পরাধীন আমলের কর্মকর্তা ও নীতিনির্ধারকদের বহাল রাখা যে কতবড় আত্মঘাতী তা বঙ্গবন্ধু নিজে জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন। শুধু তাই নয় এই ত্রুটিপূর্ণ প্রশাসন ব্যবস্থার কারণে বাংলাদেশ প্রগতির পথ থেকে সরে এসে স্বাধীনতার ঊষালগ্নেই সাম্প্রদায়িক মৌলবাদের বিপরীত পথে যাত্রা শুরু করেছিল। কর্নেল তাহের সেই সমস্যাটি চিহ্নিত করেছিলেন সূচনাকালেই। তার এই উপলব্ধির প্রমাণ আমরা প্রথম দেখতে পাই স্বাধীনতার পরপর মুক্তিযোদ্ধাদের মুখপত্র ‘গ্রেনেড’ এ প্রকাশিত তার প্রবন্ধ ‘মুক্তিযোদ্ধারা আবার বিজয়ী হবে’। মুক্তিযুদ্ধের বিজয় যে অনেকাংশেই বিপর্যস্ত হয়েছে তা এই প্রবন্ধের শিরোনামেই স্পষ্ট হয়েছিল। এমনকি ১৯৭২ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর কুমিল্লা ব্রিগেডের কমান্ডার হিসাবে সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করার আবেদনে তিনি লিখেছিলেন, ‘যারা মুক্তিযুদ্ধকালীন আমার চারিদিকে জড়ো হয়েছিল তাদের আমি বলব কি ধরনের বিপদ তাদের দিকে আসছে’। অর্থাৎ, তাহের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের আসন্ন বিপদ তখনই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। প্রবৃত্তিগতভাবে (Instictually) সমাজ ও রাজনীতিবিজ্ঞানী না হলে স্বাধীনতার চেতনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের আসন্ন বিপদ সম্পর্কে স্বাধীনতার নয় মাসের মাথায় এই ভবিষ্যতবাণী করা সম্ভব হতোনা।  

মুক্তিযুদ্ধের পর প্রশাসন ও রাজনীতিতে পুনর্বাসিত পাকিস্তানপন্থীদের নিয়ে আরো লিখেছিলেন, 'এরা বিশ্বাসঘাতক, সর্বযুগে সর্বক্ষেত্রে দেশদ্রোহী, ক্ষমার অযোগ্য। এরা বাংলার সরল জনগণের মাথার বোঝা। এই বোঝাকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। নির্মূল করতে হবে এদেরকে, যাতে বাংলাদেশে আর বিশ্বাসঘাতকতার পুনরাবৃত্তি না হয়'। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এদেরকে নির্মূল করা হয়নি, বরং পুনর্বাসিত করা হয়েছে। বাংলাদেশে তাই বারবার বিশ্বাসঘাতকতার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। তিনি তার প্রবন্ধে আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্রসত্ত্বার বিকাশের বিরুদ্ধে পরাজিত শত্রুদের ষড়যন্রের বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। তৎকালীন রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকেরা যদি তার এই বিশ্লেষণটুকু আমলে নিতেন তাহলে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো। কর্নেল তাহেরের এই উপলব্ধি ও পূর্বাভাস আজও তাই আমাদের রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক। আমরা আবারো পাকিস্তানপন্থী, যুদ্ধাপরাধী ও নব্য সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে নতুন সংগ্রামে লিপ্ত। কিন্তু প্রশাসনে ও ক্ষমতার কাছাকাছি তাদের দোসরদের রাখলে সেই সংগ্রামে আমাদের বিজয় লাভ সম্ভব নয়। দেশকে মৌলবাদ ও পাকিস্তানীকরণের অপসংস্কৃতি থেকে মুক্ত করতে হলে আমাদের সেই সব স্যাবোটাজকারী মহলকে প্রশাসন ও রাজনীতি থেকে অপসারণ করতে হবে। কর্নেল তাহেরের আত্মাহুতি আমাদের সেই শিক্ষাই দেয়। আমরা যদি সেই শিক্ষা বিস্মৃত হই তাহলে ৭৫এর চেয়েও কঠিন পরিনতি আমাদের সামনে অপেক্ষা করবে।

অধুনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির দিকে তাকালে সর্বক্ষেত্রে জনসম্পৃক্ততার ব্যাপক অভাব লক্ষ্য করা যায়। কেউ প্রশাসন ও সুবিধাভোগি একটি শ্রেণিকে ব্যবহার করে আবার কেউবা ভাড়াটে সন্ত্রাসী ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট। এমনকি বর্তমান সরকার দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরিয়ে আনার সর্বাত্মক প্রচেষ্টার ও দেশের উন্নয়নে ব্যাপক সাফল্য লাভের পরও প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে ঘাপটি মেরে থাকা প্রতিক্রিয়াশীল চক্র এবং সরকারি দলের অভ্যন্তরে যারা হেফাজতীসহ বিভিন্ন মৌলবাদী শক্তির সাথে আপস করে চলতে চায় তাদের কারণে বারবার প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছে। জনসম্পৃক্ততার অভাব ঘটলেই সরকার কিংবা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোকে এধরনের অনিয়মতান্ত্রিক ও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠির উপর নির্ভর করতে হয়। এই বিষয়টি যে কেবল রাজনীতি, সমাজকর্ম আর প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রেই তা নয়। যুদ্ধ কিংবা অন্য কোন সামরিক অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রেও তা সমানভাবে প্রযোজ্য। কেবল স্বচ্ছতা ও জনসম্পৃক্ততার অভাবেই সরকারের সদিচ্ছা ও প্রচেষ্টা থাকা সত্ত্বেও সন্ত্রাস ও জঙ্গি বিরোধী অভিযান পুরোপুরি সফল হতে পারছেনা। এই বিষয়েও কর্নেল তাহেরের শিক্ষা প্রণিধানযোগ্য।

১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি বলতেন, 'কৃষকের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে তার খাসি আর মুরগি খেয়ে গেরিলাযুদ্ধ হয় না। ...যদি কোন গোয়ালে রাত কাটাও সকালে গোবরটা পরিষ্কার করো। যেদিন অপারেশন না থাকে, তোমার আশ্রয়দাতাকে একটা ডিপ ট্র্যাঞ্চ ল্যাট্রিন তৈরি করে দিও'।

রাজনীতি, সমাজকর্ম, সামরিক অভিযান সব ক্ষেত্রে এই ছিল কর্নেল তাহেরের দর্শন। জনসম্পৃক্ততার এই প্রয়োজনীয়তাতো সমকালীন বাংলাদেশে আজও প্রযোজ্য, ভবিষ্যতেও প্রযোজ্য থাকবে।  

একজন চৌকস ব্রিগেড কমান্ডার হয়েও তাহের জাত্যাভিমানী (Elitist) মনোভাবের উর্ধে উঠে সশস্ত্র বাহিনীকে একটি উৎপাদনবান্ধব, প্রগতিশিল ও গণমুখী বাহিনী হিসেবে গরে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তার অধীনস্ত কুমিল্লা ব্রিগেডের মনোগ্রাম হিসেবে তিনি প্রস্তাব করেছিলেন 'লাঙ্গল'; 'বন্দুক' কিংবা 'ট্যাঙ্ক' নয়। এই মনোভাবের মাধ্যমেই তিনি একটি স্বাধীন দেশে নতুন ধারার গণসম্পৃক্ত সেনাবাহিনী গড়ে তোলার দর্শনকে উপস্থাপন করেছিলেন। কুমিল্লা ব্রিগেডের কমান্ডার থাকাকালীন তিনি নিজ উদ্যোগে সৈনিকদের বিভিন্ন উৎপাদনমুখী (কৃষি) কার্যক্রমে শরিক করেছিলেন। পদত্যাগ পত্রেও তিনি 'উৎপাদনশীল গণমুখী