ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

অর্থ, বিত্ত ও সম্পদের দুনিয়া!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৫৯ ঘণ্টা, জুলাই ২২, ২০১৭
অর্থ, বিত্ত ও সম্পদের দুনিয়া! ইনকাদের স্বর্ণসম্পদ

বাজেটের আগে ও পরে অর্থ আর সম্পদ নিয়ে মানুষের ভাবনা-চিন্তা ভীষণ রকম বৃদ্ধি পায়। কিসের দাম বাড়ল? কিসের কর বাড়ল? কোন কোন জিনিস কম দামে কেনা যাবে? এসব চিন্তায় মশগুল হয় সাধারণ মানুষ। রাষ্ট্রের বাজেটের সঙ্গে ব্যক্তি বা পরিবারের বাজেটের সামঞ্জস্য বিধান করার কাজটিও তো নিম্ন এবং মধ্য আয়ের খেটে খাওয়া মানুষকে প্রতিনিয়তই করতে হয়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, মুদ্রাস্ফীতি, বাজার সিন্ডিকেট ইত্যাদিকে পাল্লা দিয়েই একজন মানুষকে তার গোটা পরিবারটিকে নিয়ে সঙ্কুল সংসার সমুদ্র পাড়ি দিতে হয়। এটাই আধুনিক মানুষের অর্থনৈতিক জীবনের বাস্তবতা।

নিত্যদিন  টিকে থাকার সংগ্রামে অর্থ, বিত্ত ও সম্পদ মানুষকে সাহায্য করে। আবার কখনও কখনও অর্থ, সম্পদ, বিত্ত মানুষের জন্য বোঝা বা বিপদের কারণও হয়ে দাঁড়ায়।

অর্থ, বিত্ত ও সম্পদের ভালো দিকের পাশাপাশি ক্ষতিকর দিকও যে রয়েছে, ক’জন সেটা বুঝতে পারেন! অর্থ আর সম্পদের মধ্যে যে খুবই সূক্ষ একটি পার্থক্য রেখা রয়েছে, তা-ও অনেক মানুষ ধরতেই পারে না। সচরাচর সবার দৃষ্টি ও মনোযোগ এড়িয়ে যায় এই বিভাজন।

ইতিহাস বলছে, ‘সম্পদ নয়, অর্থই সভ্যতার মূল চালিকা শক্তি’। খানিক ব্যাখ্যা দিয়ে বিষয়গুলো খুলে বলা যেতে পারে। আমরা জানি, সুপ্রাচীন রোম, পারস্য, আরব, হিন্দুস্তান ও চীনে সঞ্চিত প্রভূত সম্পদের কথা লেখা রয়েছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়। অর্থের প্রসঙ্গ এসেছে আরও পরে, আগে এসেছে সম্পদের কথা। মূলত অর্থের উত্থান আরও পরের ঘটনা।

কর্নেল ফ্র্যানসিস্কো পিজারোযাওয়া যাক, পাঁচ শ’ বছর আগের দক্ষিণ আমেরিকায়। তখন ঐ মহাদেশের সবচেয়ে উন্নত সমাজ ছিল ইনকাদের। ইনকারা ছিল অর্থের সঙ্গে পরিচিতিবিহীন। তারা তারিফ করত মূল্যবান ধাতু-সামগ্রীর। কিন্তু সেই তারিফ বহুলাংশে কাব্যধর্মী ও রূপক। যেমন, তাদের বর্ণনায় সোনা হচ্ছে ‘সূর্যের স্বেদ’ আর রূপা হচ্ছে ‘চাঁদের অশ্রু’। এ হেন জগত দখল করার জন্য হানা দিলেন এক স্পেনিয় আক্রমণকারী। নাম কর্নেল ফ্র্যানসিস্কো পিজারো। সময়কাল ১৫০২ সাল। কলম্বাসের চেয়ে এক-কাঠি এগিয়ে পিজারো পেরিয়েছিলেন পানামার স্থলরেখা এবং হাজির হয়েছিলেন পেরুতে। পরে দেশে ফিরে গিয়ে আবার উপস্থিত হলেন স্পেনের রাজকীয় সনদ সঙ্গে নিয়ে। আরও আনলেন তিনটি জাহাজ, সাতাশটি ঘোড়া, এক শ’ আশিজন সৈন্য। এবং সেকালের বিবেচনায় অত্যাধুনিক কিছু অস্ত্রশস্ত্র। যেমন গাদা বন্দুক এবং যান্ত্রিক ছিলাযুক্ত ধনুক, যা ইউরোপীয়দের শিখিয়েছিল মধ্য এশিয়া থেকে আগত হালাকু-চেঙ্গিসের অধীনস্থ যোদ্ধারা। মজার কথা, ঐ ঘোড়ার আতঙ্কেই ইনকারা শেষ! অর্থের মতই তারা অপরিচিত ছিল অশ্বের সঙ্গেও।

