তার পরামর্শে ঐক্যবদ্ধ হয় ইউরোপের বড় বড় জাতি। রেনেঁসাস ও রিফর্মেশনের ভিত্তিতে আলোকায়নের সময় রাজনৈতিক আধুনিকায়নের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি।
তিনি নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি (১৪৬৯-১৫২৭)।
আধুনিক রাজনীতিতে ক‚ট-কৌশল, শক্তি-সাহস-নির্মমতা দিয়ে বিজয়ী হওয়ার মন্ত্র দিয়েছিলেন তিনি। যাতে নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য নৈতিক-অনৈতিক সব কিছু করার পরামর্শও ছিল শাসকদের প্রতি। দ্বিচারিতা ও আত্মস্বার্থে ভরা তার নীতিকে বলা হয় ‘ম্যাকিয়াভিলিবাদ’। যে মতবাদ প্রকাশিত হয়েছে তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দ্য প্রিন্স’-এ।
আদিতে ইতালীয় ভাষায় ‘দ্য প্রিন্স’ বইটির নাম ‘ইল প্রিনচিপে’। লিখিত হয়েছিল আজ থেকে পাঁচশ’ বছর আগে ১৫১২-১৩ সময়কালে। যদিও বইটি ১৫৩২ সালের আগে ছাপা হয়নি। তখন ছাপাখানার যুগ ছিল না। ছিল না সহজে গ্রন্থ প্রকাশের ব্যবস্থাও। সে সময় বইটিকে একটি দলিল আকারে অল্প কয়েকটি কপি ছাপিয়ে বিলি করা হয়েছিল বিচ্ছিন্ন ও সামন্ততান্ত্রিক ইতালির প্রিন্স বা রাজপুরুষদের মাঝে।
তাতেই আলোড়ন ওঠে। সেকালের প্রচলিত শাসনের ধারা বদলে যায়। নতুন শাসন নীতি ও রীতির প্রতি আকৃষ্ট ও ঐক্যবদ্ধ হন শাসকরা।
ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী হয়ে ঔপনিবেশিক ক্ষমতাধরে পরিণত হওয়ার পেছনে ‘দ্য প্রিন্স’- এর প্রণোদনা ও অবদান অনস্বীকার্য। ইউরোপকে সুসংহত করে বিশ্বকে উপনিবেশের অধীনে এনে নিয়ন্ত্রণের প্রণোদনাও রয়েছে ম্যাকিয়াভিলির ‘দ্য প্রিন্স’ গ্রন্থে।
বইটিতে সদ্য সিংহাসনে আসীন যুবরাজদের উপদেশ দেওয়া হয়েছিল, ‘সিংহের মতো বলিষ্ঠ এবং শৃগালের মতো ধূর্ত হও। তোমার যারা সত্যিকারের শত্রু, তাদের তো বটেই, তাদের পরিবারের সদস্যদেরও নিশ্চিহ্ন করে দাও, যেন তুমি শাসন করতে পারো নির্ভাবনায়’।
বাংলাসহ বিশ্বের প্রায় সকল ভাষায় বইটি অনুদিত হয়েছে। বিশ্বের যেখানেই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্র ও রাজনীতি বিজ্ঞান পড়ানো হয়, সেখানেই ‘দ্য প্রিন্স’ অবশ্যপাঠ্য গ্রন্থ। রাষ্ট্র পরিচালনা ও রাজনীতি বিষয়ে এমন নানা রকম আরও বহু পরামর্শ পাঁচশ’ বছর আগে রচিত বইটির পাতায় পাতায় ছড়িয়ে রয়েছে, যা আজও রাজনীতির অঙ্গনে সমান প্রাসঙ্গিক।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এমনই আরো কিছু কালজয়ী গ্রন্থ হলো প্লেটোর ‘রিপাবলিক’, অ্যারিস্ট্রটলের ‘পলিটিক্স’, কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’, ইবনে খালদুনের ‘মুকাদ্দিমা’ এবং নিজাম-উল-মূলকের ‘সিয়াসতনামা’। এতো বিশিষ্ট বইয়ের সমাবেশে ম্যাকিয়াভেলির ‘দ্য প্রিন্স’ কিন্তু বিষয়বৈশিষ্ট্য আর গুরুত্বের দিক দিয়ে আজ পর্যন্ত অগ্রগণ্য।
‘দ্য প্রিন্স’- এ বর্ণিত নীতি বা ম্যাকিয়াভেলিবাদের হাত ধরে তখনকার পৃথিবীতে যেভাবে রাজনীতি আবর্তিত হয়েছে, আজও রাজনৈতিক ঘটনার তেমনই পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। দেশে দেশে এখনও সমানভাবে ম্যাকিয়াভেলির নানা নীতি ও দিক-নির্দেশনার প্রয়োগে বইটির সুদীর্ঘকালের আবেদন দেখে সত্যিই বিস্মিত হতে হয়। সাহস, ধূর্ততা, ক্রুরতা, শঠতা, মিথ্যা, প্রবঞ্চনা, প্রতিপক্ষ নিধন ইত্যাদি কৌশল হয়ত আগের মতো নেই। কিন্তু এখনও কি নির্মমভাবে রাজনীতির ময়দানে প্রয়োগ হচ্ছে, সেটি দেখে স্বয়ং ম্যাকিয়াভেলিই সম্ভবত আঁতকে উঠতেন। বিশ্বব্যাপী সংঘাত ও স্বার্থের রাজনীতির দিকে তাকিয়ে এ কথা বলা যায়।
