বহুদিন থেকে আমি প্রতি দুই সপ্তাহ পর পর লিখে আসছি। এবারে কি লিখব আমি বেশ আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম এবং সেটি নিয়ে আমার ভেতরে এক ধরনের আনন্দ ছিল।
আমরা সবাই জানি এই দেশে ধর্মান্ধ মানুষ আছে, কীভাবে কীভাবে জানি তাদের কাছে ধর্ম একটা বিচিত্র রূপ নিয়ে এসেছে। নিজ ধর্মের অবমাননা হয়েছে এই ধরনের একটা কথা ছড়িয়ে দিয়ে এই ধর্মান্ধ মানুষগুলো অবলীলায় অন্য ধর্মের মানুষের উপাসনালয় তছনছ করে ফেলতে পারে; শুধু তাই নয় অন্য ধর্মের একেবারে নিরপরাধ মানুষটিকে নির্যাতন করতে পারে, অপমান করতে পারে। রামুতে যে ঘটনাটি ঘটেছিল আমরা কেউ সেটা ভুলিনি, এবং সেটা কীভাবে ঘটানো হয়েছিল সেই ইতিহাসটুকুও আমাদের সবার স্পষ্ট মনে আছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর এলাকার ঘটনাটি হুবহু রামুর ঘটনার একটি পুনরাবৃত্তি ছাড়া কিছুই নয়। শুরু হয়েছে ফেসবুকে একটি আপত্তিকর পোস্ট দিয়ে, যার একাউন্ট থেকে এটি এসেছে সে পরিষ্কারভাবে জানিয়েছে সে নিজে এটি করেনি, অন্য কেউ তার হয়ে করেছে। সে আপত্তিকর ছবিটি সরিয়ে দিয়েছে এবং সবার কাছে এরকম একটি ঘটনার জন্যে ক্ষমা চেয়েছে। ব্যাপারটি এখানেই শেষ হওয়ার কথা ছিল কিন্তু সেটি শেষ হয়নি। স্থানীয় মানুষজন তাকে ধরে পুলিশে দিয়েছে এবং তার বিরুদ্ধে একটা মামলাও হয়ে গেছে। এই পর্যায়ে অবশ্যই পুরো ব্যাপারটা পুরোপুরি নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়ার কথা, যে অপরাধ করেছে তাকে ধরে পুলিশে দিয়ে মামলা হয়ে গেছে— এর পরে আর কিছু কী করার আছে?
অথচ আমরা দেখলাম মূল ঘটনাটি শুরু হলো এর পর থেকে। মসজিদে মসজিদে মাইকে করে পরদিন একটা বিক্ষোভ মিছিলে সবাইকে যোগ দিতে বলা হয়, এবং দুপুর বারোটার ভেতরে অনেক মানুষকে একত্র করে সবাই মিলে মন্দিরে মন্দিরে হামলা করতে শুরু করলো, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাসা লুট করতে শুরু করা হলো এবং একেবারে পুরোপুরি নিরপরাধ মানুষকে শুধুমাত্র হিন্দু হওয়ার অপরাধে মারধর করা হতে লাগলো।
স্থানীয় হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষদের ভেতরে পুরো ব্যাপারটি নিয়ে হতাশা এবং ক্ষোভ জন্ম নেয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এই দেশের সবাই রামুর ঘটনাটি জানে, কীভাবে এই ধরনের একটা ঘটনা তৈরি করে ভিন্ন ধর্মের মানুষের ওপর অত্যাচার করা হয়, তাদের উপাসনালয় ধ্বংস করা হয় সেটিও সবাই জানে। সেই একই ব্যাপার ঘটতে শুরু করেছে দেখার পরও প্রশাসন কিংবা পুলিশ সেটিকে থামানোর চেষ্টা করল না সেটি দেখে আমরা খুব অবাক হয়ে যাই। আমরা বুঝতে পারি না, মনে হয় ধর্মান্ধ মানুষগুলোর দলবেধে অন্য ধর্মের মানুষের মন্দির ধ্বংস করার ব্যাপারটিতে এই পুলিশ কিংবা প্রশাসনের এক ধরনের প্রচ্ছন্ন সায় রয়েছে। আমরা যেটা অনেক জায়গাতে দেখতে শুরু করেছি আজকাল শুধুমাত্র নিজের ধর্মের জন্যে লোক দেখানো ভালোবাসা যথেষ্ট নয়, তার সাথে অন্য ধর্মের জন্যে এক ধরনের অবহেলা দেখানো মোটামুটি নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২.