এমন ঘটনা ঘটেছিল ভারতেও। বাবরের কামানের দাপটের সামনে টিকতে পারে নি হস্তিবাহিনি। বাবরই প্রথম ভারতের যুদ্ধক্ষেত্রে কামান ব্যবহার করেন। সেই মধ্যযুগে কামানের মতো একটি মারণাস্ত্রের সঙ্গে মোটেও পরিচিত ছিল না ভারতবর্ষের মানুষ। অতএব, নবাগত কামানকে ভয় পাওয়া ভারতীয়দের পক্ষে স্বাভাবিক। অনুরূপভাবে ঘোড়ার আতঙ্কে দক্ষিণ আমেরিকায় ইনকাদের পর্যদুস্ত হওয়ার ঘটনাটিও বিচিত্র কিছু নয়।  

 স্পেনিয় ঔপনিবেশিকবাদি পিজারোর সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত ইনকা যুবরাজ আতাহুয়ালপা-কে বিজেতারা প্রস্তাব দিয়েছিল খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করার। কিন্তু আতাহুয়ালপা ঘৃণাভরে ল্যাটিন ভাষায় লিখিত বাইবেল মাটিতে ছুড়ে ফেলে ধর্মান্তকরণের প্রতিউত্তর দিলেন। তিনি চেষ্টা করলেন প্রতিরোধ গড়ে তোলার। কিন্তু ঘোড়াতঙ্কে সাধারণ ইনকারা এতটাই কাবু ও দিশেহারা ছিলেন যে, আগ্রাসীদের বিরুদ্ধে কোনও সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিরোধ গড়তেই সক্ষম হলেন না। ইনকারা এটাও বিলক্ষণ উপলব্ধি করতে পারেন যে, যেসব ধাতুকে তারা ‘সূর্যের স্বেদ’ নামে ভূষিত করেছেন, তারই সন্ধানে এই বিদেশি হানাদারদের আগমন ঘটেছে। ইনকারা বিদেশি আক্রমণকারীদের হাত থেকে বাঁচার জন্য ১৩,৪২০ পাউন্ড সোনা, যার শুদ্ধতা ২২ ক্যারেট, এবং ২৬,০০০ পাউন্ড বিশুদ্ধ রৌপ্য বিনা বাঁধায় দিয়েছিলেন স্পেনিয়দের। কিন্তু তাতেও বাঁচতে পারলেন না ইনকারা এবং তাদের সাহসী যুবরাজ আতাহুয়ালপা। আতাহুয়ালপাকে জনসমক্ষে ফাঁসিতে ঝুঁলিয়ে, সাধারণ ইনকাদের কচু-কাটা করে এবং ইনকা রাজধানীটিকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করেও ক্ষান্ত হয় নি স্পেনিয় ঔপনিবেশবাদীরা; লিমাতে আস্তানা গেঁড়ে শোষণ করতে লাগলেন তাবৎ দক্ষিণ আমেরিকা। ততদিনে সমগ্র মহাদেশটিই স্পেনিয় উপনিবেশে পরিণত হয়ে গেছে।

একমাত্র ব্রাজিল ছাড়া দক্ষিণ আমেরিকার সকল দেশের ভাষা হয়ে গেছে স্পেনিশ আর ধর্ম খ্রিস্টবাদ। ব্রাজিল পর্তুগিজ উপনিবেশ হওয়ায় তারা দখলকারীদের ভাষা পেল। তবে ধর্ম হিসাবে এখানেও খ্রিস্টবাদই জেঁকে বসল। অন্যদিকে, দক্ষিণ আমেরিকার স্বর্ণ-রূপার ধাতব সম্পদ পরিণত হল ইউরোপের নানা দেশের সচল মুদ্রায়।

