ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী ও ফেনী। এ ছয় জেলাকে নিয়ে আলাদা বিভাগ বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছে সরকার।
স্বভাবতই সমতটের ঐতিহ্য ও প্রাণকেন্দ্র ময়নামতির নামে বাস্তবায়ন হচ্ছে এ বিভাগ। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আঞ্চলিক প্রাচীন ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিক স্থাপনা এখন থেকে গুরুত্ব পাবে বিভাগ নামকরণে, সে বিবেচনায়ও সমতটে প্রস্তাবিত বিভাগের নাম হচ্ছে ময়নামতি।
৭ম ও ৮ম শতকে বর্তমান কুমিল্লা ও ত্রিপুরার উদয়পুর জেলার পিলাক নগর নিয়ে গড়ে ওঠা ময়নামতি সভ্যতাকেই মূলত নতুন বিভাগের পটভূমিতে রাখতে চাইছে সরকারপক্ষ।
কিন্তু আলোচনা উঠেছে, কেন এ বিভাগের নাম কুমিল্লা হবে না? এই আলোচনা তুলেছেন দৃশ্যত কেবল কুমিল্লার কতিপয় ব্যক্তি। প্রস্তাবিত বিভাগের বাকি পাঁচ জেলা ‘ময়নামতি’র বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ‘টু’ শব্দটিও করেনি। বরং ঐতিহাসিক স্থাপনা ঘিরে নামকরণে সরকারের নাম নির্বাচনের রুচিশীলতাকে প্রশংসায় ভাসাচ্ছেন বিশিষ্টজনেরা।
এই আলোচনায় এখন যদি পাল্টা প্রশ্ন ওঠে, কুমিল্লার ওই অংশ কি মনে করছেন যে কেবল তাদের জেলাকে নিয়েই বিভাগ বাস্তবায়ন হচ্ছে, যেজন্য কুমিল্লা নামেই নামকরণ হতে হবে? ঘিঞ্জি হয়ে ওঠা, মূল মহাসড়ক থেকে ভেতরে পড়ে যাওয়া কুমিল্লা শহরেই বিভাগের সদরদফতর গড়ে তুলতে হবে? কোনো জবাব থাকবে কি?
এদিক থেকে সুধীজনেরা ‘ময়নামতি’ বিভাগ ঘোষণায় যেমন সরকারের নাম নির্বাচনে রুচিশীলতা ও ঐতিহ্যপ্রীতি দেখছেন, তেমনি দেখছেন আঞ্চলিকতার প্রভাব প্রদর্শনে চলমান একাধিক বিভাগ বাস্তবায়নের দাবি চুকে ফেলার মুন্সিয়ানাও।
আবার কোনো নির্দিষ্ট স্থানের নামেই যে কোনো প্রশাসনিক ইউনিটের নামকরণ হতে হবে তার বাধ্যবাধকতাও কিন্তু নেই। যেমন নোয়াখালী নামে জেলা থাকলেও ঠিক ওই নামে কোনো লোকালয় বা মহল্লার অস্তিত্বই নেই। কাজেই ময়নামতি নামে কোনো ঐতিহাসিক বিভাগীয় প্রশাসনিক ইউনিট স্থাপিত হলে তার আওতায় কুমিল্লার থাকতে কোনো বাধা নেই।
নামকরণের বিতর্ক পাশে রেখে যদি উন্নয়নের স্বার্থ চিন্তা করা হয়, তাহলে কুমিল্লাবাসীরই খুশিতে টগবগে হওয়ার কথা বলে মনে করেন সুধীজনেরা। কারণ বিভাগ বাস্তবায়নকে উপলক্ষ করে ময়নামতিকেন্দ্রিক উন্নয়নের নবজোয়ার শুরু হবে। গড়ে উঠবে নতুন অবকাঠামো, উন্নত হবে যোগাযোগ, হবে নতুন নতুন কর্মসংস্থান। সেই হাওয়ায় আরও উজ্জ্বল হবে সমতটের জেলা হিসেবে কুমিল্লাও।
এমনকি ময়নামতি নামে নতুন বিভাগ সৃষ্টির ফলে প্রাচীন বৌদ্ধ সভ্যতার নজির শালবন বিহারের ব্যাপক প্রচার হবে বিশ্ব পর্যটন অঙ্গনে। আর এখানে পর্যটনটা সমৃদ্ধ হলে লাভটা হবে কার?
