২৩ বছরের পাকিস্তানি শাসন থেকে এই দেশকে মুক্ত করতে অনেক রক্ত ঝরেছে। অনেক আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছে এক একটি স্মরণীয় মূহুর্ত।
৫৬ ভাগ বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ হবার পরও বাঙালির ওপর ষড়যন্ত্র করে পাকিস্তানিরা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উদু চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিল । বাঙালি গর্জে ওঠে এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে। নিরস্ত্র বাঙালির ওপর অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাক সেনারা, ঝরেছিল রক্ত । সেই রক্তে ভেজা মাটি কঠিন থেকে কঠিনতর হয়েছিল। ইতিহাস রচিত হয়েছিল ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে। ৫৮-তে সামরিক শাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে লড়াকু উচ্চারণে। ৬২’র হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে শিক্ষা-আন্দোলন। তা থেকে ৬৪’র নির্বাচন। ৬৫’তে পাক-ভারত যুদ্ধ। এরপর ৬৬’র ‘৬ দফা’ বাঙালির জীবনের ‘জীয়ন কাঠি’। এই আত্ম-উপলব্ধির সময়ে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হয়ে প্রকাশিত হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ৬ দফা ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাঙালি খুঁজে পেল তার ঠিকানা। ‘পূর্ব বাংলা শ্মশান কেন’, ‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনা / তোমার আমার ঠিকানা’ এবং কালজয়ী স্লোগান ‘জয়বাংলা’র মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি পেল তার আত্মপরিচয়ের স্বীকৃতি, সেই সাথে অবিসম্বাদিত নেতার নেতৃত্বে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল সেইসব মুহূর্ত।
৬৯’র সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন আইয়ুব খানের পতন ঘটিয়ে ৭০’র নির্বাচনের পথ তৈরি করলো। সেই নির্বাচন প্রমাণ করলো বাঙালি জাতি তার আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার চায়। তার জন্য স্বাধীনতার প্রয়োজন, স্বাধীনতাই শেষ কথা। নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা জাতির সুদৃঢ় এক লৌহকঠিন ঐক্য তৈরি করেছিল নিজেদের মধ্যে। একদিকে পাকিস্তানি ষড়যন্ত্র, অন্যদিকে বাঙালির স্বাধীনতার প্রশ্ন।
১৯৭১ সালের ১ মার্চ-এ হঠাৎ করে ইয়াহিয়া খানের ঘোষণায় ৩ মার্চ জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত করা হলো। সেদিন আপামর জনতা বিদ্রোহ-ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। জনতার ¯্রােত উত্তাল জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছিল। একের পর এক ইতিহাস লেখা হতে থাকলো দিনের পর দিন, প্রতিদিন। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সমাবেশে পতাকা উত্তোলন, যা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা হিসেবে স্বীকৃতি পেল। ৩ মার্চ ঘোষণা হলো পল্টন ময়দানে স্বাধীনতার ইশতেহার, জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’। এরপর বহুপ্রতীক্ষিত ৭ মার্চ। ইতিহাসের এক বিস্ময়কর ঘটনা, অমর এক কবিতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। বাঙালি জাতি পথ খুঁজে পেয়েছিল সেই দিন, সকল নির্দেশনা ছিল সেই ভাষণে। তারই ওপর ভিত্তি করে প্রস্তুতি চলছিল সমগ্র বাংলাদেশে। একদিকে অসহযোগ আন্দোলন, অন্যদিকে যুদ্ধের প্রস্তুতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা বাংলাদেশে। অস্ত্র হাতে প্রশিক্ষণ, ছাত্রদের কুচকাওয়াজ এবং মুক্তিযুদ্ধের আনুষঙ্গিক প্রস্তুতির বিভিন্ন কার্যক্রম।