ডাকাতি করে স্পেনিয়রা প্রভূত সম্পদ আহরণ করতে সক্ষম হলেও সে সম্পদকে বেশি দিন ধরে অর্থে পরিণত করতে পারে নি। সোনা-রূপার অত্যধিক আমদানির ফলে ঘটে মুদ্রার নাটকীয় অবমূল্যায়ন এবং তজ্জনিত সাত গুণ মূল্যবৃদ্ধি। এই মূল্যবৃদ্ধি বর্তমান কালের স্বাভাবিক ইনফ্লেশনের তুলনায়, অর্থাৎ বছরে দুই শতাংশ হারে, খুব বেশি নয়। কিন্তু মধ্যযুগের অপরিবর্তনীয় অর্থনীতিতে সাত শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি একদম বৈপ্লবিক ও বিপজ্জনক।

ইনকা যুবরাজ আতাহুয়ালপাসম্পদের হাত ধরে যে ‘অর্থ’ এলো, তার পেছন পেছন হাজির হলো ‘অর্থের মূল্য’, যার অন্য নাম ‘সুদ’। সুদের ইতিহাস ও কাহিনী বস্তুতপক্ষে সম্পদ আর অর্থের মতোই রোমাঞ্চে ভরা। শেক্সপিয়রের কালজয়ী নাটক ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’ উদাহরণরূপে যথেষ্ট। ভেনিস হচ্ছে তখনকার ইউরোপের সবচেয়ে বিশ্বায়িত শহর এবং সেই যুগের অর্থ-সংক্রান্ত আদান-প্রদানের মুখ্য পরীক্ষাগার। ইহুদিরা হচ্ছে অর্থ-সংক্রান্ত যাবতীয় কায়-কারবারের প্রধান ব্যবস্থাপক। অর্থকে কতভাবে ব্যবহার করা যায় এবং এর থেকে কত প্রকারে মুনাফা হাসিল করা যায়, ইহুদিদের চেয়ে বেশি কেউ সেটা জানতে বা করতে পারে নি। দুঃখজনক হলেও এটাই সত্য যে, সুদের সঙ্গে সঙ্গে শোষণের সুপ্ত মন্ত্রটিকেও উন্মোচিত করে ইহুদিরাই।

ইতিহাস তারপর অর্থের মূল নিয়ামক হিসাবে দেখতে পেল ঋণকে। দেখা গেল, ঋণদানের ফলে অর্থ এক ধরনের ঝুঁকির সম্মুখীন। অতএব, সুদ নিতে হবে নিরাপত্তাস্বরূপ এবং এই সুদ অর্থের ঝুঁকিকেও স্থিতির মধ্যে রাখবে ও মুনাফার পথটিকেও খুলে দেবে। কিন্তু বাঁধা হয়ে দাঁড়াল ধর্ম। কারণ তখন পর্যন্ত খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীরা সুদের ব্যবসায় হাত লাগালে ধর্মচ্যুত হতেন। সমাধান সূত্র হাতে এগিয়ে আবারও এলো ইহুদি শাইলকরা। ইহুদি ধর্মগ্রন্থ ‘ওল্ড টেস্টামেণ্ট’-এ চতুর ধর্মগুরুরা লিখে দিয়েছেন: “অপরিচিত জনকে তুমি ঋণ দিতে পার সুদের ভিত্তিতে (upon usury), কিন্তু আপন ভ্রাতাকে সুদভিত্তিক ঋণদানে সদাই বিরত থাকিবে। ” অর্থাৎ শাইলকও কোন মহাজনী কারবার করতে পারতেন না অন্য কোনও ইহুদির সঙ্গে।

