ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

শক্তির ভারসাম্য খেলায় দৃষ্টি যখন বাংলাদেশে

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩১৯ ঘণ্টা, মার্চ ১৪, ২০১৭
শক্তির ভারসাম্য খেলায় দৃষ্টি যখন বাংলাদেশে স্বাধীনতার রক্তকথন

মার্চের প্রথম থেকেই পাকিস্তান সরকার তার কূটনৈতিক তৎপরতা দিয়ে বিশ্ববাসীকে বোঝাবার চেষ্টা করে যে, পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা পাকিস্তানের একটি অভ্যন্তরীণ ব্যাপার।

কিন্তু বাস্তবে তারা ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্নে কোনো কথা বলা থেকে সচেতনভাবেই বিরত রইল। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কেউ কেউ পাকিস্তানের জালে পা দিলেন ও তারা পাকিস্তানের সুরেই কথা বললেন।

তারা পাকিস্তানের সমস্যা রূপরেখা অনুধাবন করার চেষ্টা করলেন না।
 
প্রাথমিকভাবে ব্রিটিশ সরকার পাকিস্তানের পক্ষই অবলম্বন করলো। তাদের দেখাদেখি ফ্রান্সও পাকিস্তানের পক্ষ নেয়। সৌদি আরবও পাকিস্তানের পক্ষ নেয়। এছাড়া ইরান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও তুরস্কের মতো মুসলিম দেশগুলোও অবস্থার কোনোরকম বিচার-বিবেচনা না করেই পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করে।
 
আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর মধ্যে সেন্ট্রাল ট্রিটি অর্গানাইজেশন পাকিস্তান প্রশ্নে অন্য কাউকে নাক না গলানোর নির্দেশ দেয়।
 
মুসলিম রাষ্ট্র বা আরব দেশগুলো মধ্যে মিশরের ভূমিকা কিছুটা ভিন্ন। তারা পাকিস্তান প্রশ্নে কোনো মন্তব্য করলো না। ভারত বাংলাদেশকে প্রকাশ্য সামরিক সহায়তা দিতে অনেক বিলম্ব করে। তারা ডিসেম্বর পর্যন্ত এ জন্য অপেক্ষা করে। যদিও অন্যান্য সহায়তা অব্যাহত রাখে। সেই সঙ্গে বর্হিবিশ্বে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে ইন্দিরা গান্ধীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। এছাড়া বৃহৎ শক্তির মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতির কাছে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানায়।
 
১৯৭১ সালে ০২ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে পাঠানো সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোরনির চিঠিতে এ আহ্বান জানানো হয়। এই চিঠিতে পাকিস্তানের সামগ্রিক রাজনৈতিক অবস্থার বর্ণনা করা হয়। চিঠিতে নিকোলাই বলেন, ‘ইউএসএসআর এর সুপ্রিম সোভিয়েতের পক্ষ থেকে মি. প্রেসিডেন্ট, আপনার কাছে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করাটা আমরা আমাদের পবিত্র কর্তব্য বলে মনে করছি এবং সেই সাথে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে পরিচালিত দমন-পীড়ন ও রক্তপাত অবিলম্বে জরুরি ভিত্তিতে বন্ধ করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে বিদ্যমান সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সনির্বন্ধ আবেদন জানাচ্ছি। আমরা আশাবাদী, পাকিস্তানের সর্বস্তরের জনগণের স্বার্থ এবং এই অঞ্চলের শান্তি রক্ষার স্বার্থ সংরক্ষণে এই পদক্ষেপ কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। উদ্ভূত সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান হলে সোভিয়েত জনগণ স্বস্তি ও তৃপ্তি লাভ করবে’।
 
কিন্তু ইয়াহিয়া খান সোভিয়েত চিঠির জবাবে কড়া সমালোচনা করলেন। তিনি পশ্চিমা প্রভু ও সেনাবাহিনীর ভরসায় তাদের কথায় কোনো কর্ণপাত করলেন না। উপরন্তু তিনি সোভিয়েত চিঠির জবাবে ভারতের সমালোচনা করলেন। তিনি পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক বলে দাবি করলেন।  
 
চীন বাংলাদেশের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে এখানে একটি অখণ্ড পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখলো। ফলে চীনের সমর্থন আমরা পেলাম না। ইয়াহিয়া চৌ এন লাই এর কাছে একটি চিঠি লেখেন। ১৩ এপ্রিল সেই চিঠির জবাবে চৌ এন লাই ইয়াহিয়া খানকে আশ্বস্ত করেন এই বলে যে, ‘...একইসাথে আমরা লক্ষ্য করেছি যে, আপনার দেশের অভ্যন্তরীণ সংকটের সুযোগে ভারত সরকার পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ব্যাপকভাবে হস্তক্ষেপ করছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও একের পর একই কাজ করে যাচ্ছে। এ ধরনের অযৌক্তিক ও অন্যায় হস্তক্ষেপের খবর এবং আপনার দেওয়া পদগোরনির চিঠির উত্তর চীনা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হচ্ছে। চীন সরকার মনে করে, পাকিস্তানে যা কিছু ঘটছে, সেটা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা, যা কেবল পাকিস্তানের জনগণ নিজেরাই সমাধান করতে পারে। এখানে বিদেশি হস্তক্ষেপের কোনো অবকাশ নেই। আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন যে, সম্প্রসারণবাদী ভারত পাকিস্তানে আগ্রাসন চালালে বরাবরের মতো পাকিস্তানের সরকার ও জনগণকে তাদের রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও জাতির স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে চীনের সরকার ও জনগণ দৃঢ় সমর্থন প্রদান করবে’। এভাবে পাকিস্তানের প্রতি চীন সামরিক ও আর্থিক সহায়তা অব্যাহত রাখে।
 
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট প্রথম দিকে শান্তপূর্ণ সমাধানের পক্ষেই ছিল। পরবর্তি এই অঞ্চলে শক্তির ভারসাম্য রজায় রাখা ও পাকিস্তানপ্রীতির  জন্য নিক্সন তার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন বিতর্কিত ভূমিকায় অবতীর্ণ হন নিক্সন-কিসিঞ্জার। সে সময়ে মার্কিন ভূমিকার পক্ষে জোরালো ভূমিকা রাখেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার। শক্তির ভারসাম্য রক্ষায় বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রকাশ্যে পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি তারা সপ্তম নৌবহর পর্যন্ত পাঠিয়েছিল। পরে সোভিয়েত চাপে এ প্রক্রিয়া থেকে তারা বিরত হয়। যদিও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের বিপক্ষে মার্কিন ভূমিকার অন্যতম কারণ চীন। এসময়ে তারা চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের তোড়জোড় চালাচ্ছিল। আর এ কাজে পাকিস্তান মধ্যস্থতা করেছিল। এছাড়া অন্যান্য কারণ তো ছিলোই।
 
নিরাপত্তা পরিষদের অন্যতম সদস্য পোল্যান্ড একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন।  তারা তাৎক্ষণিকযুদ্ধ বিরতি ও সেনাবাহিনী পরস্পরের সীমান্তে ফিরিয়ে আনার জন্য মতামত ব্যক্ত করেন। তারা এ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের আহ্বান জানান।

বাংলাদেশ সময়: ০৯২০ ঘণ্টা, মার্চ ১৪, ২০১৭
এসএনএস

আগের পর্ব পড়ুন:
** স্বাধীনতার রক্ত-কথন
** ২৫ মার্চ অধিবেশন! অন্তরালে অপারেশন সার্চ লাইট
** ‘পাকিস্তান রক্ষা’র জন্য হানাদারদের ভুট্টোর আগাম অভিনন্দন

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।