ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

প্রফেসর মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান স্যার

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৪২ ঘণ্টা, জুলাই ২৮, ২০১৭
প্রফেসর মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান স্যার

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান স্যার। তিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০ জুলাই ১৯৯৭ সালে ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে যোগদান করেন। তিনি শাবিতে প্রফেসর পদে যোগদানের পূর্বে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

তিনি ১৯৬৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। ১৯৮৯ সালে তিনি রাবিতে প্রফেসর পদে নিয়োগ লাভ করেন।

ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির কার্যক্রমে তার সরব উপস্থিতি ছিল। এক পর্যায়ে তিনি রাবির শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক পদে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন।  

বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী বৃহত্তর সিলেটের এ কৃতি সন্তান হবিগঞ্জ জেলার নবিগঞ্জ উপজেলায় ১৯৪২ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে যোগদানের আগে তিনি শাবির প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন। তিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর, বিভাগীয় প্রধান, রেজিস্ট্রার ও ডিনের দায়িত্ব পালন করেন।

শাবির ভাইস-চ্যান্সেলর হিসেবে তার একান্ত প্রচেষ্টা ও শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্মিলিত প্রয়াসে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম বৃদ্ধি পায়। এক্ষেত্রে ছাত্র-ছাত্রীদেরও ভালো ভূমিকা রয়েছে।

হযরত শাহজালাল (র.) এর স্মৃতি বিজড়িত অপূর্ব নৈসর্গিক সৌন্দর্যমন্ডিত এ বিশ্ববিদ্যালয় সিলেটবাসীর দীর্ঘদিনের সংগ্রাম এবং প্রচেষ্টার ফসল।

সিলেটের রাজনীতিবিদগণ ও সর্বস্তরের মানুষ এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছেন। জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী এ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য যে অবদান রেখেছেন তা অনস্বীকার্য। এটি আমাদের অহংকার ও ভালোবাসার প্রতীক। সারাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর মধ্যে শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে এ বিশ্ববিদ্যালয় গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ধরে রেখেছে।

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান স্যারের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আমার ঘনিষ্ট হবার সুযোগ ছিল। স্যারকে পারিবারিকভাবে ও সিলেটের কৃতি সন্তান হিসেবে চিনতাম। স্যার ১৯ জুলাই ২০০১ সালে ভাইস-চ্যান্সেলরের মেয়াদ শেষ করে এ বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রফেসর হিসেবে কাজ করে যান। আমি স্যারের সময়ে ২০০০ সালের নভেম্বর মাসে সহকারী রেজিস্ট্রার পদে প্রমোশন পাই।  

স্যার একজন আদর্শ শিক্ষক, দক্ষ প্রশাসক ও সাদামনের চমৎকার মানুষ ছিলেন। তার কাছে কোনভাবে যেতে পারলে খুব সহজে সিদ্ধান্ত পাওয়া যেতো। ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থরক্ষাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন। এজন্য অনেক সময় তাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। আন্দোলন সংগ্রামের মুখেও তিনি তার নীতি থেকে সরে আসতেন না।

আমাদের স্যার প্রগতিশীল চিন্তা চেতনার ধারক ও বাহক ছিলেন। জীবনের সর্বক্ষেত্রে সফল এ কৃতি পুরুষের নানাবিধ কার্যক্রমের পরিধি ছিল ব্যাপক ও বিস্তৃত। তিনি শাবিকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতেন। স্যারের কথা আমার ভালোলাগতো। ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব পালনকালীন কথা বলতে গিয়ে তিনি প্রায় সময়ই খোলামেলাভাবে বলতেন, ‘আমি যা করেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থেই করেছি। ’

স্যার খুবই সাহসী ও দৃঢ় চিন্তা চেতনার আদর্শ মানুষ ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে তিনি সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেন। ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান স্যার ছিলেন একজন সফল প্রশাসক। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট দূরীকরণের স্বার্থে তিনি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

স্যারের সময় শাবির শিক্ষাকার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চললেও নামকরণ বিরোধী আন্দোলনের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রা সাময়িকভাবে ব্যহত হয়। অবশ্য একপর্যায়ে রাষ্ট্রপতি ও চ্যান্সেলরের হস্তক্ষেপে নামকরণ কার্যক্রম স্থগিত হয় এবং নামকরণ বিরোধী আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে।

ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান স্যারের সময়ে ১৯৯৮ সালের ২৯ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। সমাবর্তন বক্তা ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী। প্রফেসর মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান স্যার সমাবর্তন সভায় শাবি প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বিভিন্ন সময়ে ভূমিকা পালনকারী স্থানীয় ও জাতীয় নেতাদের অবদানের কথা গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। স্যারের সময় শাবির কোষাধ্যক্ষ পদে ছিলেন প্রফেসর আব্দুল আজিজ স্যার। রেজিস্ট্রার ও পরীক্ষানিয়ন্ত্রক হিসেবে জনাব জামিল আহমদ চৌধুরী এবং ছালিকুর রহমান চৌধুরী স্যার দায়িত্ব পালন করেন। অবশ্য এ দু’জন স্যারই ওই পদ সমূহে সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. সৈয়দ মহিব উদ্দিন আহমেদ স্যারের সময়ে নিয়োগ লাভ করেন।  

