ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

গৌরব আর ঐতিহ্যের বাবা ‘ফারুক মাহমুদ’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৫২ ঘণ্টা, জুলাই ১৩, ২০১৭
গৌরব আর ঐতিহ্যের বাবা ‘ফারুক মাহমুদ’ গৌরব আর ঐতিহ্যের বাবা ‘ফারুক মাহমুদ’

গৌরব আর ঐতিহ্যের বাবা ‘ফারুক মাহমুদ’
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল

গৌরব আর ঐতিহ্যের বাবা। সেই বাবা বাংলা সাহিত্যের ছাত্র এবং কবি; কিছুটা হলেও বাংলা কবিতার গৌরব আর ঐতিহ্য বহন করছেন।

তাকে খুব কাছ থেকে, দূর থেকে, ভেতর থেকে, বাহির থেকে দেখছি- সেই শেষ সত্তর থেকে। জানি মানুষ হিসেবে, কবি হিসেবে।

মানুষ বদলে যায়, কবি বদলে যায়। Dacca বদলে Dhaka হয়ে যায়। কিন্তু মেঘনা নদীর পাড়ের ভৈরবের চন্ডি গ্রামের এই কাদামাটির মানুষটি এখনও তার মতোই খাঁটি ‘ফারুক মাহমুদ’ হয়েই আছেন। সেই যে কবে ভুল করে ‘পাথরের ফুল’ ফোটাতে চেয়েছেন। মনে মনে বনমালীর মতো সেই স্বপ্নে, মোহে আজো অসম্ভবের চাষ-চর্চা করছেন এক ঘোরের ভেতর। শীর্ষে ওঠার জন্য পায়ের কাছে ক্ষমতার সিঁড়ি ছিলো। কিন্তু সেই পথে পা দেননি। শালার কবি-জীবন, কবিতা-কবিতা করে রৌদ্র এবং জলের পিপাসা নিয়ে ৬৫ বছর পার করে দিলেন!
এক সময় আমরা পরস্পরের ছায়াসঙ্গী ছিলাম। এক সঙ্গে পাড়ি দিয়েছি দীর্ঘ পথ। আমাদের কতো স্মৃতি, ঝগড়া, অভিমান, আনন্দ, বেদনা, আন্দোলন, গোপন কথা, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, পারিবারিক ঘটনা। তার সেগুন বাগিচার দৈনিক দেশের কার্যালয়ের সাপ্তাহিক বিপ্লব অফিসে বসে পহেলা বৈশাখে প্রথম পান্তা-ইলিশের সূচনা। লিটলম্যাগ আন্দোনলের জন্য ‘ছোটকাগজ’ সংগঠন, প্রথম কবিতার ক্যাসেট প্রকাশ, ২০ ফেব্রুয়ারি সারারাত বাংলা একাডেমির বইমেলায় হইচই-আড্ডাবাজির পর টিএসসি চত্বরে রাত ১২টা এক মিনিটে কবিতা পাঠের আসর। দলবেঁধে কলকাতায় কবিতা সম্মেলনে যাওয়া আবার ঢাকায় কখনও পুলিশের তাড়া খেয়ে মধ্যরাতে বিআরটিসি’র শেষ বাসে মিরপুরে ঘরে ফেরা। পরদিন হয়তো ছুটির দিন। বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে হকারের দোকানে গিয়ে এক সঙ্গে দৈনিক সাহিত্য পাতা দেখা, সেখান থেকে গ্রিন রোডে আবদুল মান্নান সৈয়দকে কেন্দ্র করে আড্ডা, আড্ডা থেকে সিকদার ভাইয়ের বাসা হয়ে পান্থ পথে পূর্ণতার অফিসে আবার আড্ডা। আমি হয়তো চলে গেলাম খিলগাঁ আমার খালার বাসায়। কিন্তু আমাদের আবার দেখা হয় পল্টনের আওয়ামী লীগের জন সভায়। সভা শেষ হলে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের ছাদে ভাত উৎসব, ভূঁরিভোজ! তারপর বাড়ি ফেরার উদ্দেশে বাংলামোটর থেকে হেঁটে গল্প করতে করতে ফার্মগেট। তবু আমাদের গল্প ফুরায় না।

একটি মজার এবং একটি দুঃখের গল্প বলি। মজার হচ্ছে, কোনো এক আলো-আঁধারি সন্ধ্যায় আমরা পাবলিক লাইব্রেরির মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে যাচ্ছি। সেখান থেকে বেরিয়ে আসছেন শিল্পী কামরুল হাসান। হঠাৎ দুষ্টুমি বুদ্ধি এলো। দশ টাকা বাজি ধরলো ফারুক মাহমুদ। তার সঙ্গে বাঁদরামি করবো। কামরুল ভাই কাছে আসতেই সালাম দিয়ে বললাম, আপনাকে খুব চেনা-চেনা লাগছে, বুদ্ধিজীবী-বুদ্ধিজীবী লাগছে। আপনি কী বুদ্ধিজীবী? কামরুল ভাই বললেন, আমি কামরুল। কামরুল হাসান।

