মহউদ্দিনই ছিল আমার প্রথম নিয়মিত থিসিস স্টুডেন্ট। এর আগে আবদুল গফুরের (এখন উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল গফুর) থিসিসের কাজ আমি আন-অফিসিয়ালি দেখিয়ে দিয়েছি।
ছাত্রটিকে কয়েকদিন চট্টগ্রাম শহরের ষোলশহর এলাকার বন গবেষণাগারে নিয়ে গেলাম। বন গবেষণাগারের একটি ভাল লাইব্রেরি আছে। সেখানে কয়েকদিন কাজ করলাম। বন বিভাগ কর্তৃক প্রস্তুত করা বিভিন্ন এলাকার ওয়ার্কিং প্লান দেখে নমুনা সংগ্রহের সাইটগুলো নির্বাচন করলাম। বন গবেষণাগারের সয়েলস ডিভিশনে গিয়ে আমাদের নির্বাচিত সাইটগুলোর মাটির বৈশিষ্টের কোন তথ্য আছে কিনা খোঁজ নিলাম। কোন তথ্য পাওয়া গেল না। সেখানকার একজন রিসার্চ অফিসার আমাকে বললেন, “বন গবেষণাগারে কোন গবেষণা নাই। গবেষণা করে কোন লাভ নাই, অভিজ্ঞতা বা যোগ্যতা নির্ধারণে গবেষণার কোন বিবেচনা নাই, আর্টিকেল প্রকাশনার জন্য কোন ইনক্রিমেন্ট নাই। ১০/১২ বছরেও কারো প্রমোশন হয় না। কোন ইন্সেন্টিভ নাই। ”
দেখলাম বাংলাদেশের অন্য অনেক গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বাংলাদেশ রাইচ রিসার্চ ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ এগ্রিকালচারাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ জুট রিসার্চ ইনস্টিটিউট ও ICDDRB বাদে) মতই এখানকার অবস্থা। মনে পড়ল, ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে আমাদের একজন স্যার মাইক্রোবায়োলজি পড়াতে গিয়ে বলেছিলেন, “আমরা ল্যাবরেটরিতে যে রেক্টিফায়েড স্পিরিট ব্যবহার করি তা ঈশ্বরদীর কেরু কোস্পানি তৈরি করে। তারা ঝোলা গুড় থেকে ফার্মেন্টেশন করে হুইস্কিও বানায়, বাংলাদেশের বড় বড় হোটেলে বিক্রি হয়, বড় বড় লোকেরা খায়। আর দেখ আমাদের বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ; বিশাল এলাকা, ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে কয়েক বর্গকিলোমিটার জায়গা দখল করে আছে, সাইন্স ল্যাবরেটরি। তাদের একটি সাব-স্টেশনও আছে চট্টগ্রামে। এতো বিশাল স্থাপনা নিয়ে তারা আচার বানায়, ডাবের পানি প্রক্রিয়াজত করে। কেউ খায় না। কোটি কোটি টাকা খরচ করে তারা এ সব করে। গিয়ে দেখ, কোন কাজ কাম নাই। একটা ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রসেসিং এর নাম শুনেছ যেটা তারা তৈরি করেছে?” (এটা ১৯৭৩ সালের কথা; এখন পরিস্থিতির কোন উন্নতি হয়েছে কিনা জানা নেই)।
আমার ভগ্নিপতি ও তিন জন বন্ধু চাকরি করতেন বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনস্ত মৃত্তিকা গবেষণাগারে। ঢাকার গ্রিন রোডে ছিল তাদের ল্যাবরেটরি। বিশাল কম্পাউন্ডের মধ্যে এক তলা ইটের তৈরি টিনের ছাদ দেয়া লম্বা একটি শেড। কম্পাউন্ডের ভেতর ভাঙ্গা-চোরা কয়েকটি পিক-আপ পড়ে আছে। ল্যাবরেটরি বলে চেনার কোন উপায় নাই; মনে হত পুরনো কোন গুদাম বা আনসারদের ব্যারাক। আমি ঢাকা গেলে সেখানে একবার ঢুঁ মারতাম। আমি দশ বছরে একদিনও কোন গবেষণা অফিসারকে সেই ল্যাবে কোন নমুনা বিশ্লেষণের কাজ করতে দেখি নাই। কয়েকটি পুরনো পলিব্যাগে ও প্লাস্টিক বোতলে অবশ্য মাটির নমুনা কিছু দেখা যেত।
প্রায়ই শুনতাম তারা ট্যুর এর পরিকল্পনা করছেন; নোয়াখালীর চরাঞ্চলের বেড়ী বাঁধ এলাকার কৃষি জমির সেচ সংক্রান্ত সার্ভে। এতে টিএ. ডিএ. হতো। আমার ভগ্নিপতি (প্রয়াত; তিনি আমার বন্ধুও ছিলেন) সেই ল্যাবরেটরির ডাইরেক্টর হয়েছিলেন। পত্রিকা পড়া, ফাইলে কিছু সই করা এবং অধস্তনদের দিয়ে টাইপ করিয়ে কিছু প্রিন্ট করিয়ে নেওয়া ছাড়া কোন কাজ করতে আমি দেখতাম না। একবার তাকে আমি বললাম, “তোরা এই সব কি করিস?” সে মহাক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে বলল, “ফুটানি কইরো না, তোমরা ইউনিভার্সিটির মাস্টাররা কি কর আমি দেখি নাই? আমি ইউনভার্সিটিতে পড়ি নাই? একজনের আর্টিকেলের মধ্যে আর এক জনের নাম ঢুকাইয়া দেও। সব সাধু আর কি?” আর কোন কথা চলে না; এরা একটা ভাত টিপে হাঁড়ির সব ভাতের খবর নিতে অভ্যস্ত।
