ক্রিকেট বিশ্বের বুকে রচনা করলো ঐতিহাসিক বিজয় স্মারকস্তম্ভ। পুরাণের ফিনিক্স পাখির মতো ধ্বংসের ছাই সরিয়ে ক্রিকেট জগতের আকাশে-বাতাসে উড়িয়ে দিলো বিজয়ের উল্লাসময় বাংলাদেশের লাল-সবুজ প্রতীকের গৌরব কেতন।
ব্রিটেনের সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে বাংলাদেশের তিনকন্যার রাজনৈতিক বিজয়ের রেশ মিলতে না মিলতেই পাশের শহর কার্ডিফ থেকে ক্রিকেট দল বাংলাদেশের গৌরব মুকুটে যুক্ত করলো আরেকটি স্বর্ণালী পালক। ক্রিকেটের পরাশক্তি নিউজিল্যান্ডকে বধ করে সশক্তিতে বাংলাদেশ জাগিয়ে রাখলো সেমি ফাইনাল খেলার প্রত্যাশা। দূর ইউরোপের মাটিতে বাংলাদেশের ইতিহাস সৃষ্টিকারী অর্জনের ব্যাঘ্র-হুংকার-ধ্বনি প্রবলভাবে প্রতিধ্বনিত হলো বাংলাদেশের প্রান্তে প্রান্তে, জনপদে জনপদে, প্রতিটি বাঙালির হৃদয় ও চৈতন্যের প্রবহমান শোণিতে। ক্রিকেট বিজয়ের সমান্তরালে বাংলাদেশ অমিত শক্তিতে জেগে ওঠার প্রত্যাশায় পুনর্বার দৃঢ়তর চিত্তে সংকল্পবদ্ধ হলো।
বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বিজয় সম্পন্ন হলো এমনই এক সময়ে যখন বাধার প্রাচীর ভেঙে সামনে এগিয়ে যাওয়ার মোহন সুরে পুরো জাতি উদ্বেলিত। এমনই মাহেন্দ্রক্ষণে, বিশ্বায়নের পৃথিবীতে সামনে চলার প্রণোদনাপূর্ণ নব তরঙ্গ হয়ে এলো ক্রিকেটের বিজয়। বিশ্ব এবং দক্ষিণ এশিয়ায় যোগাযোগ, মৈত্রী, সম্প্রীতি ও উন্নয়নের মহাযজ্ঞে জাতির অগ্রগামিতার পথে নবপ্রাণ জাগ্রত হলো ক্রিকেটের লড়াকু উদাহরণ থেকে। ক্রিকেট বাংলাদেশের জাতীয় শক্তিকে আরও বেগবান ও দুর্জয় করলো। হারের ললাট থেকে জয়ের তিলক ছিনিয়ে আনার অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশের সহস্র জনতার মুষ্টিবদ্ধ হাত অসীমের স্তব্ধতা ভেঙে ঘোষণা করলো জীবনের সর্বক্ষেত্রে বিজয়োন্মুখ বজ্রশপথ।
বরণীয় ক্রিকেটার সাকিব আর মাহমুদুল্লাহর দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী হার না মানার প্রত্যয় ক্রিকেটের মাঠ থেকে তড়িৎ বেগে ছড়িয়ে গেলো সারা বাংলাদেশ হয়ে সমগ্র বিশ্বে। তথ্য-প্রযুক্তির তীব্র গতির যুগে বাংলাদেশের বিজয় বার্তা পৌঁছে গেল পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে বসবাসকারী লক্ষ-কোটি বাংলাভাষীর শিহরণ-জাগা উল্লাস ধ্বনিতে। সামাজিক যোগাযোগের প্রতিটি মাধ্যমে বাংলার স্বর আর ব্যঞ্জন বর্ণগুলো উদ্বেলিত হলো হর্ষে, আনন্দে, গৌরবে। অভিনন্দনের সমুদ্র-সমান আবেগে-আনন্দে প্রতিটি বাংলাভাষীর অন্তরের গহীন প্রদেশ থেকে আমাদের খেলোয়াড়দের প্রতি বর্ষিত হলো পুষ্পিত শুভেচ্ছা আর অন্তহীন ভালোবাসা।
চরম মুহূর্তে ধৈর্য, মনোযোগ, দৃঢ়তার মাধ্যমে আসন্ন পরাজয়কে হারিয়ে দিয়ে জয়কে আলিঙ্গন করার ক্রিকেট উপহার দিয়ে বাংলাদেশ দলের শক্ত-পোক্ত স্নায়ূর অধিকারী খেলোয়াড়রা বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষের সামনে দুর্যোগ, দুর্বিপাকে আশাবাদী হওয়ার অনুপ্রেরণা জাগিয়েছে। বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকা ক্ষেত্রগুলোকে জয়ের মুখ দেখানোর আশা সঞ্চারিত হয়েছে ক্রিকেটের বিজয় থেকে। এ বিজয়ের চিহ্ন ভবিষ্যতে বিশ্ব ক্রিকেটের সর্বোচ্চ বিজয় ছিনিয়ে আসার পথকেও করেছে মসৃণ। বাংলাদেশের ক্রিকেট এখন শৈশব ছেড়ে যৌবনের ঘোরতর উন্মাদনায় বিজয় ছাড়া আর কিছুই মেনে নিতে নারাজ। এই রকমের বিজয়-পাগল ক্রিকেট শক্তি বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন না হয়ে থামবে না। ক্রিকেট বিশ্বের মোড়লরাও এই সত্য কবুল করতে বাধ্য হচ্ছেন।
ক্রিকেটে বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হয়েছে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ক্ষণে। এই জুন মাসেই, আজ থেকে ২৬০ বছর আগে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির কাছে পলাশীর প্রান্তরের প্রহসন যুদ্ধে (১৭৫৭) বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। সেই ব্রিটেনের মাটিতেই এতো বছর পর বিজয়ের সগৌরব বার্তা বাংলার স্বাধীনচেতা মননের বার্তাবহ। সংকটে-সমস্যায় বাংলাদেশ যে শত বিঘ্ন ও বিরূপতাকে পরাজিত করে অপরাজেয় শক্তিতে এগিয়ে যাবেই; পরাজয়ের প্রান্ত থেকে ছিনিয়ে আনা ক্রিকেটের বিজয় সেই অমোঘ সত্যের প্রকাশ ছাড়া আর কিছু নয়।
রূপকথার ফিনিক্স পাখির মতো বাস্তবের কঠিন রণাঙ্গনে পরাজয়কে পায়ে মাড়িয়ে বিজয়ের মহাসড়কে পৌঁছার আধুনিক দৃষ্টান্ত বাংলাদেশের ক্রিকেট। শাশ্বত বাংলাদেশের মতোই পরাভব না মানা সত্তার অধিকারী বাংলাদেশের ক্রিকেট। বাংলার ক্রিকেটের ফিনিক্স পাখিরা, তোমাদের অভিনন্দন। তোমাদের প্রতি অন্তঃহীন শুভেচ্ছা। পুষ্পিত ভালোবাসা।
বাংলাদেশ সময়: ০৫১৫ ঘণ্টা, জুন ১০, ২০১৭
এএ