স্বাধীন বাংলাদেশের সঙ্গীত ঘরানার উজ্জ্বল নাম আব্দুল জব্বার। এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে যার শৈল্পিক জীবন ও কর্ম অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
অতি শৈশবে আব্দুল জব্বারের নামের সঙ্গে আমাদের পরিচয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন দুঃসময়ে পরিবারের সঙ্গে পলাতক জীবনে সকলকে দেখেছি উৎকর্ণ হয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত অনুষ্ঠান শুনছেন। তখন নিয়মিত ভেসে এসেছে তার ভরাট কণ্ঠস্বর। তিনি গেয়েছেন ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’। শরীরে ও আত্মায় শিহরণ জাগিয়েছিল ‘সালাম সালাম হাজার সালাম, শহীদ ভাইয়ের স্মরণে, আমার এ গান রেখে যেতে চাই, তাদের স্মৃতির চরণে। ’ বিবিসি যখন তার অনেকগুলো গানকে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাংলা গানের তালিকায় নির্বাচিত করে, তখন সেসব গানের মূল্য স্পষ্ট হয়। আজো যখন তার গানগুলো সমান জনপ্রিয়তায় গীত হতে শোনা যায়, তখন সেসবের সঙ্গীত ও ভাবগত মর্যাদা অনুধাবণ করা যায়।
আব্দুল জব্বার গান গেয়েছেন আধুনিক বাউলের মতো। ‘ওরে নীল দরিয়া’ কিংবা ‘পীচ ঢালা এই পথটাকে ভালোবেসেছি’ অথবা ‘তুমি কি দেখেছো কভু জীবনের পরাজয়’ গানগুলোতে তিনি মরমীয়া টানে নাগরিক জীবনকে নাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তার আধুনিকতার মধ্যে বাংলার শ্বাশত সুর ও আবহ স্বাভাবিকভাবে খেলা করেছে। তিনি বাংলাদেশের আইকন শিল্পী হয়ে ওঠেছিলেন। যে শিল্পী মাটি ও মানুষের মূল্য এবং শেকড় থেকে কখনোই বিচ্যুত হন নি।
আধুনিকতার নামে দেশজ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বিসর্জন দেন নি। মা-মাটি-মানুষের সঙ্গে আজীবন মিশে ছিলেন এই মুক্তিযোদ্ধা-শিল্পী-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।
একজন মুক্তিযোদ্ধা-শিল্পী হিসাবে আব্দুল জব্বার ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রেখেছেন। ভারতের কলকাতা ও বোম্বেতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত ও তহবিল সংগহ করেছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি করেছেন, তা হলো গানের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতার চেতনাকে মানুষের মর্মমূলে নিয়ে গিয়েছিলেন। তার গান পরাধীন বাঙালিকে উদ্বেলিত করেছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের মূল স্রোতে সবাইকে আবেগে ও উচ্ছ্বাসে একত্রিত করেছে। স্বাধীনতার দুর্বার আকাঙ্খা মানুষের হৃদয়ের তন্ত্রীতে বহমান নদীর মতো বয়ে গেছে। উপদ্রুত দিনগুলোতে মুক্তিকামী মানুষের কাছে তিনি ছিলেন সাংস্কৃতিক সারথী। স্বাধীনতার পর পর দেশের বিভিন্ন স্থানে তাকে ছাড়া সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কথা কল্পনাও করা যেতে না। আমাদের তারুণ্যে তাকে পেয়েছি মফঃস্বল শহরে। স্রোতাদের আবদারে মাঝ রাত পর্যন্ত বিরামহীনভাবে গান গেয়েছেন তিনি। গানই ছিল তার প্রাণ। নিজেও মন-প্রাণ উজাড় করে দিয়েছেন গানের জন্য।
আব্দুল জব্বার যে সময়ের শিল্পী তখন মিডিয়ার এতো বিকাশ ছিল না। রেডিও, টিভির শত শত চ্যানেলের কথা কল্পনারও বাইরে ছিল। সামাজিক মিডিয়া বা অনলাইনে গান-বাজনা ছড়িয়ে দেয়ার কোনোই সুযোগ ছিল না। সে সময়ে চারণের মতো বাংলাদেশের পথে-প্রান্তরে নানা অনুষ্ঠানে গেয়ে দেশাত্ববোধক স্বদেশিক গানগুলোকে জনপ্রিয় করেছিলেন তিনি। মানুষের মধ্যে স্বাধীনতার স্পৃহা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে তার গানের অবদান অনস্বীকার্য।
আশির দশকে আব্দুল জব্বারের সঙ্গে নিয়মিত দেখা হয়েছে ঢাকার শুক্রাবাদের এক রেস্তরাঁয়। তিনি তখন গান থেকে ক্রমে ক্রমে সরে আসছিলেন। কারো সঙ্গে দেখা হলেই পরিচয় দিতেন ‘আমি জব্বার ভাই’ বলে। বয়স ভেদে তিনি ছিলেন সকলেরই জব্বার ভাই। মিশুক ছিলেন। আবেগপ্রবণও ছিলেন। নিজের পরিচিত গন্ডির বাইরে বিশেষ একটা মেলামেশা করতেন না।
আব্দুল জব্বারের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা তখনই পূর্ণ ও সঠিকভাবে জানানো হবে, যখন বাংলাদেশের অবহেলিত শিল্পীদের যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার কাজটি সম্পন্ন হয়েছে বলে আমরা দেখতে পাবো।
ড. মাহফজ পারভেজ: কবি-গল্পকার-গবেষক। অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশ সময়: ১২৩০ ঘণ্টা, আগস্ট ৩০, ২০১৭
জেডএম/