সেনাবাহিনী যা দেশের প্রগতির জন্য কাজ করবে, সে ধরনের একটি সেনাবাহিনী গড়ে তোলার...' স্বপ্নের কথা উল্লেখ করেছিলেন। একটি স্বাধীন কিন্ত অনুন্নত দেশে দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নেতৃত্ব না থাকলে 'ব্যারাক আর্মি' যে কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে তা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। আর সেজন্যই বিভিন্ন বক্তব্যে, লেখায় এবং জবানবন্দিতে তিনি উৎপাদনে এবং গণমানুষের জীবন সংগ্রামে সেনাবাহিনীকে সম্পৃক্ত করার আহবান জানিয়েছেন। ৭ই নভেম্বরের সিপাহী জনতার গণ অভ্যুত্থানের একটি নিয়ামক হিসেবেও তাহেরের এই দর্শন কাজ করেছে। এই অভ্যুত্থানটি নিছক ক্ষমতার পট পরিবর্তনের একটি প্রয়াস ছিল না, সেনাবাহিনীর খোল নলচে বদলে তাকে একটি গণমুখী চরিত্র দেয়ার প্রচেষ্টাও ছিল। কারণ, তাহের বিশ্বাস করতেন একটি শোষণমুক্ত ও অগ্রগামী সমাজব্যবস্থা কায়েমের একটি অপরিহার্য উপকরণ হচ্ছে এমন একটি সেনাবাহিনী যা জনজীবনে সম্পৃক্ত থেকে বিকশিত হবে। ৭ই নভেম্বরের লক্ষ্য পুরোপুরি সফল হলে বাংলাদেশে একটি প্রগতিশীল ও গণমুখী সেনাবাহিনীর উন্মেষ ঘটতো এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। এই গণমুখী সেনাবাহিনীর ধারনা ও তার প্রায়োগিক দিক নিয়ে অবশ্যই গবেষণা, বিতর্ক এবং ব্যাপকভিত্তিক আলোচনার অবকাশ আছে। খুব সীমিত পরিসরে হলেও বিগত কয়েক দশকে সেনাবাহিনীকে বন্যাত্রাণ ও বিভিন্ন অবকাঠামো বিনির্মাণের মতো কাজে লাগানো হয়েছে। কিন্তু তা কখনো ধারাবাহিকভাবে বিস্তার করানো যায়নি। সেনাবাহিনীকে ব্যারাক থেকে বের করে এনে জনসম্পৃক্ত করার মধ্যে সম্ভাবনা ও ঝুঁকি উভয়ই রয়েছে। তাই এক্ষেত্রে বাস্তবানুগ (প্র্যাগমাটিক) দৃষ্টিভঙ্গী ও ভারসাম্য বজায় রাখা আবশ্যক। সশস্ত্র বাহিনীকে যেমন রাজনীতির উর্ধে রাখতে হবে তেমন তাদের জনজীবন থেকে বিযুক্তও করা যাবেনা। জনজীবন থেকে বিযুক্তি যে কত কত কাউন্টার-প্রোডাক্টিভ হতে পারে স্বাধীনতার পর সংগঠিত অসংখ্য সামরিক অভ্যুত্থান তার সাক্ষ্য বহন করে। আমরা যখন বর্তমান সরকারের নেতৃত্বে নিম্ন-মধ্য আয়ের বলয়ে প্রবেশ করে একটি আধুনিক রাষ্ট্রে পরিনত হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছি তখন সেনা - জনতার সম্পর্ক পুনঃনির্ধারণ করে একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কীভাবে কাজ করা যায় তা নিয়ে কর্নেল তাহেরের চিন্তার আলোকে নতুন করে গবেষণা হতে পারে।

বঙ্গবন্ধু হত্যায় জাসদের কথিত ও কল্পিত ভূমিকা নিয়ে হালে সৈয়দ আশরাফ ও তার সূত্র ধরে কাজী ফিরোজ রশীদ কিংবা তার আগে শেখ সেলিম ও মাহবুবুল আলম হানিফের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটে বিভিন্ন রকম টানাপোড়েন লক্ষ্য করা গেছে। জাসদের অন্যতম প্রধান নীতিনির্ধারক হিসেবে এই বিষয়ে কর্নেল তাহেরের অবস্থান ও ভূমিকা নিয়ে আলোচনা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। আর তা বিচার করতে হবে সমকালীন রাজনীতিতে তাহেরের প্রাসঙ্গিকতাকে মাথায় রেখেই। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, জাসদ ও তাহের তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন চেয়েছিলেন। কিন্তু সে লক্ষ্যে কোন ষড়যন্ত্রের পথে পা না বাড়িয়ে তিনি ও তার সহগামীরা জনগণের শক্তি দিয়ে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করে সেই লক্ষ অর্জন করতে চেয়েছিলেন। উপরন্তু তাহের এধরনের কিছু ষড়যন্ত্রের প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। সেনাবাহিনী থেকে তার পদত্যাগপত্র এই বিষয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল, যা ইতিহাস বিকৃতির বিপক্ষে যাবে। পদত্যাগপত্রে তিনি তার প্রতি বঙ্গবন্ধুর আন্তরিকতার কথা জানিয়েছেন। সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে তার দ্বিমতের কথা উল্লেখ করলেও এই পদত্যাগপত্রে পারষ্পরিক বিদ্বেষের কোন প্রকাশ নেই। তিনি সেই পদত্যাগপত্রে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে সেনাছাউনির অভ্যন্তরে একটি অভ্যুত্থান পরিকল্পনার ব্যাপারেও সরকারকে সতর্ক করেন। তিনি লিখেছিলেন, "ষড়যন্ত্র এখনো চলছে এবং আরো অনেকে এর সাথে জড়িত রয়েছে। এ ধরনের ক্ষমতা দখল হচ্ছে সামগ্রিকভাবে জনগণের আশা-আকাঙ্খার বিরুদ্ধে। এবং এটাকে রুখতে হবে"। বলা বাহুল্য যে, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রায় ২ বছর ১১ মাস আগে (২২শে সেপ্টেম্বর ১৯৭২) তাহের যে সতর্কতা সংকেত দিয়েছিলেন তাতে কর্নপাত করা হয়নি এবং অবশ্যম্ভাবী পরিনতিও রোধ করা সম্ভব হয়নি। যারা জাসদ গঠনের পটভূমি জানেন, তারা অবগত আছেন যে জাসদের অভ্যুদ্যয় ও সরকার বিরোধীতা বঙ্গবন্ধুর প্রতি ব্যক্তিগত বিদ্বেষপ্রসূত ছিল না। একটি রাজনৈতিক পটভূমিতে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে ঘনিষ্ট ছাত্রনেতাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের হাতে জাসদের গোড়াপত্তন হয়। একটি সদ্য স্বাধীন দেশের উপযোগি রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা কায়েমে তারা যে কর্মসূচিকে যথার্থ মনে করেছিলেন সে কর্মসূচিতে বঙ্গবন্ধুকে সম্মত করাতে না পেরেই তারা আওয়ামী লীগের নীতিমালার বিপক্ষে জনগণকে সংগঠিত করতে জাসদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এতে ব্যক্তিবিদ্বেষের লেশমাত্র ছিল না। জাসদ কিংবা কর্নেল তাহেরের তখনকার পদক্ষেপ বা কর্মসূচিগুলোর সবগুলো সময়োপযোগি কিংবা বাস্তবানুগ ছিল কিনা তা নিয়ে অবশ্যই বিতর্ক হতে পারে। সে ধরনের বিতর্ক ও সমালোচনা যদি বস্তুনিষ্ঠ হয় তা থেকে তাহেরের সহযোদ্ধাদের আত্মশুদ্ধির সুযোগ থাকবে। পথ নিয়ে যতোই বিতর্ক থাকুক, একটি শোষণমুক্ত সমতাভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ায় তাদের গন্তব্য নিয়ে কখনো প্রশ্ন থাকতে পারেনা। না হয় স্বেচ্ছায় ক্ষমতার অংশীদারিত্ব ত্যাগ করে রাজপথে নেমে আসার ইতিহাস আমাদের রাজনীতিতে দ্বিতীয়টি নেই। তবে জাসদ এবং কর্নেল তাহেরের সে সময়কার পদক্ষেপ নিয়ে পর্যালোচনা করতে গেলে তদানীন্তন সরকারের দমননীতি, বিশেষ করে রক্ষীবাহিনী দিয়ে জাসদকে