ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

ফ্লাট কেনার জন্য ঋণ ও বাস্তবতা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৩১ ঘণ্টা, জুন ৪, ২০১৭
ফ্লাট কেনার জন্য ঋণ ও বাস্তবতা

থাকার জন্য একটি ফ্লাট যেন স্বপ্নের ঠিকানা। দেশের উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত সকলেরই নূন্যতম চাওয়া হলো একটি বাড়ি, ফ্লাট তথা নিজস্ব ঠিকানা। মানুষ শান্তি চায় আর শান্তিতে থাকার অন্যতম অনুষঙ্গ হলো বাড়ি। আর তা নিজস্ব সামর্থের মধ্যে সর্বোচ্চ বিনিয়োগের মাধ্যমে ক্রয় করতে হয়।

তবে উচ্চ বিত্তের জন্য বাড়ি, ফ্লাট কোন কিছুই কেনার ক্ষেত্রে চিন্তা করতে হয় না। তারা নিজস্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশ ও বিদেশের উন্নত জায়গায় নিজেদের পছন্দমত এক বা একাধিক বাড়ি কিনে থাকেন।

প্রয়োজনের আলোকে অনেক সময় নিজস্ব বাড়ি ভাড়া দিয়ে হয়ত ক্ষেত্রভেদে অন্য জায়গায় নিজেও ভাড়া থাকেন। সবকিছুই তাদের ইচ্ছাধীন হয়ে থাকে। অর্থাৎ স্বপ্নের ঠিকানা, “তাদের হাতের মুঠোয়”। তবে সমাজের উচ্চবিত্তের অধিকাংশই নিজস্ব বাড়িতেই থাকতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন।

মধ্যবিত্ত ও  নিম্ন মধ্যবিত্ত ব্যক্তির বাড়ি কিংবা ফ্লাট কেনা হলো অনেকটা স্বপ্নের মত। যা কিনতে হলে তার অনেক চিন্তা ভাবনা করেই এগুতে হয়। তাদের সাধ আছে, কিন্তু অনেক সময় সাধ্যে কুলায় না। সন্তান ও পরিবারের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ঢাকাসহ দেশের যে কোন জায়গায় চাহিদা ও সামর্থের আলোকে একটি বাড়ি নির্মাণের চিন্তা করেন। অনেক সময় তাদেরকে চিন্তার মধ্যে থাকতে হয়। চিন্তার বাস্তবায়ন অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন হয়ে যায়।

তাছাড়া সংসারের মৌলিক চাহিদা পূরণ করার পর একটি বাড়ি করা সহজ কথা নয়। আর সব জায়গায় তাতে বিনিয়োগ করার জন্য পর্যাপ্ত টাকাও সংগ্রহ করা যায় না।

তবে সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নাগরিকের অন্যতম চাহিদা থাকে বিভাগীয় শহর কিংবা জেলা শহরে পরিবার নিয়ে থাকার জন্য অন্তত একটি ফ্লাট। যার জন্য তাকে অনেক পরিকল্পনা করতে হয়। ব্যাংক থেকে ঋণ এক্ষেত্রে সহায়ক হিসেবে ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইনানস কর্পোরেশন স্বল্প সুদে ঋণ দেয়। তবে অনেক সময় তাৎক্ষণিক চাহিদা মেটানোর জন্য বেসরকারি ব্যাংক ও লিজিং কোম্পানির দ্বারস্থ হতে হয়। ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে কিছুটা অসতর্ক থাকলে কিংবা ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানের শর্ত যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে না পারলেই মহাবিপদে পড়তে হয়। ঋণ গ্রহণকারী ব্যক্তিকে গৃহীত ঋণের টাকা পরিশোধের পাশাপাশি অনেক টাকা সুদ হিসেবে দিতে হয়।

অবশ্য সরকারি ব্যাংক কিংবা বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইনান্স কর্পোরেশন থেকে ঋণ নিলে ভিন্ন কথা। সেক্ষেত্রে নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করলে বাকি ঝামেলা খুব একটা থাকে না। কোন কিস্তি সময় মত না দিলে বাড়তি সুদ দিতে হয়। গ্রাহক তা স্বাভাবিক ভাবে মেনে নেয়।

মধ্যবিত্ত সমাজের প্রতিনিধি হিসাবে এ ধরনের ঝাঁমেলা হতে আমিও মুক্ত হতে পারিনি। বাস্তবতার নিরিখে তা বলার চেষ্টা করব। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমার মতো অনেক ভুক্তভোগীকে এ ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়েছে। তবে একটু সচেতন থাকতে পারলে ফ্লাট কেনার জন্য ঋণ অভিশাপ না হয়ে আশীর্বাদ হতে পারে।

পারিবারিক প্রয়োজনে ঢাকা শহরে ছোট আকারের একটি ফ্লাট কেনার চিন্তা করি। এজন্য আমার জমানো টাকার সাথে আরো দশ লক্ষ টাকা ঋণ হিসাবে পাওয়ার আশায় ব্যাংকের দ্বারস্থ হই। এক পর্যায়ে একটি বেসরকারি হাউজিং ফাইন্যান্স কোম্পানি ১০.৭৫% হারে ঋণ দিতে সম্মত হয়।

ফ্লাট কেনার জন্য হাতে সময় কম থাকায় বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন (বিএইচবিএফসি) এ না গিয়ে ওই কোম্পানির সাথে ২০১০ সালের ৮ নভেম্বর চুক্তিবদ্ধ হই। বিএইচবিএফসিতে তখন কিছুটা কম সুদে ঋণ দেওয়া হত। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী সুদের হার যখন যা হবে সে অনুযায়ী উত্তোলিত ঋণের সুদ প্রযোজ্য হবে।

ভালো কথা, দশ বছর মেয়াদি অর্থাৎ একশত বিশ কিস্তিতে তা পরিশোধের শর্তে রাজী হই। মাসিক কিস্তি ১৩৬৩৪/- টাকা।
লিজিং কোম্পানিকে মাসিক কিস্তি দেয়া শুরু করলাম। আরে দেখি কী, তিনমাস পরই সুদের হার বেড়ে ১৩% হয়ে গেল। প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করি। কিন্তু লাভ হলো না। তাদের কথা, বর্তমানে সুদের হার বেশী তাই চুক্তি অনুযায়ী তা আপনাকে দিতে হবে। এভাবে সুদের হার বাড়তে বাড়তে এক পর্যায়ে ১৬.৭৫% এসে দাঁড়ালো। আমি চিন্তা করলাম কিভাবে অতিরিক্ত সুদ থেকে বাঁচা যায়।

এজন্য কিস্তির পরিমাণ বাড়িয়ে প্রথমে ১৯০২৩ টাকা ও পরবর্তীতে তা আবার ২৪৫১২ করি। দেখা গেল সুদ আর আশানুরুপ কমছে না। একপর্যায়ে এককালীন টাকাও জমা দেই। এতে কিছুটা কাজ হলো। সুদের পরিমাণ কমল। পরে বুঝলাম চুক্তির সময়ই মূল সমস্যা হয়েছে। তখন যদি ফিক্সড সুদে চুক্তি করতাম, হয়তো সুদের হার ১০.৭৫% এর স্থলে বড়জোড় ১২% হতো। যাক যা হবার হয়েছে, তা চিন্তা করে লাভ নেই।

এক পর্যায়ে খবর পেলাম, সুদের হার কমা শুরু হয়েছে। খুশি হলাম এবার হয়ত আমার বেলায় তা প্রযোজ্য হবে। কিন্তু যেভাবে বৃদ্ধির সময় সুদের হার লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ত, কমার সময় তা আবার খুব ধীর গতিতে নামল। ২০১৫ সালের ২৭ এপ্রিলে এসেও তা ১৪% এর নীচে নামল না। মজার ব্যাপার হলো, নতুন ঋণ গ্রহীতাদের বেলায় তখন সুদের হার ক্ষেত্র ভেদে ৯.৫%।