এলো সেই ভয়াল কালরাত্রি ২৫ শে মার্চ। সকাল থেকে গুমোটভাব, এরপর সন্ধ্যা থেকে প্রতিরোধের প্রস্তুতি। সেই দুঃসময়টুকু স্মরণ করলে ভয়ানক মুহুর্তগুলোই বারবার স্মৃতিতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে: আগুন জ্বলছে পলাশীর রেললাইনের ধারে বস্তিতে, বিদ্রোহ ইপিআর ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনে, রিক্শার উপর গুলি খেয়ে পড়ে আছে রক্তাক্ত লাশ, দাউদাউ করে জ্বলছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা। ২৫ শে মার্চে রাতের শেষ প্রহরে মুহুর্মুহ কামানের গর্জন, শব্দের তাণ্ডব। মনে হচ্ছিল দালান-কোঠা সব গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টির মতো চলছিল গোলাগুলি, আগুনের ফুলকি ছড়াচ্ছিল চতুর্দিকে। সেই কালো রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কাপুরুষের মত পাশবিক হিংস্রতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘুমন্ত বাঙালির উপর। সামরিক শাসক ইয়াহিয়ার নির্দেশে, জেনারেল টিক্কা খানের নেতৃত্বে “অপারেশন সার্চলাইট” নামের সামরিক অভিযানে সংগঠিত হয় ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা। তাই অন্য যে কোনো দিনের চেয়ে এই দিনটি শুধু আমাদের কাছেই নয়, বিশ্বের গণহত্যার ইতিহাসেরও এক উদাহরণযোগ্য কলংকিত দিন। ঐ দিন পাকিস্তানিরা আমাদের শুধু হত্যাই করতে চায়নি, আমাদের বাঙালি জাতিসত্তাকে ধংস করার ষড়যন্ত্র নিয়ে তারা অপারেশনে নেমেছিল। জাতিসংঘের ঘোষণায় ‘জেনোসাইড’ বা গণহত্যার যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বাস্তবায়ন হয়েছে সেদিন বাঙালির ওপর। ২৬ মার্চ এর প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা হয়েছিল। এই সাংবিধানিক ঘোষণা জানালেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি প্রতি ইঞ্চি জমি পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত করার আহ্বান জানালেন। এর মধ্য দিয়েই ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ন্যায্যতা প্রকাশিত।
সময়ের ব্যবধানে অনেক কিছুই বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায়। সেই সুযোগে ষড়যন্ত্রকারী পরাজিত শক্তি ইতিহাস বিকৃতির চক্রান্ত করে। কিন্তু ইতিহাস অন্য কথা বলে। সেই দিন ২৬ মার্চ সকালে ঢাকা থেকে বের করে দেয়া হয় সকল বিদেশি সাংবাদিককে। যাতে করে কেউ গণহত্যার কোনো সংবাদ পরিবেশন করতে না পারে।
২৫ শে মার্চ রাতে রাজারবাগ পুলিশলাইন, পিলখানার তৎকালীন ইপিআর ক্যাম্প, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, রোকেয়া হল ও জহুরুল হক হলসহ সারা ঢাকা শহরে তারা ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। এক রাতের মধ্যেই তারা ঢাকা শহরকে মৃত্যুপুরী বানিয়ে ফেলে। আর্চার ব্লাডের লেখা “দ্য ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ” থেকে জানা যায়, সে রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে আগুন ধরানো হয়েছিল এবং ছাত্রীরা হল থেকে দৌড়ে বের হবার সময় মেশিন গান দিয়ে গুলি করে তাদেরকে হত্যা করা হয়েছিল। ২৬ মার্চ সকালের দিকে সেনাবাহিনীর কন্ট্রোল রুম ও ৮৮ ইউনিটের মধ্যে যে কথপোকথন হয় তার রেকর্ড থেকে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেই অগণিত ছাত্র-ছাত্রী নিহত হয়েছিল। এছাড়াও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. নূরুল্লার ধারণকৃত ভিডিওটি ওয়েবসাইটে আজও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশবিকতার সাক্ষী হয়ে আছে।
ভিডিওচিত্রে দেখা যায় ছাত্রদের দিয়েই জগন্নাথ হলের মাঠে গর্ত খোঁড়া হচ্ছে আবার সেই গর্তেই ছাত্রদের লাশ মাটিচাপা দেয়া হচ্ছে। অনেক ঘরবাড়ি ও পত্রিকাঅফিস, প্রেসক্লাবে আগুন ধরিয়ে কামান ও মর্টার হামলা চালিয়ে সেগুলো বিধ্বস্ত করা হয়। অগ্নিসংযোগ করা হয় শাঁখারিপট্টি ও তাঁতিবাজারের অসংখ্য ঘর-বাড়িতে। ঢাকার অলিগলিতে বহু বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। হত্যাকাণ্ড শুরুর প্রথম তিন দিনে ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোর, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া ও অন্যান্য শহরে লক্ষ লক্ষ নরনারী ও শিশু প্রাণ হারায়। ঢাকার প্রায় ১০ লাখ ভয়ার্ত মানুষ গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেয়।
