ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

একজন প্রবাসী খুন এবং ন্যায়বিচার দাবিতে ব্রিটিশ এমপির চাপ

সাজেদুল চৌধুরী রুবেল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৫২ ঘণ্টা, আগস্ট ৩, ২০১১
একজন প্রবাসী খুন এবং ন্যায়বিচার দাবিতে ব্রিটিশ এমপির চাপ

বাংলাদেশের আড়ং থেকে দু-তিনটি ফতোয়া এনেছিলাম বড় শখ করে, সামারে পড়বো বলে। তা আর হয়ে উঠছিলো না।

আজ সহসাই যেনো প্রকৃতি বদলে গেলো। দমকা হাওয়া নেই, মেঘ-বৃষ্টি নেই।   আকাশে উঁকি দিয়ে উঠলো টক টকে লাল সূর্য। প্রকৃত সামারের গন্ধ পাওয়া গেলো। বাইরে তাকিয়ে দেখলাম বাংলাদেশের চৈত্রের রোদের মতোই চিক চিক করছে। এমন রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে কি কেউ কাজ করতে পারে! আমারও মন টিকছিল না। আয়ারল্যান্ডে এরকম ঝলমলে রোদ পাওয়া হাতে আকাশের চাঁদ পাওয়ার মতোই। তাই কোনোরকমে অর্ধদিবস কাজ করে ছুটি নিয়ে চলে আসি। স্ত্রী একটি পার্টটাইম জব করেন। সৌভাগ্যক্রমে তারও আজ ছুটি। আর বাধা কোথায়! চার মাসের মেয়েকে নিয়ে দুজনে বেরিয়ে গেলাম। সূর্যস্নাত পরিচ্ছন্ন আকাশে লং ড্রাইভ করার মজাই আলাদা। অনেক দিন ধরে মেয়েকে নিয়ে ক্যাস্টলট্রয় পার্কে যাবো ভাবছিলাম। বৈরী আবহাওয়ার জন্য হয়ে উঠেনি। আজ তো এ সুযোগ আর হাতছাড়া করা যায় না!

হাইওয়েতে ড্রাইভ করছিলাম আর মনে মনে ভাবছিলাম কাজে থাকা অবস্থায় কফি ব্র্যাকে পড়া আইরিশ টাইমসের একটি সংবাদ সম্পর্কে। সংবাদটি হচ্ছে : রাশিয়ায় ট্রেন দুর্ঘটনায় ৪৯ জন লোক নিহত হয়। অথচ বাংলাদেশে ট্রাক দুর্ঘটনায় ৪৪ কোমলমতি কিশোর শিক্ষার্থীর যে মর্মান্তিকভাবে যে প্রাণহানি ঘটে, সে খবরটি এ পত্রিকায় কোনো গুরুত্বই পায়নি। তবে গত হরতালে জয়নাল আবদিন ফারুক যে পুলিশের সাথে হাতাহাতিতে লিপ্ত হয়ে পুলিশ কর্তৃক নিপীড়িত হয়েছেন তা দিল্লি প্রতিনিধি ঠিকই পত্রিকাটিতে পাঠিয়েছেন এবং ছাপাও হয়েছে। এসব ভাবতে ভাবতে যখন গাড়ি দ্রুতগতিতে চালাচ্ছিলাম তখনই স্ত্রী সতর্ক করে দিয়ে বললেন, চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ের ঘটনাটি তাকে খুব পীড়া দিচ্ছে। এজন্য তার মন ভালো নেই।

ড্রাইভিং এবং কথোপকথন এ দুটোই করছিলাম। এরই মধ্যে যুক্তরাজ্য থেকে আমার পূর্বপরিচিত এক ছোট ভাই রাহেল মোবাইলে কল করল। ড্রাইভিং অবস্থায় মোবাইলে কথা বলা আইনত দণ্ডনীয় বলে মটর ওয়ের হার্ড শোল্ডারে গাড়ি থামিয়ে হ্যাজাক লাইট অন করে দিয়ে কথা বলতে শুরু করি। সমধারার রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলো বলে ছোট হলেও রাহেলের সাথে আমার সখ্য ছিল বেশ গভীর। যতোটুকু মনে পড়ে, সিলেট সদর ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক থাকাকালেই সে চলে যায় যুক্তরাজ্যে। তারপর খুব বেশি একটা যোগাযোগ হতো না তার সাথে।

