শুরু হয়েছে বন্যা দিয়ে। বিস্তীর্ণ এলাকা বন্যার পানিতে ডুবে গেল, মাঠে ঘাটে পানি, স্কুলে পানি, বাড়ির ভেতর পানি।
২.
আগস্ট মাসের মন খারাপ করা বড় ঘটনাটি সবাই জানে। রুপা নামে একটা কলেজছাত্রীকে বাসের ভেতর ড্রাইভার, কন্ডাক্টর, হেলপার সবাই মিলে গণধর্ষণ করে এক ধরনের পৈশাচিক নিষ্ঠুরতায় হত্যা করেছে। প্রথম যেদিন খবরটি পত্রিকায় বের হয়েছে আমি দেখেও না দেখার ভান করে চোখ সরিয়ে নিয়েছি। আমি দুর্বল প্রকৃতির মানুষ, এ ধরনের খবর আমি সহ্য করতে পারি না, তাই সেগুলো থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে নিজেকে রক্ষা করতে চাই। কিন্তু মানুষ উট পাখি নয় যে বালুর ভেতর মুখ গুঁজে রাখলেই পৃথিবীর সব নিষ্ঠুরতা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে—তাই ধীরে ধীরে আমাকেও রুপা নামে এই অল্প বয়সী কলেজছাত্রীর ঘটনাটি আমাকে জানতে হয়েছে। ঘটনাটি জেনেছি কিন্তু যারা ঘটনাটি ঘটিয়েছে তারা কেমন করে এ ধরনের একটি ঘটনা ঘটাতে পারে সেই বিষয়টি কোনোভাবেই বুঝতে পারি না। বিচ্ছিন্নভাবে একজন বা দুজন মানুষ যারা বিকৃত এক ধরনের মানসিকতা নিয়ে মানসিক রোগী হিসেবে বড় হয়েছে তারা কোনো ধরনের অপরাধবোধ ছাড়াই এরকম ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটাতে পারে কিংবা ঘটিয়ে আনন্দ পায় সেটা আমরা জানি। কিন্তু একেবারেই পারিবারিক কয়েকজন মানুষ মিলে এ ধরনের নিষ্ঠুরতা করতে পারে সেটা আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না। তবে কী আমাদের মেনে নিতে হবে এ রকম ঘটনা সব সময়ই ঘটছে এবং যারা ঘটাচ্ছে তারা বেশির ভাগ সময়েই পার পেয়ে যাচ্ছে, তাই সমাজের এক শ্রেণির মানুষ এটাকে খুবই সহজ স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে মেনে নিয়েছে? আমরা শুধু একটি দুটি ঘটনার কথা জানি তাই সমাজের আসল ছবিটি আমাদের চোখের আড়ালে রয়ে গেছে? যেগুলোর কথা পত্রপত্রিকায় আসে সেগুলোরও কি বিচার হয়? অপরাধী শাস্তি পায়? এই দেশের অনেক বড় আলোড়িত ঘটনা হচ্ছে তনু হত্যাকাণ্ড—ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল বলে কী কখনও তনুর হত্যাকারীর বিচার হয়নি? হবে না? আমাদের ডিকশনারিতে গণধর্ষণ শব্দটি ছিল না (কী কুিসত একটি শব্দ, লিখতে গিয়ে কলম সরতে চায় না)। আমরা শুধু পাকিস্তানে এই ঘটনা ঘটার খবর পেতাম এবং শুনে হতবাক হয়ে যেতাম। কীভাবে কীভাবে জানি এই ঘটনটি বাংলাদেশেও ঘটতে শুরু করেছে, এখন এটি একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিল্লিতে একটা বাসের ভেতরে একটি মেয়েকে এভাবে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছিল, ঠিক তার পরপরই আমাদের দেশের বাসে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে শুরু করল। নৃশংসতা কি অনুকরণ করতে হয়? এটা কি একটা শেখার বিষয়? মনোবিজ্ঞানীরা কি এটা নিয়ে গবেষণা করে বিষয়গুলো আমাদের বোঝাতে পারবেন? আজকাল খবরের কাগজগুলো খোলা যায় না। মনে হয় পুরো খবরের কাগজটাই বুঝি ধর্ষণের খবর