মা তাকে প্রায়ই বলতো, তুমি ছোটবেলায় এতো প্রশ্ন করতে, এতো তোমার জানার আগ্রহ ছিল।
যখন আরিয়ান একটু বড় হলো, স্কুলে শিক্ষকদের প্রশ্ন করতো আর হাসিমুখে উত্তর পেতো।
স্কুলের অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রেও একই ধারা। প্রধান শিক্ষকের কড়া নির্দেশ, কোন প্রকার পশ্ন করা যাবে না। একদম মুখবন্ধ করে বসে থাকতে হবে রোবটের মতো। মাধ্যমিকে শুরু হওয়া প্রশ্ন না করার শর্ত চলমান থাকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন পর্যন্ত।
আরিয়ানের মনে আজ খুশির জোয়ার বইছে। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে আজ সে কর্মজীবন শুরু করতে যাচ্ছে। কর্মজীবনের এক সপ্তাহ ভালোই কাটলো। একসপ্তাহ পর সে তার সেই চিরচেনা ধাক্কাটি খেলো। কোন এক মিটিংয়ে আরিয়ান তার শৈশব সুলভ আচরণ করলো, মানে একাধিক প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করে ফেলল। মিটিং শেষে বসের কামরায় ডাক পড়লো। এরপর তাকে যা বলা হলো সেগুলো শুনে তার সেই মাধ্যমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কথাই মনে পড়ে গেল।
নির্মম সত্য হচ্ছে, এটা শুধু আরিয়ানের গল্প নয়। এরকম হাজারো আরিয়ানের গল্প ছড়িয়ে আছে পথে ঘাটে।
চীনা প্রবাদ প্রচলিত আছে ‘যিনি প্রশ্ন করেন তিনি পাঁচ মিনিটের জন্য বোকা থাকেন; আর যিনি প্রশ্ন করেন না তিনি চিরদিনের জন্য বোকা থাকেন’। আমরা যদি উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকাই, তাহলে দেখবো শিশুবয়স থেকে তাদের বাচ্চাদের শেখানো হয় কিভাবে প্রশ্ন করতে হয়। ভালো প্রশ্ন করলে রিতিমতো বাহবা। ভুল প্রশ্ন করা হলে এমনভাবে শুধরে দেওয়া হয় যাতে ভবিষ্যতে লজ্জাবোধ করে প্রশ্ন করা বন্ধ করে না দেয়। তাইতো উন্নত দেশের উদ্ভাবকরা তাদের উদ্ভাবিত ধারণা শিশুদের সাথে শেয়ার করেন। তারা উভয়ই প্রশ্ন-উত্তরের মাধ্যমে শেখার চেষ্টা করেন। শেখার সবচেয়ে সহজ এবং কার্যকর উপায় হচ্ছে প্রশ্ন করা।
ছোটবেলায় আমরা হাজারো প্রশ্নের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করেছি। কিন্তু যত আমাদের বয়স বেড়েছে, তত আমরা লজ্জবোধ থেকেই হোক আর সমাজ ব্যবস্থার কারণেই হোক, প্রশ্ন করা ভুলে গেছি। প্রশ্ন করার ব্যাপারে আমাদের যতোটা গুরুত্ব দেওয়া দরকার আমরা সেটা দিচ্ছি না। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি ছোট-বড় কোম্পানি কোথাও প্রশ্ন করার উপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। আর একটা থিওরি প্রচলিত আছে- ‘যদি টেকসই সমাজ গড়তে চাও তাহলে শতকরা ৮০ ভাগ সময় ব্যয় করো প্রশ্ন-উত্তরে, আর বাকি ২০ শতাংশ ব্যয় করো গড়তে’।
পৃথিবীতে বর্তমানে আমাদের সামনে যা কিছু আছে সবই হয়েছে কারো না কারো প্রশ্ন করার কারণে। নিউটন যদি আপেলটি পড়ার পর প্রশ্ন না করে খেয়ে ফেলতেন, তাহলে কি হতো? ‘উদ্ভাবনী চিন্তাবিদদের সবচেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ অভ্যাস হচ্ছে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা’- কথাটি বলেছেন উদ্ভাবনের উপর যুক্তরাজ্যের শীর্ষস্থানীয় বক্তা পল স্লোনি। বাংলাদেশের অত্যন্ত গুণি একজন শিক্ষাবিদ ডঃ ইউসুফ এম ইসলাম তার প্রশ্নের প্রয়োজনীয়তা শীর্ষক একটি প্রবন্ধে উল্ল্যেখ করেছেন, ‘একজন মানুষ লিখতে পড়তে না পারলেও জ্ঞান অর্জনে কোন সমস্যা হবে না যদি সে প্রশ্ন করার অভ্যাস সাথে নিয়ে চলতে পারে’।
এ
কটি বিষয় খুব সহজেই উপলব্ধি করা যায় আর সেটা হলো, জীবনের নিদির্ষ্ট গন্তব্যে পৌঁছুতে হলে প্রশ্ন জিজ্ঞাসার বিকল্প কিছু নেই। এখন আসি প্রশ্ন করার অন্তর্নিহিত উপকারিতা গুলো কি?
• প্রশ্ন করার মাধ্যমেই আমরা জীবন সম্পর্কে জানতে পারি এবং এটা বৈজ্ঞানিক ভাবেও প্রমাণিত। শিশুরা সাধারণত বিশ্ব সম্পর্কে শিখতে শুরু করে শুধু একটি প্রশ্ন করে, আর সেটা হলো ‘কেন’।
• আমরা যত বেশি প্রশ্ন করবো, তত দ্রুত ভালো উত্তর পেয়ে যাবো। শিশুকালে আমরা তাই করেছি, কিন্তু দুঃখের বিষয় বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমরা ‘কেন’ এবং এর উত্তরের জন্য অপেক্ষা করা ভুলে গেছি।
• আমাদের জীবনের গুণগতমান নির্ভর করে প্রশ্নের উপর, কারণ আমাদের চিন্তাভাবনার গুণগত মান নির্ভর করবে আমাদের প্রশ্নের গুণগত মানের উপর। আর আমাদের চিন্তাভাবনার গুণগতমান বৃদ্ধির উপর জীবনের
মান নির্ভরশীল। আর প্রশ্ন করা ভুলে গেছি বলেই প্রশ্নের মান বৃদ্ধিও হচ্ছে না।
• প্রশ্ন করার অভ্যাস আমাদের উস্মুক্ত করে, উদারপন্থি করে।
• আমাদের জীবনকে সুখময় করার একমাত্র উপায় হচ্ছে সঠিক সময়ে সঠিক প্রশ্ন।
আমাদের সমাজকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে হলে, আমাদের যুব সমাজকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে হলে আমাদের প্রশ্ন করার উপর জোর দিতে হবে। আর সেটার শুরা এবং যত্ন শিশুবয়স থেকেই করতে হবে।
প্রশ্ন দুভাবে করা যায়। নেতিবাচক অর্থে, আবার ইতিবাচকভাবেও প্রশ্ন করা সম্ভব। আমাদের সকলেরই উচিত ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে প্রশ্ন করা। ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে প্রশ্ন করতে হলে দুটি বিষয় অত্যন্ত জরুরি। একটি হলো, জানার আগ্রহ এবং অপরটি হলো শোনার আগ্রহ। আর এই দু’টি বিষয়কে মাথায় রেখে আমরা যখন প্রশ্ন করবো, তখন যে কোনো সৃষ্টি আমাদের জন্য সহজ ও দ্রুত হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৩২৫ ঘণ্টা, জুলাই ২৬, ২০১৭
জেডএম/