যা হোক, যাবতীয় প্রস্তুতি শেষ করে আমি, মহিউদ্দিন ও তার এক বন্ধু মনজুর আলম তরফদার (প্রয়াত) নমুনা সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন ফরেস্ট এলাকায় যেতে শুরু করলাম। চুনতি, দুলাহাজারা, টেকনাফ, বান্দরবান, করেরহাট। প্রতিটি স্থানে বন বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা আমাদের অভাবনীয় সহযোগিতা করলেন। থাকতাম বন বিভাগের গেস্ট হাউসে, সেখানেই বাবুর্চীরা রান্না করে দিতেন। সরকারি রেটে খুব অল্প ভাড়ায় থাকা এবং সস্তায় খাওয়া যেত। আমরা খুব সকালে একটি ব্যাগে পাউরুটি, কলা, ডিম, পলিথিন ব্যাগ এবং একটি অগার (মাটি খোঁড়ার যন্ত্র) নিয়ে বনের মধ্যে ঢুকতাম এবং মাটি ও সেগুনের পাতার নমুনা সংগ্রহ করে দিন শেষে সন্ধ্যায় ক্লান্ত হয়ে ফিরতাম। রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর আমরা নমুনা গুলো ঠিক-ঠাক গুছিয়ে রাখতাম এবং পরের দিনের কাজের প্রস্তুতি নিতাম। ছাত্রদের মত আমিও তখন যুবক ছিলাম। মহা উৎসাহে আমরা কাজ করতাম। আমি গভীর আগ্রহে বন ও বন ব্যবস্থাপনা দেখতাম। নার্সারিতে কী ভাবে পলিথিনে ভরার জন্য মাটি তৈরি করে, কি ভাবে সেড তৈরি করে ও মাটি ভরা ব্যাগ সারি করে সাজানো হয়, কী ভাবে বীজ বসানো হয়, জমি তৈরি করা হয় ও চারা লাগানো হয় সব আমি মনোযোগ দিয়ে দেখতাম। ২০১৩ সালে ফরেস্ট সয়েলস (Forest Soils) নামে আমার একটি বই ইউরোপ থেকে প্রকাশনী সংস্থা স্প্রিঙ্গার (Springer Science + Business media, Dordrecht, Netherlands) প্রকাশ করে। মহিউদ্দিন ও তার পরবর্তী অনেক ছাত্রকে নিয়ে বনে বাদাড়ে ঘোরার অভিজ্ঞতা আমার এ বইটি লেখার সময় কাজে লেগেছিল।
বিভিন্ন সাইটে মহিউদ্দিনের নমুনা সংগ্রহের জন্য আমরা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করতাম। এক এক এলাকায় ৩/৪ দিন থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হত। মাটি ও সেগুনের পাতার নমুনা বস্তায় ভরে বাসের ছাদে তুলে নিয়ে এসে পরে রিকশায় করে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ল্যাবরেটরীতে নিয়া আসতাম। পরিশ্রম ছিল, কিন্তু আমরা তা গায়ে মাখতাম না। অন্য সাইটগুলোর কাজ শেষ করে আমরা সব শেষে গেলাম করেরহাটে। চট্টগ্রাম থেকে ফেনী যাওয়ার পথে বারইয়ার হাট নামক একটা জায়গায় পৌছে বাঁ হাতে রামগড়ের দিকে যে রাস্তাটি গেছে তা ধরে ৭/৮ কিলোমিটার গেলে করেরহাট পৌছা যায়। করেরহাটে ৩/৪ দিন কাজ করে একদিন সন্ধ্যায় আমরা ৫/৬টি বস্তা নিয়ে বারইয়ার হাট বাস স্ট্যান্ডে এসে সমস্যায় পড়ে গেলাম। একজন কুলি বা সাহায্যকারী পাচ্ছি না যে বস্তাগুলো বাসের ছাদে তুলব। বাসের কনডাক্টর এতগুলো বস্তা নিতে আগ্রহ দেখাল না। আমরা সবাই খুবই ক্লান্ত। এদিকে রাত বাড়ছে। আমাদের সেদিন ফিরতেই হবে। কিছুক্ষণ পর দেখলাম ভিখারী শ্রেণীর একজন মানুষ আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। আগোছালো বেশ, উদ্ভ্রান্ত চেহারা। আমরা ভাবলাম তার সাহায্য নিতে পারব। লোকটা এগিয়ে এসে হাত পেতে টাকা চাইল। আমরা বললাম আমাদের বস্তাগুলো বাসের ছাদে তুলে দিলে তাকে ভাল টাকা দেব। সে শূন্য দৃষ্টিতে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, “আঁই কাম হারিও নো, হরিও নো”। আমি, মহিউদ্দিন ও মনজুর আলম তরফদার একে অন্যের দিকে তাকালাম, এবং উচ্চস্বরে হেসে উঠলাম।
তেত্তিশ বছর আগের ঘটনা এটি। কিন্তু এখনো এ ঘটনা মনে হলে আমার বেদম হাসি পায়। মনে মনে ভাবি, আমরা যারা বিশ্ববিদ্যলয়ে শিক্ষকতা করি তাদের মধ্যেও অনেকে আছি যারা ‘কাম হারিও নো, হরিও নো’। কি করি? স্রেফ দলবাজি আর ধান্দাবাজি। কেউ কেউ আছি সব কিছু সহজে চাই। এবং কি আশ্চর্য, পেয়েও যাই।
ড. খান তৌহিদ ওসমান: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪০ ঘণ্টা, আগস্ট ৮, ২০১৭
জেডএম/