আমাদের দেশে সামাজিক নেটওয়ার্ক কিংবা সোজা বাংলায় ফেসবুক নামে একটি জগত্ আছে সে জগিটর সাথে আমার বিন্দুুমাত্র যোগাযোগ নেই। শুনতে পেয়েছি এই জগতে যারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এই ঘটনাটি দেখে মর্মাহত হয়ে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে লেখালেখি করেছেন তাদের বিরুদ্ধে কিছু মানুষ কথা বলতে শুরু করেছে। আমার যেহেতু এই জগিটর সাথে যোগাযোগ নেই (এবং যোগাযোগের আগ্রহও নেই) তাই তারা ঠিক কোন্ যুক্তি দিয়ে একজন মানুষের ধর্মীয় অনুভূতির “আঘাত” দেয়ায় অভিযোগে অন্য মানুষকে পীড়ন করতে পারে সেটি কোনোদিন জানতে পারব না। কিন্তু যে বিষয়টি খুব দুর্ভাবনার সেটি হচ্ছে এই দেশে এরকম মানুষ আছে তারা প্রকাশ্যে সুযোগ পেলেই অন্য ধর্মের মানুষের মন্দির ভেঙে ফেলাকে সমর্থন করে। যায় অর্থ এই দেশে যারা প্রকাশ্যে ফেসবুকে সেটি নিয়ে লেখালেখি করে না কিন্তু মনে মনে এটি সমর্থন করে সেরকম মানুষের নিশ্চয়ই অভাব নেই। এরা যে খুব দূরের মানুষ তাও নয়—আমরা আমাদের খুব কাছাকাছি এদেরকে খুঁজে পাই।
নতুন পৃথিবীতে এদের কোনো স্থান নেই, হয়তো সেজন্যেই সারা পৃথিবীতেই এরা এতো মরিয়া হয়ে উঠেছে। একজন মানুষকে ভালোবাসা কতো সহজ কিন্তু সেই সহজ এবং সুন্দর কাজটি না করে ভালোবাসার বদলে তারা কত কষ্ট করে হিংসা কিংবা বিদ্বেষ ছড়ানোর চেষ্টা করছে, দেখে মাঝে মাঝে খুব অবাক হয়ে যাই।
আমাদের দেশের এই মানুষগুলো দেশকে এগুতে দিতে চায় না, এরা দেশটাকে পিছনে টেনে রাখতে চায়। এই মানুষগুলো নিজে নিজে ভালো হয়ে যাবে কিংবা অসাম্প্রদায়িক হয়ে যাবে, হঠাত্ একদিন অন্য ধর্মের মানুষগুলোকে সম্মান করতে শুরু করবে এবং তাদেরকে ভালোবাসাতে শুরু করবে সেটা ভাবার কোনো কারণ নেই। আমরা যদি একটা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ চাই তাহলে তার জন্যে আমাদের কাজ করতে হবে। সাম্প্রদায়িক মানুষেরা সারা পৃথিবীতেই কাজ করে যাচ্ছে, আমরা যদি তাদেরকে দেখে শুধুমাত্র বড় বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলি তাহলে হবে না।
আমার মনে হয় সবার আগে আক্রান্ত মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াতে হবে। শুধু যে পার্থিবভাবে তা নয়, মানসিকভাবে এবং আত্মিকভাবে। সারা দেশের সব মানুষের এটাকে নিন্দা করতে হবে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের নিজেদের ভাষায় প্রতিবাদ করতে হবে। আমাদের দেশে সুশীল সম্প্রদায় কথাটি এখন ইতিবাচক কথা নয়, তারপরও যেটুকু আসে তাদেরকেও এই তাণ্ডবের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে, লেখালেখি করতে হবে। সাংবাদিকদের পত্র-পত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশনের বিষয়টি তুলে