ডা. আবু তাহের মীর ফুলপুরের আলোকদি গ্রামের মজির উদিদন মীরের ঘর আলোকিত করে ১৯২৬ সালের ৫ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট।
এরপর তিনি জনমানুষের সেবার ব্রত নিয়ে ভর্তি হন পল্লী চিকিৎসক কোর্সে (এলএমএএফ)। সেখান থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করে বেশ কিছুদিন তৎকালীন স্বনামধন্য চিকিৎসক ডা. লিয়াকত হোসেনের অধীনে প্র্যাকটিস করেন। সেখান থেকে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা নিয়ে ডা. আবু তাহের ফুলপুর ছনাকান্দা বাজারে তাহের মেডিকেল হল নামে একটি ডিসপেন্সারি খোলেন। অনেক চড়াই-উতরাই শেষে এটি এলাকার একটি স্বনামধন্য চিকিৎসা কেন্দ্রে পরিণত হয়।
দেশ স্বাধীনের আগে তাহের হয়ে উঠেছিলেন এলাকার একজন নির্ভরযোগ্য ও দক্ষ চিকিৎসক। স্থানীয়দের রোগ-শোকের একমাত্র ভরসাস্থল হয়ে ওঠেন তিনি। চিকিৎসার পাশাপাশি এলাকায় একজন সমাজসেবী হিসেবেও পরিচিত হয়ে ওঠেন। তিনি ছিলেন সমাজের নিবেদিত প্রাণ। রাত নেই, দিন নেই যখনই কোনো মানুষের অসুখের কথা শুনেছেন তখনই ছুটে গেছেন ফুলপুর ও এর আশপাশের প্রত্যন্ত এলাকায়।
মানুষকে তিনি অকপটে ভালোবাসতেন, তিনি দারিদ্র্যের শিকার মানুষের ডাকে ঘুরে বেড়িয়েছেন ফুলপুরের আনাচে-কানাচে। সেদিন তাহের মেডিকেল হল গড়ে উঠেছিলো নিপীড়িত মানুষের আশ্রয়স্থল হিসেবে।
ডা. আবু তাহের শুধু একজন চিকিৎসকই ছিলেন না, ছিলেন দক্ষ ও একনিষ্ঠ রাজনীতিকও। তিনি ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশ্বস্ত ও দক্ষ কর্মী। ফলে মহান মুক্তিযুদ্ধের আগে ফুলপুর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।
ডা. আবু তাহের ছিলেন অসহায় মানুষের ঘনিষ্ঠবন্ধু। দীর্ঘ নয় মাস ফুলপুরের দিওগ্রামের অনেক অসহায় হিন্দু পরিবারের পাশে দাঁড়ান তিনি। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়া থেকে শুরু করে তাদের দেখভাল করতেন ডা.আবু তাহের।
তিনি ছিলেন একজন শিক্ষানুরাগীও। ফুলপুর গার্লস হাইস্কুলের দাতা সদস্য ও ফুলপুর ডিগ্রি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা। ফুলপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও এর পরিচালনা পর্ষদ ম্যানেজিং কমিটিরও সদস্য ছিলেন।
এরপরই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। বাঙালি যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে শত্রুর বিরুদ্ধে। তখন ডা. আবু তাহের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে কাজ শুরু করেন। পাকিস্তানি হায়েনা বাহিনীর ফুলপুর দখলের আগের দিনগুলোতে তিনি অস্ত্র হাতে সহযোগীদের সঙ্গে অতন্দ্র প্রহরীর মতো পাহারা দেন।
সেই সময় হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে অসহায় মানুষকে আশ্রয় দিয়েছিলেন তিনি। লুটপাটের হাত থেকে রক্ষার পাশাপাশি রক্ষা করেছিলেন অনেক মা-বোনের সম্ভ্রম।
ডা. আবু তাহের সেদিন বঙ্গবন্ধুর একজন দক্ষ সেনানায়ক হিসেবে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। পাকিস্তানি বাহিনী ফুলপুর দখলের পর তিনি বেশ কিছুদিন আত্মগোপনে ছিলেন। এপ্রিলের কোনো একসময় তিনি সপরিবারে ফুলপুর ছনাকান্দা বাজারের বাসায় উঠেন।
এ বাসা থেকে তিনি মাঝে মধ্যে উধাও হয়ে যেতেন। কোথায় যেতেন তা খুঁজে পাওয়া যেতো না। জানাতেনও না কাউকে। পরবর্তীতে জানা গেলো তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন সেসময়গুলোতে। যুদ্ধ চলাকালে তিনি পাকিস্তানিদের হাতে পড়েন। বেশকিছুদিন কারাগারেও থাকতে হয় তাকে।
জেলে থাকা অবস্থায় তাকে অবর্ণনীয় নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনে তার ছয়টি দাঁত ভেঙে যায়। সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে তাকে মুমূর্ষু অবস্থায় ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর কিছুদিন চিকিৎসা দেওয়া হয়। এতে কিছুটা সুস্থ হন তিনি।
তাই তখন বাসায়ই ছিলেন ডা. আবু তাহের। নভেম্বরের লগ্ন, চারদিকে পরাহত হচ্ছে পাকিস্তানি বাহিনী। ১৫ নভেম্বর বাড়িতেই ছিলেন তিনি। আর ওইদিন রাজাকারদের সহায়তায় তার বাড়িতে আক্রমণ চালায় পাকিস্তানি হানাদাররা।
সেদিন রাতে প্রথমে বাসার দরজা ভেঙে ঘরে ঢোকার চেষ্টা করে হানাদাররা। ব্যর্থ হয়ে পেছনের দরজা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে দাঁড়ানো অবস্থায় আবু তাহেরকে গুলি করে হত্যা করে। এতে তার মাথা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি।
এভাবেই একজন বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযোদ্ধার জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। ডা. আবু তাহেরের মৃত্যুর পর তার ছোট-ছোট সন্তানদের নিয়ে অকূল পাথারে পড়েন বিধবা স্ত্রী মুর্শেদা বেগম। যিনি আজও স্বামীর স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান।
তবে তার আক্ষেপ দেশের জন্যে যে স্বামীকে হারাতে হলো সেই দেশে স্বীকৃতি মেলেনি। মৃত্যুর আগে স্বীকৃত ও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় স্বামীর নামটি দেখে যেতে চান তিনি।
বললেন, আমার স্বামী দেশকে ভালোবেসেছেন। আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় কাজ করেছেন। এজন্য রাজাকাররা তাকে চোখের সামনে গুলি করে হত্যা করে।
‘অথচ আজ পর্যন্ত তার দলের কোনো নেতা, সংগঠন বা সরকার আমার ছেলে-মেয়ে কিংবা আমার কোনো খোঁজ নেয়নি। ’
লেখক
মো. আবদুস সাত্তার
সহকারী প্রধান শিক্ষক, এসএনপি উচ্চ বিদ্যালয়, নবীগঞ্জ, হবিগঞ্জ।
বাংলাদেশ সময়: ১২১৫ ঘণ্টা, মার্চ ২৭, ২০১৭
এইচএ/