ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

‘টাইগার নিয়াজী’ হয়ে গেলেন ‘বাংলার শৃগাল’

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭২৫ ঘণ্টা, মার্চ ১৮, ২০১৭
‘টাইগার নিয়াজী’ হয়ে গেলেন ‘বাংলার শৃগাল’ ‘টাইগার নিয়াজী’ হয়ে গেলেন ‘বাংলার শৃগাল’

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইন্টার্ন কমান্ডার ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী। তিনি দাবি করেন, তদানীন্তন ইয়াহিয়া খানের সরকার জুলফিকার আলী ভুট্টোর পরামর্শেই পরিকল্পিতভাবে ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান পরিত্যাগ করেছে। জেনারেল নিয়াজী তার ‘দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান’ বইয়ে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে পূর্ব পাকিস্তানে পরিচালিত গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের জন্য ইয়াহিয়া ও ভুট্টোকেই দায়ী করেন। 

পূর্ব পাকিস্তানে তিনি আট মাস দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনিই পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক কমান্ডার ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয় ও পাকিস্তানি সেনাদের পরাজয়ের গ্লানি তাকেই বরণ করতে হয়েছে। তারই নেতৃত্বে পাকিস্তানি বাহিনী মিত্র বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।  

পরাজয়ের গ্লানি কেউই বরণ করতে চায় না। তিনিও চাননি। সেজন্যই বুঝি ‘দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান’ বইয়ে মাথার ওপর থেকে অভিযোগ ঝেড়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর চাপাতে চাইলেন তিনি।

অথচ নিয়াজীর নেতৃত্বেই পাকিস্তানি হানাদাররা এখানে গণহত্যা চালায়। নিয়াজীর পরিচালিত গণহত্যা পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম বলে সমধিক পরিচিত। পাকিস্তানি বাহিনী এখানে শুধু সামরিক শক্তিই প্রয়োগ করেনি, তারা প্রথাগত যুদ্ধের সমস্ত রীতি-রেওয়াজও ভঙ্গ করেছে। তারা বেসামরিক লোকদের ওপর হামলা করেছে, অগ্নিসংযোগ করেছে, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে, নারী ধর্ষণ করেছে, শিশুদেরও নির্বিচারে হত্যা করেছে। লিপ্ত হয়েছে গণহত্যা ও আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থি সব কর্মকাণ্ডে।  

কিন্তু নিয়াজী বাহিনী এসব করেও নিজেদের শেষ রক্ষা করতে পারেনি। বাঙালির কাছে তাদের পরাজয় বরণ করতেই হলো। রণাঙ্গনে তার এ পরাজয়ের দায় নিয়াজী যেমন চাপিয়েছেন পাকিস্তান বাহিনীর সুপ্রিম কমান্ডার প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ওপর, তেমনি সমানভাবে দায়ী করেছেন ভুট্টোকেও। বাস্তবতা বলবে, পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত অপরাধের জন্য নিয়াজী কোনোভাবেই নিজেকে নির্দোষ দাবি করতে পারেন না। বরং তিনি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও গণহত্যার জন্য সরাসরি দায়ী। মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত সব অপরাধের সঙ্গে তিনি জড়িত। তার নেতৃত্বে তার আদেশ-কমান্ডেই যে হানাদার বাহিনী এখানে ঘৃণ্যতম তাণ্ডবলীলা চালিয়েছে।

তবে ভুট্টো ও ইয়াহিয়াকে জড়িয়ে নিয়াজী যে দাবি করেছেন তাও এড়িয়ে যাওয়া যায় না। কারণ, ইতিহাস সাক্ষী, পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত করতে এই দু’জন সবসময় প্রধান ভূমিকা রেখেছেন। ভুট্টোর পরামর্শে ইয়াহিয়া রাজনৈতিক সংকটকে আরও জটিল করে তুলেছেন। সেইসঙ্গে ইয়াহিয়া নিজে সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হওয়ায় সশস্ত্র বাহিনীর ওপর তার আস্থা ছিল বেশি। তিনি ভেবেছিলেন, শেখ মুজিবুর ভালোয় ভালোয় তাদের দাবি মেনে না নিলে সামরিক কায়দায় সব সমস্যার সমাধান করে ফেলবেন। সে লক্ষ্যেই তিনি একইসঙ্গে লোক দেখানো রাজনৈতিক সংলাপ করেন আর তলে তলে সামরিক স্থাপনা পরিদর্শন করতে থাকেন এবং উচ্চপদস্থ সামরিক কমকর্তাদের সঙ্গে এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতে থাকেন।

সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ ও পরিচালনার জন্য তৎকালীন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল হামিদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে জেনারেল হামিদ আদেশ দিতেন আর রণাঙ্গনে লে. জেনারেল নিয়াজী তা কার্যকর করতেন। কিন্তু ইয়াহিয়া খানও সেনাবাহিনীর অবসর প্রাপ্ত কর্মকর্তা। লে. জেনারেল নিয়াজী দাবি করেছেন, ইয়াহিয়া-ভুট্টো ও জেনারেল হামিদ রণাঙ্গনের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ-খবর না নিয়েই নির্বাহী আদেশ দিতেন। সে আদেশেই নিয়াজী তার অপারেশন পরিচালনা করেছেন।

কিন্তু নিয়াজী যতোই ‘উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে’ চাপান, রণাঙ্গনে তার বাহিনীর কর্মকাণ্ডের জন্য তিনি কোনোভাবে দায়মুক্ত নন এবং একইভাবে ভুট্টো-ইয়াহিয়াও দায়ী। তাদের যৌথ কর্মকাণ্ডের ফলেই পূর্ব পকিস্তানে গণহত্যা চলেছে এবং পরে তাদের পরাজয় নিশ্চিত হয়েছে।  

নিয়াজী দাবি করেছেন, ওই তিনজন (ইয়াহিয়া-ভুট্টো-জে. হামিদ) সঠিক পদক্ষেপ নিলে বাঙালিদের পরাজয় ছিল নিশ্চিত। যুদ্ধে তিনিই জয়ী হতেন। যদিও তার এ দাবি নয় মাসের যুদ্ধ পরিস্থিতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক-অতি কথনমাত্র বলেই প্রতীয়মান হয়।  

আমাদের চোখে, আসলে ওই বর্ববর গণহত্যার জন্য নিয়াজী-হামিদ-ভুট্টো-ইয়াহিয়া সবাই সমানভাবে দায়ী। এদের কেউ তাদের রাজনৈতিক ভূমিকার জন্য দায়ী, কেউ সামরিক ভূমিকার জন্য। এ কাতারে টিক্কা খান ও রাও ফরমান আলীও অগ্রগণ্য। ইতিহাস সাক্ষী, পৃথিবীর জঘন্যতম গণহত্যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই ছয় জনের নাম। বেলুচিস্তানের কসাই ও তথাকথিত টাইগার মিলে পূর্ব বাংলার নিরস্ত্র মানুষের ওপর চালিয়েছে কাপুরুষোচিত গণহত্যা।  

পূর্ব পাকিস্তানের কমান্ডার নিযুক্ত হওয়ার সময় নিয়াজী ছিলেন উর্ধ্বতন দ্বাদশ কর্মকর্তা। এতো জুনিয়র অফিসার হওয়া সত্ত্বেও তিনি সেনাবাহিনীর তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত হন। নিয়াজী দাবী করেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান পরিত্যাগে একটি সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্যই তাকে এ পদে নিযুক্ত করা হয়েছে। ’ 

বাস্তবতা বলছে, নিয়াজী তার সামরিক ব্যর্থতার দায় এড়াতেই এভাবে দায় চাপিয়েছেন ইয়াহিয়া-ভুট্টোর ওপর। আর ইয়াহিয়া-ভুট্টো তাদের রাজনৈতিক ব্যর্থতার দায় চাপিয়েছেন সামরিক কমান্ডার নিয়াজীর ওপর।  

পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের এ ধরনের দায় চাপানোর নজির নতুন কিছু নয়। এমনকি আজও তারা এ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। সে কারণেই পাকিস্তানে আজও রাজনৈতিক ও সামরিক কর্তৃপক্ষের মাঝে টানাপোড়েন লেগেই আছে।  