২৫ মার্চের গণহত্যা শুধু এক রাতের হত্যাকাণ্ডই ছিল না, এটা ছিল মূলত বিশ্বসভ্যতার জন্য এক কলংকজনক, জঘন্যতম গণহত্যার সূচনামাত্র। পরবর্তী ৯ মাসে ৩০ লক্ষ নিরাপরাধ নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা সৃষ্টি করেছিল সেই বর্বর ইতিহাস, নিষ্ঠুরতা ও সংখ্যার দিক দিয়ে (ইহুদি হলোকাস্ট ১৯৩৩-৪৫) বা রুয়ান্ডার গণহত্যা (১৯৪৪) কেও অতিক্রম করে গেছে।
সারা পৃথিবীর বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা সেদিন নিশ্চুপ ছিলো না। বিভিন্নভাবে ঘুরে ফিরে সংবাদ পৌঁছে যাচ্ছিল দেশে দেশে। যেমন করে আমেরিকার সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করেন ১৯৭১ সালে। তিনি পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে সরাসরি গণহত্যা চালাবার অভিযোগ করেন। ‘গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’-এ বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞকে বিশ শতকের পাঁচটি ভয়ঙ্কর গণহত্যারেএকটি বলে উল্লেখ করা হয়। ২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নিরাপত্তা বিষয়ক আর্কাইভ’ তাদের গোপন দলিল অবমুক্ত করে। এতে বাংলাদেশের নারকীয় হত্যাযজ্ঞকে Selective Genocide বা Genocide হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
এই মুক্তিযুদ্ধে অনেক সাংবাদিকের প্রত্যক্ষ বিবৃতি, ভাষ্য, সাক্ষাৎকার বিভিন্ন সময়ে প্রচারিত হয়েছে, যা থেকে কি নির্মম ছিল এই গণহত্যা তার প্রমাণ উঠে এসেছিল। সারা বিশ্বের মানুষ থমকে দাঁড়িয়েছে। বিবেকের তাড়নায় পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় গণহত্যার বিরুদ্ধে জাগরণ তৈরি হয়েছিল। সেখানে বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল পৃথিবীর বিবেকবান মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের এরকম একজন প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক ড্যান কগিন টাইম ম্যাগাজিন এ তার এক লেখায় এক পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের উদ্ধৃতি প্রচার করেন “We can kill anyone for anything. We are accountable to no one.” বিশ্বখ্যাত এই পত্রিকাটির একটি সম্পাদকীয় মন্তব্য ছিল: “It is the most incredible, calculated thing since the days of the Nazis in Poland.”
শুধু দেশীয় নয়, আন্তর্জাতিক মহলের মতেও ১৯৭১ সালে ‘তিন মিলিয়ন’ বা ত্রিশ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে। এই সংখ্যার সমর্থন আছে “National Geographic magazine, Encyclopedia Americana, and Compton’s Encyclopedia” তে। এই গণহত্যা সম্পর্কে অন্যতম প্রধান পাকিস্তানী জেনারেল রাও ফরমান আলী তার ডায়েরিতে লেখেন, তিনি বাংলার সবুজ মাঠকে রক্তবর্ণ করে দেবেন “Paint the green of East Pakistan red”. ১৩ জুন ১৯৭১ সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহ্যাস তার রিপোর্টের মাধ্যমে সারা বিশ্বের মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিলেন। বিভিন্ন জায়গায় তার লেখা প্রকাশিত হচ্ছিল। ঢাকা বা তার আশেপাশে বিভিন্ন স্থান এবং কুমিল্লাসহ যে সকল জায়গায় পাকিস্তানি সেনারা অবস্থান করছিল, সে সকল স্থানে বিভিন্ন জনের সাথে কথা বলে তিনি একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন। যা ‘সানডে টাইমস’ পত্রিকায় প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান হিসাবে প্রকাশিত হয়: "We are determined to cleanse East Pakistan, once for all, of the threat of secession, even if it means the killing of two million people and making the province as a colony for 30 years’, I was repeatedly told by senior military and civil officers in Dhaka and Comilla".