তবে চাঁদের যেমন সব কিছুই ভালো নয়, কিছু কলঙ্কও রয়েছে, তেমনি ম্যাকিয়াভেলিবাদেও সকল কিছুই খারাপ, এমন নয়। ম্যাকিয়াভেলিবাদের নিন্দনীয় দিকের সঙ্গে সঙ্গে কিছু ভালো দিকও রয়েছে। যাতে জাতিরাষ্ট্রকে ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহতকরণ এবং নাগরিকদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার বিষয় রয়েছে।
ম্যাকিয়াভেলির হাজার বছর আগে প্রাচীন ভারতের কৌটিল্য বা চাণক্য ‘অর্থশাস্ত্র’ গ্রন্থে শাসকদের জন্য এমনই অনেক আপাত অমানবিক পরামর্শ দিয়েছিলেন, যা কার্যকর করে ভারতের মৌর্য সাম্রাজ্য বিশ্ব বিখ্যাত হয়েছিল। মধ্যযুগের ইসলামিক রাষ্ট্রতাত্ত্বি¡কদের মধ্যে নিজাম-উল-মূলক ‘সিয়াসাতনামা’ ও ইবনে খালদুন ‘মুকাদ্দিমা’- এ শাসকদের বহু ধরনের ভালো-মন্দ পরামর্শ ও নিদের্শনা দেন। অনেকেই সেসব পরামর্শ গ্রহণ করেছিলেন এবং সে সময় বাগদাদ, দামেস্কো ইত্যাদি শাসনকেন্দ্র শক্তি ও সমৃদ্ধিতে উজ্জ্বলতর হয়েছিল।
কিন্তু ঐতিহাসিক দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, খুব কম শাসকই রাষ্ট্রচিন্তাবিদদের ভালো পরামর্শগুলো গ্রহণ করেছেন। বরং অধিকাংশ শাসকই খারাপ এবং নিজের শাসনের জন্য সুবিধাজনক নির্দেশগুলোকে প্রতিপালন করেছেন। রাষ্ট্র, রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও নাগরিকদের উন্নতি, সংহতি ও কল্যাণের বদলে নিজেদের ব্যক্তিগত বা দলগত স্বার্থের প্রতিই তারা বেশি মনোযোগী হন। এ ধারা আজ পর্যন্ত দেশে দেশে বিদ্যমান।
মনে হয়, পাঁচশ’ বছর পরে আবার ম্যাকিয়াভেলির প্রত্যাবর্তন হয়েছে বিশ্বের স্বৈর, অগণতান্ত্রিক, ক্ষমতামত্ত শাসকদের মাধ্যমে। যারা ক্ষমতার দম্ভে, আনুগত্যের প্রাবল্যে, প্রচারের মচ্ছবে, অনুচরদের স্তাবকতায়, শক্তির রণহুঙ্কারে সাধারণ মানুষ ও বাস্তবের চেয়ে অনেক দূরে চলে যান। তাদের সাফল্য রচিত হয় মানুষের রক্তের এক একটি বিন্দুতে। দিনলিপি তৈরি হয় নির্যাতনের নিষ্ঠুর কঠোরতায়। তাদের আত্মগর্বের সৌধ ও প্রাসাদ নির্মিত হয় মানুষের অসম্মত ইচ্ছাকে দাবিয়ে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে।
অবশেষে তারা যখন সেখান থেকে শোচনীয়ভাবে পতিত হন, তখন হয়ে যান করুণা ও ঘৃণায় মিশ্রিত ইতিহাসের ট্র্যাজিক চরিত্র। যেমন বলা যায় হিটলার, মুসোলিনি প্রমুখের কথা। যাদের সকরুণ পরিসমাপ্তির কথা ভেবেই হয়ত শ্রেষ্ঠ নাট্যকার শেকসপিয়ার বলেছেন: ‘There is tears for his love, joy for his fortune, honor for his valor, and death for his ambition.’
ম্যাকিয়াভেলিবাদের প্রত্যাবর্তন হলেও স্বৈরদের আর ফিরে আসা হয় না। বিগত পাঁচশ’ বছরে বহু স্বৈর-অত্যাচারী ইতিহাসে মিশে গেছেন। আর ফিরে আসতে পারেননি। ঘৃণায়, লজ্জায়, ধিক্কারে তারা থেকে যান ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। কিন্তু যারা জনকল্যাণ ও জনস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তারা রয়ে গেছেন ইতিহাসের অম্লান পাতায় স্বর্ণালী অক্ষরে লিপিবদ্ধ।
ম্যাকিয়াভেলিবাদ ও অন্য সকল মতবাদই শাসকের জীবনে সার্থক হবে, যদি জনস্বার্থ, জনকল্যাণ ও জনতুষ্টির কাজটি সফলভাবে করা হয়। এ সত্যটি যেসব শাসক উপলব্ধি করতে পেরেছেন, তারাই শত সীমাবদ্ধতার পরেও ইতিহাসের বিচারে উত্তীর্ণ হয়ে সফল হতে পেরেছেন।
ড. মাহফুজ পারভেজ: কবি ও লেখক, অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
mahfuzparvez@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১১৩৫ ঘণ্টা, মে ১৯, ২০১৭
এএসআর