-ও সৈয়দ কামরুল আহসান? হুম, চিনছি। এ সংখ্যায় রোববারে আপনার গল্প পড়েছি।
-না না। আমি সৈয়দ-টৈয়দ নই। আমি পটুয়া।
বলে একটু বিরক্ত হয়ে চলে গেলেন। ফারুক মাহমুদ হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা! কিন্তু ঋণ-খেলাপি ফারুক মাহমুদ বাজি ধরার সেই দশ টাকা আজও দেননি।

ফারুক মাহমুদ নামে ডানপন্থী আরেকজন বয়স্ক ‘কবি’ ছিলেন। সেই ফারুক মাহমুদের কবিতার বই ‘দাঁড়াও বাংলাদেশ' দেখিয়ে খেপাতে চেষ্টা করতাম। বলতাম, খুব ভালো লিখেছেন। আমাদের ‘আসল’ ফারুক মাহমুদ তখন ‘নকল’ ফারুক মাহমুদকে গালি দিয়ে বলতেন, তিনি তো দুই নম্বর কবি!

আরেকটি বেদনার স্মৃতি। নব্বই দশকের প্রথম দিকের ঘটনা। ১৫ আগস্ট ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরে আওয়ামী লীগের অনুষ্ঠানে খ ম জাহাঙ্গীর স্বাক্ষরিত কবিতা পাঠের নিমন্ত্রণ। অনুষ্ঠান চলছে। কবিরা মঞ্চে বসে আছেন। এমন সময় সাজেদা চৌধুরী এসে পুরুষালি কণ্ঠে বললেন, নেতারা সবাই এসে গেছেন। এখন কবিতা-টবিতা রাখো। বক্তৃতা শুরু করো।

আমি আর ফারুক মাহমুদ লজ্জায় পেছন দিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে আসি। আমরা আর কোনোদিন আওয়ামী লীগের অনুষ্ঠানে কবিতা পড়তে যাইনি। কিন্তু সেদিন মহাদেব সাহা প্রতিবাদ করে বলেছেন, আমাদের কবিতা পড়তে ডেকেছেন। আমরা কবিতা পড়বো এবং সেদিন তিনি কবিতা পড়েছেন।

আহারে, সেইসব দিনগুলো, স্মৃতিগুলো আজ ভাবলে বিকল্প ‘ফারুক মাহমুদ’ খুঁজে পাই না।

না, কবিতা নয়। শুধু কবির কথাই বলছি। আমাদের বৃক্ষজীবনে কতো স্মৃতির স্বর্ণলতা জড়িয়ে আছে। আমার মা এক সময় আমাদের মা হয়ে যান। তাই, ঈদের দিনে যে ভাবেই হোক এক ফাঁকে আম্মাকে কদমবুচির জন্য ছুটে আসতেন নাসির আহমেদ। মৃদুল দাশগুপ্ত ঢাকায় এলেই তার মাসী মা-কে প্রণামের জন্য আলাদা সময় রাখতেন। তেমনি ফারুক মাহমুদও। সেদিন কথায় কথায় কবি মনে করিয়ে দিলেন, তাদের ছেলে এখন পড়াশোনা শেষ করে ব্রিটিশ কাউন্সিলে যোগ দিয়েছে আর মেয়েটা স্কলারশিপ নিয়ে মন্ট্রিয়লের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর পড়াশোনা করছে। তাদের এই দুই সন্তানদের জন্মের পূর্বে আমার মা নাতি-নাতনির আনন্দে পুরনো শাড়ি-কাপড় দিয়ে বানিয়ে দিয়েছিলেন ছোট ছোট কয়েকটি কাঁথা! সেই কাঁথা বড় কথা নয়; কথা হচ্ছে, স্নেহ-ভালোবাসা-মমতা-সম্পর্ক!

এরকম অনেক অপ্রকাশিত স্মৃতি আছে মমতাজ-মোমেনার সন্তান এবং গৌরব আর ঐতিহ্যের বাবা ফারুক মাহমুদের সঙ্গে। তা এক-দুই পাতায় হবে না। লিখতে গেলে একটা বই হবে। ভাষা আন্দোলনের বছরে জন্ম। আগামী ১৭ জুলাই ফারুক মাহমুদের জন্মদিন। সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে এই আটলান্টিকের এপার থেকে ছন্দের কবিতায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করা এই কবির শুভ জন্মদিনে জানাচ্ছি আগাম অফুরন্ত শুভেচ্ছা।

বাংলাদেশ সময়: ১২৪৯ ঘণ্টা, জুলাই ১৩, ২০১৭
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।