কিন্তু শেক্সপিয়র দেখালেন যে, খ্রিস্টান ও প্রেমে-পাগল ব্যাসানিওকে তিনি অবশ্যই সুদভিত্তিক সাহায্য করতে পারেন। ফলে ঋণগ্রহীতা হলেন ব্যাসানিওর বন্ধু সওদাগর অ্যানটোনিও। ঘটনার মধ্যে তথাপি একটি কিন্তু থেকে যাচ্ছে। কারণ অ্যানটোনিওর বাণিজ্যপোত ঘুরে বেড়ায় দেশ-বিদেশে। শেক্সপিয়রের ভাষায় সেখানে বইছে ‘perils of waters, winds and rocks’. অর্থাৎ সেই ঝুঁকি বহন করতে হলে অ্যানটোনিওকে একটি কড়া শর্ত পালন করতে হবে। ঋণশোধে অসমর্থ হলে শরীরের যে কোনও অংশ থেকে এক পাউন্ড মাংস খুবলে নেওয়ার স্বীকৃতি শাইলককে দিতে হবে। নাটকের নায়িকা পোর্শিয়ার বুদ্ধিমত্তা ও গল্পের সমস্যা সমাধান অর্থের ইতিবৃত্তে প্রাসঙ্গিক না-হলেও লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, বৈধ ঋণের মাধ্যমে অর্থের আদান-প্রদানের প্রতিষ্ঠান-পূর্ব বিবর্তন ধারার বিচিত্ররূপটি। জেনে রাখা ভালো যে, মধ্যযুগের ভেনিসের শাইলকরা আসন গ্রহণ করত তাদের জন্য নির্ধারিত বেঞ্চে, যার ইতালিয় নাম নধহপর. যেখান থেকেই প্রাতিষ্ঠানিক অর্থ-আদান-প্রদান সংস্থা ব্যাঙ্কের উদ্ভব।

ব্যাঙ্ক সৃষ্টির অনেক আগে থেকেই অবশ্য উত্তর ইতালির নগররাষ্ট্রগুলোতে তৈরি হয়েছে আরেক ধরনের ঋণপত্র, যার নাম বন্ড। যা ছিল সরকার বা বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের ঋণ সংগ্রহের হাতিয়ার। তাতে নিহিত রয়েছে ঋণদাতার প্রতি একটি নির্দিষ্ট হারে সুদ প্রদানের অঙ্গীকার, যা ‘কুপন রেট’ বলে পরিচিতি ছিল। কিন্তু এই অঙ্গীকারের বিশ্বাসযোগ্যতা কিংবা নির্দিষ্ট ‘কুপন রেট’ থাকলেও এমনটি তো নয় যে, সরকার ইত্যবসরে এত বেশি নোট ছাপাবে যার ফলে মুদ্রাস্ফীতির চোটে ওই সুদ তো হাওয়া হয়ে যাবেই, তদুপরি মূলধনেরও ক্ষয় হবে আরও কয়েক শতাংশ। এ ধরনের আশঙ্কা দেখা দিলেই বাজারে ওই বন্ডের দাম কমবে হু হু করে। আবার ঋণদাতার বিশ্বাসযোগ্যতা অটুট থাকলে ওই বন্ডেরই মূল্যমান হয়ে দাঁড়াবে বাজার-চালু নোটের চাইতেও আকর্ষণীয়। তখন বাড়তে থাকে বন্ডের বাজার-মূল্য বা ‘ইল্ড’। প্রকৃতপক্ষে ‘ইল্ড’ হচ্ছে অঙ্গীকৃত সুদ ও বাজার-মূল্যের একটি আনুপাতিক হিসাব। এরই ভিত্তিতে বোঝা যায়, দেশের অর্থনীতির বিশ্বাসযোগ্যতা ও দৃঢ়তা কতটুকু।

 

পরবর্তীতে দেখা যাচ্ছে, ব্যাঙ্ক শিল্পের প্রসারের হাত ধরে এসেছে স্টক বাজার। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং সদা-দোলাচলের এই শেয়ার বাজারের প্রহেলিকার সঙ্গে আধুনিক মানুষ মাত্রই পরিচিত। মুম্বই স্টক এক্সচেঞ্জের ৩০ শেয়ারের ইনডেক্স-কৃত সূচক, যা সেনসেক্স নামে পরিচিত, ছুঁয়েছিল ২১,০০০-এর উচ্চতা। বিশ্ব অর্থনীতির নাভীমূল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবপ্রাইম সঙ্কটের পরোয়া না-করে মুম্বই উচ্চতা ধরে রাখতে পারে নি। মাত্র দশ মাসের মাথায় সেনসেক্স নেমে আসে ৮৭০১-এ। শেয়ার বাজারে হঠাৎ রাজা আর অকস্মাৎ ফকির হওয়ার ঘটনা জুয়ার রোমাঞ্চকেও হার মানায়। এ নিয়ে দেশে দেশে আছে বহু কিংবদন্তি এবং বাস্তব উদাহরণ। মুদ্রা