তার এই বয়ান প্রকাশিত হবার পর তা বিশ্ব বিবেককে জাগ্রত করে। পৃথিবীর মানুষ প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। জেগে ওঠে সভ্যতা। জাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল যুব সমাজের মাঝে। বাংলাদেশের সাথে সংহতি জ্ঞাপন করে দেশে দেশে হয় নানা অনুষ্ঠান, নানা আয়োজন, গান, নাটক, ফুটবল খেলাসহ নানারকম উদ্যোগে ঘোষিত হয় সমর্থন ও সহযোগিতা। ১৯৭১ এর ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বিশ্ব ইতিহাসে এক যন্ত্রণাময় নারকীয় হত্যাকাণ্ডের প্রমাণ হয়ে দেখা দিয়েছিল। এত দ্রুত এত বেশি মানুষকে হত্যা করার নজির ইতিহাসে খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। শুধু খুলনার চুকনগরেই ১৯৭১ সালের ২০ মে প্রায় ১০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল।
আজ এত বছর পর হলেও আমরা উদ্যোগ নিয়েছিলাম এই হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে,বর্বরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার লক্ষ্যে একটি দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেবার। ২৩ বছরের পাকিস্তানি শাসন-শোষণের মধ্য দিয়ে যখন বাঙালি জাতিকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি, তখন তাদের ষড়যন্ত্র আরো প্রকট হয়ে ওঠে। ওরা ৬৯ এর গণঅভ্যূত্থানে হেরেছে, ৭০‘ এর নির্বাচনে হেরেছে। ৭১‘ এর মার্চে বঙ্গবন্ধুর ডাকে যে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তাতেই তারা দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে পড়ে। সে সময় নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে গণহত্যার। বাঙালি জাতিকে নির্মমভাবে ধ্বংস করার পাঁয়তারার মধ্য দিয়ে ভেবেছিল পাকিস্তানকে রক্ষা করতে পারবে। এরই ফল ২৫শে মার্চের এই নৃশংস গণহত্যা। নিরস্ত্র জনগণের গণঅভ্যূত্থান সশস্ত্র গণঅভ্যূত্থানে পরিচালিত হবার সূচনাক্ষণও ছিল এই ২৫শে মার্চ। সেই সময়ের একটি বিশ্বাসঘাতক অংশ সেদিন পাকিস্তানের পক্ষে কার্যক্রম পরিচালনা করে। তাদের উত্তরসূরীরা আজও সেই ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে। তাদের ভাষায় হানাদার বাহিনি বাঙালির উপর আক্রমণ চালিয়েছিল। তারা ‘পাকিস্তানি হানাদার বাহিনি’ বলতে নারাজ। তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে দুঃখ প্রকাশ করে,আর তাদের দোসর পাকিস্তানিরা নিন্দা জানায়। বাঙালির শত্রুরা ইতিহাসকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে বারবার চেষ্টা করে। পেয়ারে পাকিস্তানের গুণগ্রাহীরা এখনো সদা তৎপর বাংলাদেশে। জাতির ইতিহাস পাল্টে ফেলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা তাদের নেই। সঠিক ইতিহাস পাল্টে ফেলার অনেক ইতিহাস রয়েছে পাকিস্তানের খাতায়। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে তাই এখনো চলছে নানা ষড়যন্ত্র।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বাংলার ইতিহাসে ঘটেছিল আরেক কালো অধ্যায়। সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে ষড়যন্ত্রকারীরা ভেবেছিল বাঙালির অস্তিত্ব সমূলে বিনাশ করা যাবে। পাকিস্তানি ধারায় বাংলাদেশকে শাসন করা যাবে। ২১ বছর সেই ষড়যন্ত্রই চলেছে। বাংলার মাটিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনি তার দোসর জামায়াতে ইসলামী ও তার ছাত্র সংগঠনসহ রাজাকার-আলবদর-আলশামস্ বিভিন্নভাবে বাংলার মাটিতে রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়েছিল। পাকিস্তানিদের সাথে ব্যাপক গণধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, সীমাহীন লুটপাটে যুক্ত হয়েছিল তারা। এই অপরাধের জন্য ১৯৭২ সালেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রায় সাড়ে ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধীকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। ১৫ই আগস্টের পর তাদেরকেই মুক্ত করে দেয়া হয়েছিল জিয়াউর রহমানের নির্দেশে। রাজাকারদের প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে পরবর্তী সময়ে খালেদা জিয়া যুদ্ধাপরাধীদের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেন এবং গণহত্যায় শিকার ত্রিশ লক্ষ শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলে অবমাননাকর, ন্যক্কারজনক ইতিহাসের জন্ম দেন। ইতিহাসের এই দায় থেকে জাতিকে মুক্ত করা, ইতিহাসকে শুদ্ধ করার প্রয়োজনেই শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়ের সংগ্রাম।