বরং এই পর্যায়ে কেবল আলোচনাটা হতে পারে ময়নামতি বিভাগ হলে এর কেন্দ্র হবে কোথায় সে নিয়ে। অর্থাৎ, বিভাগ ময়নামতির অবকাঠামো গড়ে উঠবে কোনদিকটায় এ সিদ্ধান্তের জন্য আলোচনার টেবিল তৈরি হতে পারে। এক্ষেত্রে উত্তরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর থেকে থেকে শুরু করে দক্ষিণে নোয়াখালীর হাতিয়া পর্যন্ত চিন্তা করে একটা স্থান নির্ধারণ করে দিতে পারে ছয় জেলাবাসী। যেন কোনো কাজে ময়নামতি বিভাগের অফিসে এলে নাসিরনগরের মানুষটার মতোই প্রায় সমান সময় লাগে হাতিয়ার মানুষটার।
এ হিসাব কষলে নাম আসতে পারে লাকসাম, বরুড়া, শাহরাস্তি, চাটখিলের। বিশেষত সার্বিক যোগাযোগ সুবিধায় সবার পছন্দের নাম হতে পারে কুমিল্লা সদর থেকে ২৯ কিলোমিটার দক্ষিণে ডাকাতিয়া নদী তীরের লাকসাম। ১৯৮২ সালে থানা থেকে উপজেলায় উন্নীত হওয়া লাকসামের পৌরসভা দেশের প্রথম শ্রেণীর পৌরসভাগুলোর একটি। নিরিবিলি হলেও দেশের বৃহত্তম পাঁচটি রেলওয়ে জংশনের একটি ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এ পৌরসভাতেই। এই লাকসাম থেকে বিভাগের সর্ব-দক্ষিণের উপজেলা নোয়াখালীর হাতিয়ার দূরত্ব আঞ্চলিক সড়কপথে ১১৪ কিলোমিটার। আর সর্বোত্তরের উপজেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের দূরত্ব সড়কপথে ১৩৬ কিলোমিটার। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা ও সিলেটে রেল যোগাযোগের প্রাচীন রুট লাকসামের সঙ্গে পাশের চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর ও ফেনী জেলার যোগাযোগও আঞ্চলিক সড়কে বেশ ভালো বলে ওই অঞ্চলের মানুষই মনে করেন। অর্থাৎ, ময়নামতি বিভাগের সদরদফতর লাকসামে স্থাপন করে এখান থেকেই কার্যক্রম শুরু করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে আঞ্চলিক সড়কে যে যোগাযোগটা আছে সেটা আরও বেশি উন্নত হতে পারে সরকারি প্রয়োজনেই।
পাশাপাশি বিভাগীয় সদর দপ্তর স্থাপনকে কেন্দ্র করে এ এলাকার মৃতপ্রায় ডাকাতিয়া নদীকেও পুনরুজ্জীবন দেওয়ার সুযোগ থাকে। এতে মেঘনা হয়ে ঢাকা, খুলনা বা বরিশালসহ দেশের যে কোনো স্থান থেকে সহজেই আসা যাবে নতুন বিভাগের সদরদফতরে।
আর যদি প্রতিষ্ঠিত একটি নগরের বাইরে কেবল বিভাগ বাস্তবায়নের জন্য আরও একটি নগর গড়ে ওঠে সেটা কি সমতটবাসীর জন্যই লাভের নয়? এই লাভের হিসাবকে কি কেবল ‘আঞ্চলিক’ প্রভাব প্রদর্শনে ঠেলে দেওয়া যাবে?
ঠেলে দেওয়ার সে সুযোগ যে নেই তার ইঙ্গিত অবশ্য ছিল সরকারের ঘোষণার সময় পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামালের কণ্ঠেই, ‘এখন থেকে আর কোনো জেলার নামে বিভাগের নামকরণ করা হবে না। নতুন বিভাগের নাম ভিন্ন নামে হবে। হয়তো কোনো পরিচিত প্রাচীন ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিক স্থাপনার নামে হবে। সে হিসেবে এ বিভাগ নাম হবে ময়নামতির নামে। ’
কুমিল্লার ওই বিরোধিতাকারী অংশটি ‘ময়নামতি’ নিয়ে আপত্তি জানালেও অবশ্য এরইমধ্যে ময়নামতির পক্ষেই গড়ে উঠছে বিপুল জনমত। পৃথক পৃথক বিবৃতিতে ময়নামতি বিভাগের পক্ষে অবস্থান জানিয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী ও ফেনীর অনেক বিশিষ্টজন।
এদের মধ্যে রয়েছেন কবি জয়দুল হোসেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট আবু তাহের, কবি মানিক রতন শর্মা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া শিল্পী সংসদের সভাপতি আল আমীন শাহীন, সাধারণ সম্পাদক আনিছুল হক রিপন, সাংগঠনিক সম্পাদক ফারুক আহমেদ পারুল, কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক মোতালেব হোসেন, বরুড়া উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান মো. কামাল হোসেন প্রমুখ। ময়নামতি বিভাগ হচ্ছে বলে খবর প্রকাশের পর ইউসুফ আলী, আবদুল মালেক মুন্নার মতো বাংলানিউজের অনেক পাঠকও সরকারের এ সিদ্ধান্তকে উন্নয়নের নতুন দুয়ার খোলার ইঙ্গিত বলে সাধুবাদ জানিয়েছেন।
যারা ময়নামতি বিভাগের পক্ষে মত দিচ্ছেন, তারা উল্টো শাসিয়ে দিচ্ছেন, কেউ যদি কুমিল্লা নামে বিভাগ বাস্তবায়ন করতে চায়, তবে তারা পাল্টা ময়নামতি বিভাগ বা তিতাস বিভাগ বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলবেন। এরইমধ্যে চোখে পড়ছে নোয়াখালী বিভাগ বাস্তবায়ন আন্দোলনও।
প্রতিষ্ঠিত কুমিল্লা শহরে বিভাগের জন্য নতুনভাবে অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে ‘তেলে মাথায় তেল দেওয়া’র শামিল। এখন সমতটবাসী কি উন্নয়নের নতুন দুয়ার বন্ধ করে তেলে মাথায় তেল দিতে থাকবেন?
বাংলাদেশ সময়: ১৮১৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৭
এইচএ/জেডএম