মোকাবেলা করার নীতি কতোটা যথার্থ ছিল তা নিয়েও বিতর্ক ও সমালোচনার অবকাশ থাকবে। সেই সময়টাকে বিশ্লেষণ করতে হবে সেই সময়ের পটভূমিতে, সেই সময়ে ক্রিয়াশীল শক্তিগুলোর কথা মাথায় রেখে। আমরা যদি বস্তুনিষ্ঠ ও নির্মোহভাবে সেই সময়ের পর্যালোচনা করতে পারি তবেই তখনকার ভুলত্রুটিগুলোর আলোকে তা থেকে শিক্ষা নিয়ে স্বাধীনতার সপক্ষের সবগুলো শক্তির মৈত্রী দীর্ঘস্থায়ী করা সম্ভব। অতীতের শিক্ষায় ভুলত্রুটি সংশোধন করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা না থাকলে এই সব কাঁদা ছোড়াছুড়ি কেবল এই মৈত্রীকে দূর্বলই করবেনা, ৭৫ এর মতোই নতুন ষড়যন্ত্রের দরজা উন্মুক্ত করবে।

আজ ৪০তম তাহের দিবসে বহুধা বিভক্ত সাবেক সহযোদ্ধারা বিভিন্ন, সেমিনার ও স্মরণসভায় তাহেরের স্মৃতিচারণ ও তার অনুসৃত পথ ও রাজনীতি নিয়ে সবিস্তারে আলোচনা করবেন। গত ৪০ বছরে এধরনের আলোচনা ও সেমিনার হয়েছে অগনিত। কিন্তু রাজনীতি, সমাজ প্রগতির ভাবনা ও সেনা-জনতার সম্পর্ক পূনর্বিন্যাস নিয়ে তাহের দর্শনের হালনাগাদ পর্যালোচনা ও বিস্তারের বদলে তাহেরের সাবেক সহযোদ্ধারা এই দিনটিকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শোক, ক্ষোভ আর স্মৃতিচারণের উপলক্ষ হিসেবে বেছে নিয়েছেন। অথচ কর্নেল তাহেরের স্বপ্ন পূরণে বাংলাদেশে একটি শোষণমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক ও সমতাভিত্তিক সমাজব্যবস্থা কায়েমের সংগ্রামকে জোরদার করা সম্ভব হয়নি। বরং এই সংগ্রামটি ক্রমেই দূর্বল থেকে দূর্বলতর হয়েছে। এই দূর্বলতার জন্য সাম্প্রতিক রাজনীতির অবক্ষয় ও বিরাজনীতিকরণকে দায়ী করাই যথেষ্ট নয়। তাহেরের সহযোদ্ধাদের বহুধা বিভক্তি, দৃশ্যমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচির অভাব কিংবা প্রচারের ব্যার্থতা এবং সর্বোপরি বাম প্রগতিশীল শক্তিসমূহের অনৈক্য এর জন্য সমানভাবে দায়ী। জাসদের মূলধারার সাম্প্রতিক বিভক্তি তাহের অনুসারীদের প্রচন্ড একটি ধাক্কা দিয়েছে। এই পিছিয়ে পড়া আদৌ তারা কোনদিন কাটিয়ে উঠতে পারবে কিনা তা জানার জন্য আমাদের ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে থাকতে হবে। দেশে যখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রগতিশীল শক্তিসমূহের বৃহত্তর ঐক্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছে ঠিক সেই সময় জাসদের বিভক্তি সক্রিয় রাজনীতির বাইরে থাকা জাসদের অগনিত সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ীদেরও চরমভাবে হতাশ করেছে। যেখানে জাসদ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও ক্ষমতার বাইরে থাকা বাম গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের মধ্যে একটি সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করতে পারতো সেখানে বিভক্তির কারণে তারা নিজেরাই মানুষের সেই আস্থাটুকু বিসর্জন দিচ্ছেন। জাসদের দুই শিবির যতো তাড়াতাড়ি এটা বুঝতে পেরে ঐক্যপ্রয়াসী হবেন ততোই মঙ্গল। না হয় তাহেরের স্বপ্ন ক্রমেই দূর থেকে দূরতরে ঢাকা পড়ে যাবে। জাতীয় চাহিদা