রাহেলের চাপা ক্ষোভমিশ্রিত কথা থেকে বোঝা গেলো, তাঁর শ্বশুর তাহির আলী একজন ব্রিটিশ নাগরিক। তিনি অবসর জীবনযাপনের জন্য গিয়েছিলেন সাধের জন্মভূমি সিলেটের বিশ্বনাথে। ভেবেছিলেন বুড়ো বয়সটা এবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে সেখানে কাটাবেন। তার আর দরকার হলো না। এর আগেই তাকে বিদায় নিতে হলো পৃথিবীতে থেকে। স্থানীয় কোনো এক ব্যক্তির সঙ্গে ভূমিসংক্রান্ত বিরোধ ছিলো। আপসরফা করার জন্য স্থানীয় সরকারদলীয় সংসদ সদস্যর কাছে কয়েকবার ধরনা দিয়েও এর ফল পাওয়া যায়নি। বরং তারই ছায়াতলে থেকে ওই বিশেষ ব্যক্তির (যিনি একজন বিশেষ রাজনৈতিক দলের সদস্য) প্ররোচনায় কিছু সন্ত্রাসী তাহির আলীকে নিজ বাড়িতে খুন করে। মামলা করতে গেলে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন এটাকে ডাকাতি বলে অন্যদিকে মোড় ঘু–রিয়ে দিতে চায়। গত ৪ জুলাই দৈনিক সংবাদ-এর প্রথম পৃষ্ঠায় এ ব্যাপারে একটি প্রতিবেদনও ছাপা হয়। এতে ঘটনাটি সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হয়েছে।

তাহির আলী খুনের ঘটনায় গোটা ব্রিটেনে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এমপি রোশনারা আলীসহ বাঙালি কমিউনিটির মধ্যে তীব্র উত্তেজনা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশ এখন পর্যন্ত নিহত তাহির আলীর হত্যায় অভিযুক্ত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। দেশের পুলিশের ওপর আস্থা রাখতে না পেরে তাহির আলীর মেয়ে ব্রিটেনের ম্যানচেস্টার রচবেল এলাকার এমপি মি. সাইমন ডাংকোচের শরনাপন্ন হন। ফলে তিনি তাদের শান্তনা দেয়ার জন্য তাদের বাসায় যান এবং ঘটনার জন্য সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে বিচার দাবি করেন। শুধু তাই নয়, মি. সাইমন একজন ভিনদেশি হয়েও কীভাবে তাহির আলীর নির্মম মৃত্যুতে সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন এবং বিষয়টির সঠিক তদন্তসাপেক্ষে বিচারের জন্য কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন তা উপলব্ধি করার জন্য পাঠকদের সামনে আমি নিহতের মেয়ে জ্যোৎস্না বেগমকে লেখা তার একটি চিঠির একাংশ হুবহু তুলে ধরলাম : `Dear Ms Begum, Thank you for your family’s visit to my office last week and for allowing me to visit your family last Friday. I was shocked and appalled to hear about the nature of your father’s death.

I have instructed my office to make this case a priority. I will do all i can to put pressure on the Bangladeshi authorities to ensure that this terrible crime is investigated and the perpetrators are brought to justice.

I have already written to the British High Commission in Sylhet and received a response. I have enclosed copies om letter and the response.`

হায়রে দেশমাতৃকা! বড় দুঃখ হয়। যে তাহির আলী সারাটা জীবন কাটিয়ে দিলেন প্রবাসে দেশীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করার জন্য, সেই তাহির আলীর নিরাপত্তা দেশ দিতে পারেনি। তাকে খুন হতে হলো নিজ দেশে। খুনের বিচার প্রক্রিয়া নিয়েও আবার কতো টালবাহানা! স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হিসেবে স্থানীয় সাংসদ শফিকুর রহমান চৌধুরীর যে ভূমিকা পালন করার কথা ছিলো তা করছেন সাত সম–দ্র তেরো নদীর পার থেকে ব্রিটিশ এমপি মি. সাইমন। সঠিক বিচারের জন্য তিনি চিঠি লিখছেন বাংলাদেশে অবস্থিত ব্রিটিশ হাইকমিশনকে, তার দেশীয় পররাষ্ট্র সচিব উইলিয়াম হাগকে এবং জোরালোভাবে চাপ সৃষ্টি করছেন বাংলাদেশ সরকার তথা যথাযথ কর্তৃপক্ষকে।

মি. সাইমনকে এজন্য আমি ধন্যবাদ বা সাধুবাদ জানাবো না। শুধু এটুকু বলতে চাই, তার এ নৈতিক প্রচেষ্টা বা উদ্যোগ কি দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে না? বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। এখানে একটি গণতান্ত্রিক সরকার আছে। আছে স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, আছে প্রশাসনযন্ত্র। তারপরও কেন একজন ব্রিটিশ বাঙালি খুনের বিচারের দাবিতে একজন ভিনদেশি এমপিকে নাক গলাতে হচ্ছে? এটা কি দেশের জন্য, জাতির জন্য কলঙ্ক নয়? লজ্জা নয়?

আর কতোকাল আমাদের লজ্জা মাথায় নিয়ে কলঙ্কের দাগ শরীরে নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে?

লেখক : আয়ারল্যান্ড প্রবাসী

বাংলাদেশ সময় ২০২২ ঘণ্টা, ৩ আগস্ট ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।