বাংলাদেশের শেয়ার বাজারের নেপথ্য নানা কাহিনি উহ্য রেখে ধরা যাক জন ল-এর কথা। স্কটল্যান্ডের মানুষ জন ল একজন পাকা জুয়াড়ি, যিনি লন্ডনে এক প্রতিবেশীকে হত্যার দায়ে টাওয়ার কারাগারে দাখিল হন। কিন্তু অচীরেই জেল ভেঙে চলে এলেন বহুদূরের ভিন দেশ হল্যান্ডের রাজধানী অ্যামস্টারডামে। সেখানে তখন চলছে অর্থ-সংক্রান্ত ব্যাপারে হরেক রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। জন ল মুগ্ধ হয়ে যান শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে ওলন্দাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মূলধন সংগ্রহের অভিনবত্ব দেখে। অভিনবত্বটি কেবল বাজারে শেয়ার ছাড়ার মধ্যেই নিহিত নয়। ব্যাপারটি অভিনব এই জন্য যে, হাতে শেয়ার না-থাকলেও তা শয়ে শয়ে বিক্রি করা হয় এই আশায় যে, যখন ওই শেয়ারের ডেলিভারি দিতে হবে, তার মধ্যে শেয়ারের দাম যাবে পড়ে। তখন বাজার থেকে সস্তায় কিনে ডেলিভারি দিলেই চলবে। মাঝখানের ব্যবধানটি থাকবে নিজের পকেটে। জন ল অ্যামস্টারডামের আর্থিক বাজারের ভেলকিতে মোহিত হয়ে পৌঁছে যান ফ্রান্সে। এবং ভাগ্যের কি অপূর্ব লীলা! পরিশ্রম আর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে লাগাতে একদার জেল পলাতক ফেরারি জন ল হয়ে গেলেন ফ্রান্সের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের প্রধান! সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়েই তিনি বাজারে ছাড়তে শুরু করেন এমন এক নোট, যার কোন পূর্ব-নির্দিষ্ট রৌপ্য-মূল্য নেই। এক ঝটকায় ফ্রান্স চলে আসে ধাতব মুদ্রার জগত ছেড়ে কাগুজে অর্থের টালমাতাল আধুনিক-পর্বে। পরবর্তীকালে এহেন জন ল তৈরি করেন একের পর এক শেয়ার বাজারের ‘বুদবুদ’, যার মাধ্যমে ফরাসি অর্থনীতির তৎকালীন মন্দাও কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয়।

অর্থনীতির এই দোলাচল রাজনীতিকেও হামলা করে। ‘দ্য অ্যাসেন্ট অব মানি: এ ফিনানসিয়াল হিস্টরি অব দ্য ওয়াল্ডর্’ গ্রন্থের লেখক নায়াল ফার্গুসন জানাচ্ছেন যে, মন্দার উত্থান-পতন ঠেকাতে ফরাসি রাজতন্ত্র ব্যর্থ হওয়ার জন্যই ঘটে গেল ১৭৮৯ সালে বিশ্ববিখ্যাত ফরাসি বিপ্লব। অর্থাৎ নেপথ্যে জন ল না-থাকলে হয়ত ঘটতই না বাস্তিলের পতন। আমরা জানতে পেতাম না, সাম্য, মৈত্রী, ভ্রাতৃত্বের মতাদর্শ। এই হল অর্থের ইতিবাচক দিক।

অর্থ-সংক্রান্ত নেতিবাচক দিকও ইতিহাসের পাতায় কম লিপিবদ্ধ নেই। আজকের পৃথিবীর ইতিকথাতেও রয়েছে সেই অবক্ষয়ের ভাষ্য। কারণ আর্থিক জগতের নেতিবাচক তরঙ্গমালার প্রবাহ বর্তমান পৃথিবীতে বয়ে এনেছে এক তীব্র ও ভয়াবহ মন্দার প্রকোপ। যদিও পৃথিবীময় অর্থের যোগান বেড়েই চলেছে, তথাপি সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শেয়ারের মূল্য, গৃহের দাম এবং মানুষের আশা ও হতাশা।