ধরতে হবে। এবং অবশ্যই সবচেয়ে বড় দায়িত্ব সরকারের। যারা ক্ষতিগ্রস্ত তাদের সাহায্য করে যারা অপরাধী তাদের শাস্তি দিতে হবে যেন ভবিষ্যতে কারো মাথায় যদি এরকম ঘটনার একটি অশুভ চিন্তা খেলা করে তারা যেন কাজটি করার আগে একশ’বার চিন্তা করে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি আমাদের বাংলাদেশের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটি এখন উন্নয়ন করে মধ্যম আয়ের দেশ হওয়া নয়, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ দেশটিকে একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে গড়ে তোলা।
এই দেশে একটা শিশু যখন বড় হয় তখন স্কুলে তাকে আমরা বিশ্লেষণ করতে শেখাই না, তাকে আমরা তথ্যকে কোনো প্রশ্ন না করেই সব তথ্য জেনে নিতে শেখাই। যদি তাকে বিশ্লেষণ করতে শেখাতাম তাহলে তারা চারপাশের সাম্প্রদায়িক পরিবেশকে নিজেরাই প্রশ্ন করতে শিখতো এবং সত্যি উত্তরটি নিজেরাই বের করে নিতে শিখতো।
একেবারে শিশুদের স্কুল থেকে তাদের শিখাতে হবে ভিন্ন মানে খারাপ নয়, ভিন্ন মানে বৈচিত্র্য আর এই পৃথিবীর পুরো সৌন্দর্যটিই আসে বৈচিত্র্য থেকে। একটি মুসলমান শিশু যখন প্রথমবার একটা হিন্দু শিশুকে দেখবে কিংবা যখন একটা হিন্দু শিশু প্রথমবার একটা মুসলমান শিশুকে দেখবে তখন দু’জন-দু’জনের ভেতর যে পার্থক্যটুকু খুঁজে পাবে সেটাই হচ্ছে বৈচিত্র্য! সেই বৈচিত্র্যটি দোষের নয় সেই বৈচিত্র্যটিই হচ্ছে সৌন্দর্য। সেই সৌন্দর্যটি দূরে ঠেলে রাখতে হয় না, সেই সৌন্দর্যটুকু উপভোগ করতে হয়।
দেশটিকে অসাম্প্রদায়িক আধুনিক একটা বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে একেবারে শৈশবে তাদেরকে এই দেশের ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের সাথে, তাদের উত্সবের সাথে, রীতিনীতির সাথে, সংস্কারের সাথে এমনভাবে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে যেন তারা সকল ধর্মের জন্যে সমান শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে বড় হতে শেখে। আমরা আমাদের দেশে রামুর ঘটনা কিংবা নাসিরনগরের ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর দেখতে চাই না। এই দেশে মুসলমান জনগোষ্ঠী তাদের দেশটিকে যতোটুকু আপন বলে ভালোবাসতে শেখে অন্য ধর্মের মানুষও যেন ঠিক একইভাবে দেশটিকে সমানভাবে নিজের দেশ বলে ভাবতে শিখে সেটি নিশ্চিত করতেই হবে। যদি সেটি না হয়, যদি তারা শুধু গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাহলে বুঝতে হবে বাংলাদেশ কিন্তু আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ হতে পারেনি।
আমরা কি দীর্ঘশ্বাসটুকু শুনতে পাচ্ছি?
লেখক :কথাসাহিত্যিক, শিক্ষক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট