টাইম সাময়িকী ইউএসএ-এর ভাষায়, “সন্দেহাতীতভাবেই মুজিবের উদ্দেশ্য ছিলো তার দেশ ও দেশের মানুষের উন্নয়ন ঘটানো। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মুজিব একটা ‘সোনার বাংলা’ গড়তে চেয়েছিলেন।
বাঙালি জাতির মুক্তি ও উন্নয়নের সেই মহৎ স্বপ্ন হোঁচট খায়। বঙ্গবন্ধু মাত্র সাড়ে তিন বছরের মতো সময় পেয়েছিলেন শাসনের জন্য। ৫৫ বছরের জীবনের সিংহভাগ আন্দোলন-সংগ্রাম, কারাভোগ আর ত্যাগ-তিতীক্ষার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করার পর তাঁর সামান্য সময়ের শাসনকালও শান্ত ছিল না। প্রবল বিরোধিতা উপেক্ষা করেই তাকে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশের ভঙ্গুর আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক কাঠামোকে পুনর্গঠনের জটিল কাজ শুরু করতে হয়েছিল। তাঁকে সামলাতে হয়েছিল নানামুখী শত্রুতা, ষড়যন্ত্র, বিরোধিতা ও বিরূপতা।
স্বাধীন বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধুর নেতুত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণ ও হামলা কেবল দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে দেশের বাইরে বিদেশেও চক্রান্ত চলতে থাকে। যে চক্রান্তের নেতৃত্ব দেয় বাংলাদেশের জন্মের বিরোধিতাকারী পাকিস্তান।
পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর জীবনী নিয়ে মার্কিন অধ্যাপক স্ট্যানলি উলপার্ট ‘জুলফি ভুট্টো অব পাকিস্তান’ নামে যে বই রচনা করেন, তাতে বাংলাদেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রের চিত্র রয়েছে।
১৯৯৩ সালে প্রকাশিত ওই বইতে দেখা যায়, বাংলাদেশের চীনা বাম এবং গোঁড়া দলগুলোর সঙ্গে ভুট্টোর গোপন যোগাযোগ ছিল। তথ্যের স্বপক্ষে গবেষক স্ট্যানলি উলপার্ট ভুট্টোর করাচিস্থ বাসভবনের পারিবারিক লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত ভুট্টোকে লেখা বাংলাদেশের আত্মগোপনকারী চীনপন্থি কমিউনিস্ট নেতা কমরেড আব্দুল হকের একটি চিঠির উদ্ধৃতি দিয়ে জানান, “গত দু‘বছর যাবত ভুট্টো কয়েকটি মুজিব-বিরোধী দলকে তার গোপন ‘স্বেচ্ছাধীন তহবিল’ থেকে অর্থ-সাহায্য অব্যাহত রেখেছিলেন, যে বিনিয়োগ তাকে ১৯৭৫-এর আগস্ট শেষ হওয়ার আগে ভালো প্রতিদান দেবে। বাংলাদেশের রাজনীতির জনাকীর্ণ বর্ণালীর উভয় দিকে অবস্থানকারী দলগুলোর মধ্যে গোঁড়া ইসলামী ও মার্ক্সবাদি কমিউনিস্ট বাঙালিরা মুজিবের বিরুদ্ধে এ সময় একজোট হয়ে শোর তুলছে। পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসিস্ট-লেনিনিস্ট)-এর জেনারেল সেক্রেটারি আব্দুল হক ‘গভীর বেদনা ও নিদারুণ’ মানসিক যন্ত্রণা’ প্রকাশ করে এবং ‘প্রিয় প্রধানমন্ত্রী’ সম্বোধন করে ভুট্টোকে ১৯৭৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর লিখিত এক চিঠিতে ‘জনগণ থেকে সম্পূর্ণভাবে সম্পর্কচ্যুত মুজিবের পুতুল-সরকার’-এর বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য ‘তহবিল, অস্ত্রশস্ত্র এবং ওয়ারলেস’ সরবরাহের আবেদন জানান। ‘সর্বোচ্চ গোপনীয় ও অত্যন্ত জরুরি’ চিঠিটি ১৯৭৫ সালের ৬ জানুয়ারি ভুট্টোর হাতে পৌঁছায়। তিনি চিঠির পাশে ‘জরুরি’ শব্দটি লিখে তার ভাষায় ‘এই সৎ ব্যক্তিকে সাহায্য’ দানের অনুমতি দেন। পত্র লেখককে ভুট্টো ‘মোটামুটি করিৎকর্মা’ বলে গণ্য করেন। (জুলফি ভুট্টো অব পাকিস্তান, পৃষ্ঠা ২৪৮)।
দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের পরেও বঙ্গবন্ধুর দেশ ও জাতি গঠনের কাজে থেমে থাকে নি। ‘সোনার বাংলা’র স্বপ্ন তিনি অদম্য চিত্তে এগিয়ে নিতে থাকেন। ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি থেকে ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট পর্যন্ত নিজের উপর অবিচল আস্থা রেখে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনা করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুকে তখন যুদ্ধ-বিধ্বস্ত একটা নতুন দেশে রাস্তা-ঘাটসহ বহু অবকাঠামোগত কাজ করতে হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক গঠন করে নতুন মুদ্রা ব্যবস্থা চালু করতে হয়েছে। পুরনো ব্যাংকগুলোকে সোনালী, রূপালী, জনতা, পূবালী, উত্তরা, অগ্রণী নামকরণ করে পুনর্গঠন করতে হয়েছে। প্রশাসন পুনর্বিন্যাস করতে হয়েছে। সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনী গঠন করতে হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে মাইন অপসারণ করে ব্যবহার উপযোগী করতে হয়েছে। বলতে গেলে সব কিছু নতুন করে শুরু করতে হয়েছে।
এটা স্পষ্ট যে একদিকে বিধ্বস্ত দেশ গঠনের কঠিন কাজ, আর অন্যদিকে ষড়যন্ত্র, দুটিকেই সামাল দেওয়া সহজ কাজ ছিল না। তিনি ‘বাকশাল’ গঠন করে দেশকে জ্বালাও-পোড়াও রাজনীতি থেকে বের করে সুশৃঙ্খলতার মাঝে নিয়ে আসার যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তা সফল হবে ভেবেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্র চক্রান্ত ও বিরোধিতায় প্রবলভাবে সক্রিয় হয়। এবং ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে তাঁর মহৎ স্বপ্নকে নস্যাৎ করে। এবং যেভাবে তাঁকে নির্মম ও নিষ্ঠুরতার মাধ্যমে সপরিবারে হত্যা করা হয়, তাতে জাতি কলঙ্কিত হয়।
বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে ‘সোনার বাংলা’র স্বপ্ন ম্লান হয়। তবে এটা স্পষ্টই বলা যায়, মৃত্যুর এতো বছর পরও বঙ্গবন্ধু ও তাঁর স্বপ্ন উজ্বলতর আলোকে জাতির মানসে উদ্ভাসিত।
ড. মাহফুজ পারভেজ: কবি-গল্পকার-শিক্ষাবিদ। প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৪০০ ঘণ্টা, আগস্ট ১৫, ২০১৭
জেডএম/