পৃথিবী জর্জরিত হয়ে গেছে ঋণভারে। দশটি সবচেয়ে ধনী দেশের সরকারের মোট ঋণ, যা জনগণের কাছ থেকে সংগৃহীত, তা ২০০৭ সালে ছিল তাদের মোট জাতীয় উৎপাদনের শতকরা ৭৮ শতাংশ। ২০১৪ সালে সেটি হয়েছে কমপক্ষে ১১৪ শতাংশ। ওই দেশগুলোর প্রতিটি নাগরিকের জন্য মাথাপিছু সরকারি ঋণের পরিমাণ এখনই দাঁড়িয়েছে ৫০,০০০ ডালারে!

হাল আমলে এসে আবারও শোনা যাচ্ছে ‘বিশ্বমন্দা’র পদধ্বনি। ১৯৩০-এর দশকে যে ‘ডিপ্রেশান’ বা ‘মন্দা’ হয়েছিল, তা কাঁপিয়ে দেয় তাবৎ দুনিয়াকে। নানা পালাবদল আর পরিবর্তন এনে দেয় অর্থ সংক্রান্ত চিন্তা, ভাবনা আর দর্শনের জগতেও। আর বর্তমানের বিশ্ব অর্থনীতির স্নায়ুকেন্দ্র ‘ওয়াল স্ট্রিট’-এর ধসের কারণ হিসাবে ঋণের ভার নয়, দায়ী করা হচ্ছে শেয়ার বাজারের এক বিশেষ ধরনের ফাটকা খেলাকে, যার নাম ‘শর্ট সেল’। ইতিহাসের গভীর থেকে ঘটনাটির কার্যকারণ অনুসন্ধান করলে পাওয়া যায় এক চমৎকার ইতিবৃত্ত।

প্রায় তিন শ’ বছর আগেকার ঘটনা। ১৭২০ সালে ইংল্যান্ডের ‘সাউথ সি’ নামের এক কোম্পানি মুখ থুবড়ে পড়ল। বিশ্বের শেয়ার বাজারের ইতিহাসে ঘটনাটি ‘সাউথ সি বাবল’ নামে কুখ্যাত। কোম্পানিটি বুদবুদের মতো ফেটে যাওয়ায় বহু অর্থ লগ্নিকারী প্রচণ্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সর্বশ্রান্ত হন। হতভাগ্যদের লম্বা তালিকায় সমাজের খ্যাতনামা অনেক মানুষও ছিলেন। যেমন, গতিসূত্রের আবিষ্কারক স্যার আইজাক নিউটন। শেয়ার পতনে নিউটন সে যুগের কুড়ি হাজার পাউন্ড হারান। তাঁর মতো একজন হিসাবে-পারঙ্গম বিজ্ঞানীও কি তাহলে শেয়ারের দামের ভবিষ্যৎ বুঝতে পারেন নি, নাকি অঙ্ক কষতে ভুল করেছিলেন! খোদ নিউটনকে এমন প্রশ্নের মুখোমুখিও হতে হয়। জবাবে তিনি বলেন, “আমি গ্রহ-তারার নাড়িনক্ষত্রের হিসাব অঙ্ক কষে বলে দিতে পারি, কিন্তু অর্থ-সম্পদ নিয়ে মানুষের উন্মাদনার উন্মাতাল গতিবেগের কোনও হিসাব আমার কাছে নেই!”কাগজের নোট

২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি আন্তর্জাতিক কোম্পানি ‘লেম্যান ব্রাদার্স’-এর দেউলিয়া হওয়ার খবর শুনে অনেকেই ইতিহাসের পাতা থেকে ‘সাউথ সি বাবল’-এর কথা উত্থাপন করেন। অর্থের বিচিত্র খেলায় দুই বড় কোম্পানির বানের জলে ভেসে যাওয়া ছাড়া অবশ্য খুব একটা মিল এক্ষেত্রে নেই। তিন শ’ বছর আগে বাজার ছিল স্বাস্থ্যবান; তুলনায় এখন বিশ্বের বাজারে অর্থনৈতিক বিচিত্র গতির মাতাল হাওয়া বেশ চলছে। যেমন, হঠাৎ করে তেলের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে যাওয়ায় প্রায়-সব দেশেই মুদ্রাস্ফীতির হার ঊর্ধ্বগামী হয়, ইংল্যান্ডে সেটা চার শতাংশ আর ভারতে এগারো শতাংশ বৃদ্ধি পায়; নতুন চাকরির সম্ভাবনা কমে যায়; বিভিন্ন ব্যাঙ্ক ‘ক্রেডিট ক্রাঞ্চ’-এর জ্বরে ও উত্তাপে কাঁপতে থাকে।