নিয়মিত কিস্তি দেয়ার পরও সুদ কিভাবে আসত তার একটি উদাহরণ দেয়া প্রাসঙ্গিক মনে করছি। জুলাই ২০১২ থেকে জুন ২০১৩ অর্থাৎ বৎসরে ১৬৩,৬০৮.০০ টাকা পরিশোধ করা হয়। তন্মধ্যে মূল টাকা ১২,৩৫৮, সুদ ১৫১,২৫০ টাকা। যা দেখে রীতিমত আমার ভড়কে যাওয়ার অবস্থা।

এ অবস্থায় দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে মাসিক কিস্তি বাড়ানোর পাশাপাশি এককালীন টাকা জমা দেয়ার পরিমাণও বাড়িয়ে দেই। ২০১৫ সালের ২৭ এপ্রিল এককালীর দুই লক্ষ টাকা জমা দেয়া হয়।

তারপরও ৩০ জুন এর হিসাব অনুযায়ী সুদ হিসেবে আসে ১,০৭,২৪৪ টাকা, আর মূল টাকা ১,২২,৩৮৬ হয় যা আমার গৃহীত ঋণ থেকে বাদ যায়। অবশেষে অনেক কষ্ট করে এককালীন অনেক টাকা একসাথে জমা দেই। ২০১৬ সালের ২৭ মার্চ অবশিষ্ট ২৯১০৪ টাকা জমা দিয়ে এই হাউজিং কোম্পানি থেকে নিষ্কৃতি পাই।

ঋণ করে ফ্লাট কিংবা বাড়ি কেনা ছাড়া মধ্যবিত্তের খুব একটা উপায় নেই। তবে এক্ষেত্রে সুদের হার নিয়ে সতর্ক থাকা দরকার। আলাপ আলোচনা করে সুদের হার ফিক্সড করা দরকার। আর যারা সুদ দিয়ে বাড়ি কিংবা ফ্লাট কিনতে চান না তাদের বিষয়টি আলাদা। তারা নিশ্চয় নিজস্ব পরিকল্পনা মাফিক আগাবেন। ঋণ গ্রহণ ছাড়া ফ্লাট কিংবা বাড়ি করতে পারলে তো ভালো হয়।

২০১৭ সালের ১৯ এপ্রিল একটি পত্রিকায় সংবাদ দেখি যে, বাড়ি নির্মাণে বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ দেয়া হবে। বাড়ি নির্মাণে সুদের হার ৯.৫%, ফ্লাট কেনায় ১০%। সংবাদটি পড়ে ভালো লাগল যে সরকারি প্রতিষ্ঠান তো, গ্রাহক সুদের যাঁতাকল থেকে কিছুটা হলেও বাঁচবে। তবে অনেক সময় সহজে ও কম সময়ে ঋণ পাওয়ার জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যেতে হয়। তখন যেন সুদের হারের বিষয়টি মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। তাছাড়া আবাসন খাত বিকাশের জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপশি বেসরকারি ব্যাংক, লিজিং খাতের ভূমিকাও ব্যাপক।

ঋণ ছাড়া স্বপ্নের বাড়ি নির্মাণের চিন্তা করা মধ্যবিত্তের জন্য অনেক ক্ষেত্রেই দুরাশা। এক্ষেত্রে সরকারের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছাড়া নিম্নবিত্তদের আর কোন উপায় থাকে না।

সুন্দর স্বপ্নদেখা দোষের কিছু নয়। আমাদের প্রত্যাশা, দেশ আরো অনেক উন্নত হবে, ২০২৪ সালে আমরা মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হবে। জিডিপির গ্রোথও প্রতি বছর বাড়ছে। আশা করি এক সময় নিম্ন মধ্যবিত্ত, গরীব কিংবা সাধারণ নাগরিকদের থাকার জন্য একটি স্থায়ী ঠিকানা পর্যায়ক্রমে করার পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।

সৈয়দ ছলিম মোহাম্মদ আব্দুল কাদির: অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার, শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

বাংলাদেশ সময়: ১৬২০ ঘণ্টা, জুন ৪, ২০১৭
জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।