প্রফেসর মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান স্যার ২০০২ সালে শাবি থেকে অবসর গ্রহণের পর সিলেট মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটিতে যোগদান করেন। মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্যার এ দেশের তিন তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সদস্য। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষাকার্যক্রমে তার যথেষ্ট অবদান রয়েছে।  

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি খুবই বিনয়ী ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। স্যার বিশ্ববিদ্যালয়ে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সিলেটের প্রগতিশীল আন্দোলন সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন। এ ছাড়াও তিনি বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকতেন।

স্যার চমৎকার ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর পদে থাকাকালীন স্যারের সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ আমার হয়। আমার ব্যক্তি জীবনের কয়েকটি ঘটনা স্যারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ অনেক বাড়িয়ে দেয়। কিছু ঘটনার কথা না বলে পারছিনা। ২০০০ সালের একটি পর্যায়ে সহকারী পরীক্ষানিয়ন্ত্রক পদের বিজ্ঞপ্তি হলেও সহকারী রেজিস্ট্রার পদ তখনও বিজ্ঞাপিত হয়নি। আমি একদিন স্যারের সঙ্গে দেখা করে সহকারী রেজিস্ট্রার পদে আমার যোগ্যতা অর্জনের বিষয়টি অবহিত করি। বড়ই আশ্চর্যের বিষয় হলো, প্রিয় স্যারকে অবহিত করে নীচতলায় আমার অফিসকক্ষে আসতে না আসতেই শুনতে পাই, আমার ব্যক্তিগত নথিতে স্যার সহকারী রেজিস্ট্রার পদে বিজ্ঞপ্তির সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।  

স্যার তখন শাবিতে ভাইস চ্যান্সেলর। বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত একটি সভায় অতিথি হিসেবে যোগ দিতে যান। ওই সভায় ম্যাজিস্ট্রেট পদে কর্মরত আমার ইমিডিয়েট বড় আমিন ভাইকে পেয়ে প্রসঙ্গক্রমে আমার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। আমি সত্যিকার অর্থে বুঝিনি স্যার আমার উপর কেন এতো সন্তুষ্ট ছিলেন। কিন্তু এ ঘটনা ভাই থেকে শুনে আমি খুবই খুশি হই এবং পরবর্তীতে স্যারের সঙ্গে দেখা হলে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই।

শাবির সাবেক ভাই চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. সৈয়দ মুহিব উদ্দিন আহমেদ স্যারের সঙ্গে গত ২৫ এপ্রিল দেখা করতে গেলে তিনি প্রফেসর মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান স্যারের প্রশংসা করে বলেন, ‘তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল চমৎকার। ’

স্যার সাংসারিক জীবনেও ছিলেন অত্যন্ত সফল। তার ছেলে মেয়েরা উচ্চশিক্ষিত ও সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত। স্যারের সহধর্মিণী বেগম মমতাজ সুলতানা স্যারকে নিয়ে প্রকাশিত স্মারকগ্রন্থে স্যার সম্পর্কে অনেক কথাই বলেন। তিনি স্যারের মৃত্যুদৃশ্যের বর্ণনা করেন মর্মস্পর্শী ভাষায়: ২৭ জুলাই ২০০৬, নীরবে কাউকে না জানিয়ে এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। আমার কাঁধে মাথা রেখে চুপচাপ চলে গেলেন, আমি বুঝতেও পারলাম না। আমার অতি আপনজন, আমার অভিভাবক, আমার চিরজীবনের সঙ্গী আমাকে কিছু না বলে, নিরুদ্দেশের উদ্দেশে পাড়ি দিলেন।

এ বক্তব্য থেকে স্যারের প্রতি তার ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ সহজেই অনুমেয়। স্যারের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে আমি দ্রুত তার বাসায় যাই। পর্যায়ক্রমে সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের অনেকেই উপস্থিত হন। সিলেট শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গকে স্যারের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে উপস্থিত থাকতে দেখা যায়।

২৭ জুলাই স্যারের মৃত্যু দিবস। বর্তমান সময়ে স্যারের মতো আদর্শ শিক্ষাবিদ ও দক্ষ প্রশাসকের খুব প্রয়োজন। দোয়া করি, মহান আল্লাহ তা’য়ালা স্যারের ভুলত্রুটি ক্ষমা করে তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন, আমিন।  

সৈয়দ ছলিম মোহাম্মদ আব্দুল কাদির
অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৩২ ঘণ্টা, জুলাই ২৮, ২০১৭
এসএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।