অর্থনীতির বিশেষত্বই এমন যে, কালো রাত যত তাড়াতাড়ি আসে, আলোর দিনও চলে আসে তারচেয়েও দ্রুত। অর্থের খেলায় দুঃসময় চক্রবৎ পরিবর্তিত হয়।

আশা দেখা যায় যে, তেলের দাম ধীরে ধীরে কমবে এবং সেই সঙ্গে বাজারও চাঙ্গা হয়ে উঠবে। মামুলি আদার ব্যাপারী থেকে জাহাজের ব্যবসায়ী, ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই আশায় বুক বাঁধেন। এমন সময় লেম্যান ব্রাদার্সের পতনের সঙ্গে সঙ্গে ওয়াল স্ট্রিটে জোরালো ধস নামলো। ব্যাস, আমেরিকা থেকে ইউরোপ হয়ে ভারত, সিঙ্গাপুর, জাপান, এমন কি বাংলাদেশেও শুরু হয়ে গেল ধসের তাণ্ডব। আমেরিকায় মেরিল লিঞ্চ, বিলাতের হ্যালিফ্যাক্স-এর হাতবদল হলো। মাত্র চার দিনের শেয়ারের দর পড়ে মর্গান স্ট্যানলির মতো জগতখ্যাত ব্যাঙ্কের ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াল কুড়ি বিলিয়ন ডলার!

বাজারের এই শোচনীয় অবস্থা দেখে বিশ্ব পুঁজিপতিরা চুপ করে বসে থাকতে পারেন না। বিশ্ব অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক উন্নত দেশগুলোর খোদ সরকারই ধস ঠেকাতে হাল ধরতে উদ্যোগী হলো। বিলেতে গর্ডন ব্রাউন হ্যালিফ্যাক্সের হাত বদলের কাজে দেশের বিদ্যমান নিয়ম শিথিল করার মাধ্যমে সহায়তা করলেন। আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক বা ‘ফেডারেল রিজার্ভ’ গোল্ডম্যান স্যাক্স এবং মর্গান স্ট্যানলির দায়ভার নিজের কাঁধে তুলে নিলো। বার্কলেজ পিএলসি-এর মালিকানায় বার্কলেজ ক্যাপিটাল নাম নিয়ে নতুন করে খুললো লেম্যান ব্রাদার্স। এই ব্যাঙ্ক দু‘টি এখন মুক্ত বাজারের জনক আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের প্রত্যক্ষ দায়িত্ব ও নিয়ন্ত্রণের অধীন। এবং সবচেয়ে বড় খবর হলো, বিলেতের শেয়ার বাজারে ‘শর্ট সেল’ নিষিদ্ধ হলো।

কী এই ‘শর্ট সেল’, যাকে নিয়ে এতো হৈচৈ আর সর্তকতা! শেয়ার বাজারের ধসের পেছনে একেই কারণ হিসাবে পাকড়াও করা হলো! আসলে এ যাবতকালে বিশ্বজুড়ে নগদ অর্থের বাজারে মন্দা বা ‘ক্রেডিট ক্রাঞ্চ’-এর জন্য ব্যাঙ্কগুলোকেই দায়ী করা হতো। বলা হতো, ব্যাঙ্কগুলো অধমর্ণের পরিচয় না জেনে, বাছ-বিচার না করেই ঋণ প্রদানের মাধ্যমে বারোটা বাজাচ্ছে। এখন অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, ব্যাঙ্কের ভুল-ঋণজনিত বোঝা নয়, শেয়ার বাজারের ফাটকা খেলাই সবাইকে ডুবিয়েছে, যার নাম ‘শর্ট সেল’।

লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, যে-কোনও পণ্যের মতো শেয়ারের দাম নির্ভর করে চাহিদা আর যোগানের মাত্রার উপর। যে কারণে চাহিদার চেয়ে অধিক যোগান থাকায় অতিপ্রয়োজনীয় পানি বা বাতাসের কোন উচ্চমূল্য নেই। আবার প্রয়োজনীয় না-হওয়া সত্ত্বেও চাহিদার চেয়ে যোগান কম বলে স্বর্ণ বা হীরকের অতি উচ্চমূল্য বিরাজমান। তবে, অন্য সাধারণ পণ্যদ্রব্যের সঙ্গে শেয়ারের একটি সূক্ষ্ম তফাত এই বাজারকে আলাদাভাবে চিনিয়ে দেয়। বাজারের একদিকে যেমন শেয়ারের দাম বুঝে ক্রেতা-বিক্রেতারা কিনবেন না বেচবেন তা স্থির করেন, অন্যদিকে আবার শেয়ারের দামও নির্ভর করে কতটা কেনাবেচা হলো তার উপর। অর্থাৎ, কেনাবেচার মাধ্যমে খুব তাড়াতাড়ি শেয়ারের দাম বদল করা যায়। অন্যভাবে বললে, বাজারে কৃত্রিমভাবে ধস নামানো যায়। আর এ কাজে ‘শর্ট সেল’-এর জুড়ি নেই।

ধরুন, আপনার কাছে আছে এমন কোনও বিশেষ শেয়ার, যার দাম এখন বেশ চড়া, কেনার জন্য মোটা খদ্দেরও জুটেছে, স্থির করলেন এইবেলা শেয়ার বেচবেন। কিন্তু বেচতে গিয়ে দেখলেন, খদ্দের যতটা চান ততগুলো শেয়ার আপনার কাছে নেই, তবে আপনার বন্ধুর কাছে আছে। তখন, বন্ধুর কাছ থেকে তার শেয়ারগুলো ধার নিয়ে সব একসঙ্গে বেচে দিলেন। এবার বন্ধুকে তো আগামীকাল শেয়ারগুলো ফেরত দিতে হবে, সেটা কোথায় পাবেন! ধরুন, সেই পরিমাণ শেয়ার কাল বাজার থেকে আপনি আবার কিনে যদি বন্ধুকে ফেরত দিয়ে দেন, তাহলেই তো ল্যাঠা চুকে গেলো। এতে গোপনে আপনার জন্য লুকিয়ে রয়েছে লাভ। যদি আগামীকাল ওই শেয়ারের দাম কম হয় তবেই কিন্তু আপনার ভাগ্যে জুটবে লুক্কায়িত লভ্যাংশ। তাহলে আজকের শেয়ার বেচার টাকায় কাল একই শেয়ার কিনেও আপনি বুদ্ধিমান পিঁপড়ের মতো লাভের গুড় খেতে পারেন। একেই বলে ‘শর্ট সেল’।

মুশকিল হলো, এই ‘শর্ট সেল’ শুধু এক-আধজন না করে সকলে মিলে করলে তো বাজারে সত্যি সত্যি সব শেয়ারের দাম হুড়হুড় করে নেমে যাবে, বাজারে ধস নামবে। আপনার লাভ হবে, এই লাভের ফল ভুগবে আর সকলেই। প্রতিষ্ঠিত সত্য ‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু’, এই হলো ‘শর্ট সেল’-এর অবধারিত পরিণাম। তবুও কী মানুষ অর্থের চক্কর থেকে ভয় পেয়ে সরে আসে! সত্যিই মানবমন বড় বিচিত্র! এর এক অংশের (মানবী) মন ও চরিত্র ‘দেব ন জানন্তি’ তথা দেবতারও অজানা! অর্থকে ঘিরে বিচিত্র মানবমনের হদিশ নিউটন ন জানন্তি। কুতোঃ আজকের অত্যাধুনিক অর্থনীতিবিদ-মনোবিজ্ঞানীরা!

এরপরও কি কেউ বলতে পিছ পা হবে যে, ‘অর্থই সকল অনর্থের মূল। ’ আসলে যত সম্পদ, ততই বিড়ম্বনা। যেমনটি বলেছেন এক দার্শনিক, ‘মোর অসেট মিনস মোর লায়বিলিটিজ’।

বাংলাদেশ সময়: ১১০০ ঘণ্টা, জুলাই ২২, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।