সেই সংগ্রামের পথ ধরেই আজকের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ১৫ই আগস্টের নারকীয় হত্যাকাণ্ডের বিচার করেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছেন, ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে নতুন প্রজন্মের জন্য ইতিহাস ঢেলে সাজাচ্ছেন। সংবিধানের চার মূলনীতি প্রতিস্থাপন করেছেন। ত্রিশ লক্ষ মানুষকে হত্যা এবং দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি যারা করেছে, তাদেরকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। তাই আজকে জাতির সময় এসেছে এই গণহত্যার সকল ঘটনার বিবরণীর সাথে আগামী প্রজন্মকে যুক্ত করা। তারই ন্যায্যতার প্রয়োজন আজ। প্রয়োজন ২৫শে মার্চ কালরাত্রির সেই ভয়াবহ নৃশংসতা এবং একই সঙ্গে লাগাতার ৯ মাসের হত্যাযজ্ঞের বিবরণ জনসমক্ষে নিয়ে আসা। প্রয়োজন এই হত্যাযজ্ঞকে স্মরণ করে একটি দিবস পালন করা। একই সাথে জাতীয়ভাবে দিনটি নির্ধারণ করে সকল আন্তর্জাতিক মহলের স্বীকৃতি আদায়। একই সাথে আজকে প্রয়োজন হয়ে পড়েছে ১৯৭১ সালের ১৯৫ জন পাকিস্তানি সৈন্যের বিচারের লক্ষ্যে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক জনমত গঠন। প্রয়োজন হয়ে পড়েছে বাংলাদেশে সংগঠিত গণহত্যা, সম্পদ ধ্বংস ও লুণ্ঠনসহ নারী নির্যাতনের জন্য যে ক্ষতি সাধিত হয়েছে সেই ক্ষতিপূরণ আদায়ের ব্যবস্থা গ্রহণ। পাকিস্তানের কাছে পাওনা সকল অর্থ-সম্পদের হিস্যা আদায় করাও আজকে একটি কর্তব্য। যুদ্ধাপরাধীদের মানবতাবিরোধী অপরাধে যাদের বিচার হয়েছে, যাদের বিচার সম্পন্ন হয়েছে তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা। এই সকল কাজ সম্পন্ন করার প্রয়োজনেও জরুরি একটি দিবস পালন।
বিভিন্ন সংগঠন জনাব শাহজাহান খানের নেতৃত্বে শ্রমিক কর্মচারী মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় পরিষদ, আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ গণবিচার আন্দোলন, জনাব শাহরিয়ার কবিরের নেতৃত্বে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, ছাত্র-যুব-নারী সকলের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত ১১ই মার্চ জাতীয় সংসদের মাননীয় স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে ১০ম জাতীয় সংসদের ১৩তম অধিবেশনে ‘১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ কালরাত্রিতে বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক সংগঠিত গণহত্যাকে স্মরণ করে ২৫ শে মার্চকে গণহত্যা দিবস ঘোষণা করা হোক এবং আন্তর্জাতিকভাবে এ দিবসের স্বীকৃতি আদায়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা হোক’ মর্মে প্রস্তাবটি সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির ১৪৭ ধারায় সংসদ সদস্য হিসেবে আমি উত্থাপন করি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এসে গণহত্যা সংক্রান্ত বিশেষ ভিডিওচিত্র ও স্থিরচিত্র প্রদর্শন করেন এবং বিরোধী দলীয় নেতাসহ ৫৬ জন সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী এই প্রস্তাবের সমর্থনে ৭ ঘন্টাব্যাপী আলোচনায় অংশ নেন। সর্বসম্মতিক্রমে ২৫ শে মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ হিসাবে পালনের প্রস্তাবটি পাস হয়।
শুধু বাংলাদেশের জন্যই নয়, আজকের সুসভ্য বিশ্বসমাজ ও বিশ্বমানবতার অগ্রযাত্রার স্বার্থেও অন্তত একটি দিন গণহত্যার মত পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য নির্ধারিত থাকা প্রয়োজন। প্রয়োজন এই কারণেও যে, আমরা চাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এক অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শোষণমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে। এই দিবসকে ঘিরে গণহত্যাকারীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা জাগ্রত করা এবং সাংস্কৃতিক-সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলাই হবে আমাদের কাজ। যাতে আর কখনই এইরকম গণহত্যার ঘটনা না ঘটে। তাহলেই ২৫ শে মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ পালনের সিদ্ধান্তটি শুধু বাংলাদেশের সাথে সাথে বিশ্ব-ইতিহাসেও একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।
লেখক
শিরীন আখতার, সংসদ সদস্য-ফেনী ১
(১১ র্মাচ ২০১৭ জাতীয় সংসদে গণহত্যা দিবস প্রস্তাব উত্থাপক)
বাংলাদেশ সময়: ২২০৩ ঘণ্টা, মার্চ ২৩, ২০১৭
জেএম/