ও তৃণমূলের আকাংখার ভিত্তিতে একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক কর্মসূচিতে দুই শিবিরের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি ফর্মূলায় জাসদের পুনরেকত্রীকরণের অঙ্গীকারই হবে এবারের তাহের দিবসে তার প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা নিবেদন। তা না হলে কর্নেল তাহেরের জীবন আদর্শ, ও দর্শন বাংলাদেশের সমকালীন রাজনীতিতে যতোই প্রাসঙ্গিক থাকুকনা কেন তার সহযোদ্ধারা ক্রমেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বেন।
  
সেই সাথে তাহেরের দর্শন ও চেতনা প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দিতে না পারলে একদিন সেই প্রাসঙ্গিকতাও মলিন হয়ে যাবে। তাহেরের চেতনাকে বিকশিত করতে তাই ২১শে জুলাই কিংবা ৭ই নভেম্বরের ঘটনা প্রবাহের চর্বিত চর্বনই যথেষ্ট নয়। সেজন্য তাহেরের রাজনৈতিক দর্শন, রাষ্ট্রচিন্তা ও তার প্রায়োগিক সম্ভাবনা নিয়েও ব্যাপকভিত্তিক গবেষণার সূত্রপাত ঘটানো প্রয়োজন। প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অনেকেই নির্বাসিত হলেও তার সহযোদ্ধাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এখন সমাজ ও রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন। তার দর্শন ও সমাজচিন্তা নিয়ে কাজ করার জন্য একটি ‘তাহের গবেষণা কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা করা তাদের পক্ষে সম্ভব। সমাজবিজ্ঞানী, প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক, রাজনৈতিক বোদ্ধা আর নতুন প্রজন্মের গবেষকদের নিয়ে গড়ে ওঠা এ ধরনের গবেষণাকেন্দ্র প্রগতিশীল রাজনীতির দিক নির্দেশনা দিতে একটি অনন্যসাধারণ ভূমিকা রাখতে পারে। সাম্প্রতিক বিশ্বমন্দায় পুঁজিবাদী অর্থনীতি সমূহের বিপর্যয়, চীনে সোস্যালিষ্ট মার্কেট ইকোনমির বিকাশ এবং ল্যাটিন আমেরিকায় বাম গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের উত্থান দেশে দেশে প্রগতিশীল আন্দোলনে নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছে। এই প্রেক্ষাপট জাসদসহ বাংলাদেশের ক্ষয়িষ্ণু বাম শক্তিগুলোর সামনেও নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। তবে এর জন্য ঐক্যের যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন দক্ষিণ আমেরিকার অভিজ্ঞতাকে দেশীয় প্রেক্ষিতে কাজে লাগানোর গবেষণার। এ ঐক্যের প্ল্যাটফর্ম আর গবেষণার নিউক্লিয়াস হিসাবে ভূমিকা রাখতে পারে প্রস্তাবিত এই ‘তাহের গবেষণা কেন্দ্র’ বা ‘তাহের স্টাডি সেন্টার’। কর্নেল তাহেরের রাজনীতি ও দর্শনকে প্রাসঙ্গিক রাখতে হলে শোকের মর্সিয়া ক্রন্দনের চেয়ে যথার্থ গবেষণা ও প্রচারের মাধ্যমে তা প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দেয়া অধিকতর জরুরি। তার বহুধা বিভক্ত সহযোদ্ধারা এই বিষয়টি মনে রাখলেই তা কর্নেল তাহেরকে আমাদের জাতীয় অস্তিত্বে প্রাসঙ্গিক রাখবে অনগত দিনগুলোতে।

বাংলাদেশ সময়: ০০৫৯ ঘণ্টা, জুলাই ২১, ২০১৬
এমএমকে/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।