বাঙালি প্রথম থেকেই রাজনৈতিক সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান চেয়েছে। কিন্তু প্রথম থেকেই পাকিস্তানিরা রাজনৈতিক সমাধানের পথ থেকে সরে আসে। তারা সমস্যা সমাধানের জন্য প্রথমেই সামরিক পথে পা বাড়ায়। ফলে সমাধানের পথ আরও কঠিন হয়ে যায়। বাঙালিও অস্ত্র হাতে নিতে বাধ্য হয়। বহির্বিশ্বেও পাকিস্তানি বাহিনীর চালানো ‘গণহত্যা’ নিন্দিত হয়। একইসঙ্গে বিশ্বের এ অংশে পরাশক্তিগুলো তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে নিজ নিজ ভূমিকায় এগিয়ে যায়। ভারত, রাশিয়া, আমেরিকা ও চীন নিজ নিজ স্বার্থ বলয়ের মধ্যে বাংলাদেশের সমস্যাটিকে পর্যালোচনা করতে থাকে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ প্রশ্নে পরাশক্তিগুলোর মাঝে এক ধরনের উত্তেজনা পরিদৃশ্যও হয়। যা অবশ্য শেষ তক আর পরিণত হতে পারেনি।  

পাকিস্তানি নেতৃত্ব পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক অভিযান অব্যাহত রাখার আদেশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। ফলে নিয়াজী এ অংশে তার গণহত্যার তালিকা আরও দীর্ঘ করতে থাকে। একের পর এক অপরাধে জড়িত হয়ে যায় পাকিস্তানী বাহিনী। নিয়াজী দাবি করেন, তিনি জেনারেল হামিদের আদেশে এখানে যুদ্ধ চালিয়ে যান। তিনি ভেবেছিলেন যে, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব রাজনৈতিক সমাধানের পথে এগোচ্ছে। কিন্তু সময় গড়িয়ে যাচ্ছে, তারপরও তারা রাজনৈতিক সমাধানের জন্য কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় নিয়াজী হতাশ হন।

নিয়াজী দাবি করেন, তিনি সমস্যা সমাধানের জন্য ইয়াহিয়া খানের কাছে একটি জরুরি বার্তা পাঠিয়ে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের বিজয়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাগার থেকে মুক্তি দিতে আকুল আবেদন করেন। কিন্তু ইয়াহিয়া খান তার আবেদনে সাড়া দেননি।  

আসলে ইয়াহিয়া কারও কথাই রাখেননি, কারও কথাই শোনেনি সেসময়। শুনলেন শুধু সেসময়কার বিরোধী দলের প্রধান ভুট্টো সাহেবের কথা। পশ্চিম পাকিস্তান শাসকচক্র প্রথম থেকেই ছিল একটি সামরিক-নির্ভর কর্তৃপক্ষ। ফলে ইয়াহিয়া-ভুট্টো সামরিক কায়দায়ই সমস্যার সমাধান চেয়েছিলেন। তাদের সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে কাজে লাগিয়েছেন সামরিক বাহিনীকে। জেনারেল হামিদ ও নিয়াজী সেই পরিকল্পনার অংশীদার।

এই নিয়াজী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সময় বার্মা সেক্টরে ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে জাপানিদের বিরুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে ‘টাইগার উপাধি’ লাভ করেছিলেন। তার খেতাব অনুসারে তাকে নাকি ‘টাইগার নিয়াজী’ বলা হতো। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধেও নাকি নিয়াজী একরকম সাফল্যই দেখিয়েছেন। কিন্তু বাঙালি মুক্তিসেনাদের কাছে এসেই ধরা খেলেন তথাকথিত ‘টাইগার নিয়াজী’। বাঙালির কাছে নিয়াজী শুধুই একজন গণহত্যাকারী কাপুরুষ। আর পাকিস্তানিরা বাঙালির কাছে তার ব্যর্থতার জন্য তাকে খেতাব দিয়েছে ‘বাংলার শৃগাল’।  ইতিহাসের শিক্ষাতো এই যে, ব্যর্থ বাঘ শেয়ালের চেয়েও অধম।

বাংলাদেশ সময়: ১৩১৫ ঘণ্টা, মার্চ ১৮, ২০১৭
এইচএ/

আরও পড়ুন

** ইয়াহিয়াকে নিকোলাইয়ের হুমকি, সমর্থন চৌ এনলাইয়ের
** ভারতীয় সংসদে বাংলাদেশ নিয়ে উদ্বেগ​
** স্বাধীনতার রক্ত-কথন
** ২৫ মার্চ অধিবেশন! অন্তরালে অপারেশন সার্চ লাইট
** ‘পাকিস্তান রক্ষা’র জন্য হানাদারদের ভুট্টোর আগাম অভিনন্দন
** শক্তির ভারসাম্য খেলায় দৃষ্টি যখন বাংলাদেশে
** স্বাধীনতার পথের বন্ধুরা

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।