দিয়ে বোঝাই। ছাত্রলীগ কিংবা যুবলীগের নেতাদের ধর্ষণ, নানার নানতিকে ধর্ষণ, ঈদের দিনে আনন্দোত্সবে ধর্ষণ, বান্ধবীকে ধর্ষণ, স্বামীকে বেঁধে রেখে গৃহবধূকে ধর্ষণ, কম বয়সী শিশুকে ধর্ষণ শুধুমাত্র খবরের শিরোনাম পড়েই একজন মানুষ অসুস্থ হয়ে যাবে। আমি মনোবিজ্ঞান বা সমাজবিজ্ঞানের মানুষ নই, তাই বিচ্ছিন্ন একজন মানুষ বা একটি সমাজ কীভাবে অন্যায় করে কিংবা অন্যায়কে প্রতিহত করে সেটা জানি না। কিন্তু কিছু বিষয় সবসময়ই আমাকে বিভ্রান্ত করে এসেছে। আমি একবার এক মসজিদে ঈদের নামাজ পড়তে গিয়েছি, নামাজ শেষে ইমাম দোয়া করতে করতে এক সময় বললেন যারা এই দোয়ায় শামিল হয়েছেন তাদের সবার ‘গোনাহ’ যেন ‘সওয়াবে’ পরিণত করে দেওয়া হয়। আমি রীতিমতো চমকে উঠলাম, কারণ সত্যিই যদি এক দিন শুধু দোয়া করে জীবনের সব পাপকে পুণ্যে পাল্টে দেওয়া যায় তাহলে সেটা কি মানুষকে অন্যায় করতে প্রলুব্ধ করবে না? সারা জীবন খুন জখম চুরি চামারি অত্যাচার অনাচার ধর্ষণ করে জীবনের শেষ প্রান্তে কোনো একটা প্রক্রিয়ায় যদি তার সব পাপকে পুণ্যে পরিণত করে ফেলা যায় সেটি নিশ্চয়ই অনেক পুণ্য লাভের সবচেয়ে শর্টকাট পদ্ধতি। ধর্মের এই ব্যাখ্যা সমাজের কত গভীরে কত ব্যাপকভাবে প্রবেশ করেছে আমি জানি না। সেটি এই দেশের মানুষের চিন্তাভাবনার জগেক কীভাবে প্রভাবিত করেছে সে সম্পর্কেও আমার কোনো ধারণা নেই। (আমি অবশ্যি পারিবারিকভাবে ধর্মের অনেক সুন্দর এবং মানবিক একটা ব্যাখ্যা শুনে বড় হয়েছি। আমি জেনে এসেছি প্রত্যেকটা মানুষের ওপর খোদার একটা হক আছে এবং মানুষেরও একটা হক আছে। খোদার হক পালন না করলে, খোদার কাছে কান্নাকাটি করে মাপ চাইলে খোদা চাইলে মাপ করে দিতেও পারেন। কিন্তু মানুষের হক পালন না করলে সেই মানুষটি যতক্ষণ পর্যন্ত মাপ না করবে ততক্ষণ কোনো মুক্তি নেই! ধর্মের এই ব্যাখ্যাতে সারা জীবন পাপ করে শেষ বয়সে সব পাপকে পুণ্যে পাল্টে দেওয়া কিংবা পাপকে মুছে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই!) যারা রুপা মেয়েটির ওপর এই নৃশংস অত্যাচার করেছে তাদের সবাইকে ধরা হয়েছে। মানুষগুলোর মা-বাবারাও তীব্র অপরাধবোধে ভুগছেন, বলেছেন তাদের সত্যিকারের শাস্তি হওয়া উচিত। তাদের কী শাস্তি হবে আমরা জানি না, আইনের ফাঁক ফোকর দিয়ে বের হয়ে যাবে কিনা সেটাও আমরা জানি না। ছাত্রলীগের ছেলেরা প্রকাশ্যে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে বিশ্বজিেক কুপিয়ে হত্যা করেছে, তারপরও যারা ধরা পড়েছে তাদের ফাঁসির আদেশ মওকুফ হয়ে গেছে। কয়েক বছরের ভেতরেই তারা নিশ্চয়ই আরও বড় নেতা হিসেবে বের হয়ে আসবে! কাজেই রুপার হত্যাকারী এই মানুষগুলোর ভবিষ্যত্ কী আমরা জানি না, জেল হাজতে বসে বসে তারা কী ভাবে, তাদের বিবেক দংশন করে কিনা কিংবা কোনো রকম অপরাধ বোধে ভোগে কিনা সে সম্পর্কে আমি কিছু জানি না, কিছু অনুমানও করতে পারি না। কিন্তু মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে রুপার মনে কী ভাবনা কাজ করেছিল, সেটি আমরা কল্পনা করতে পারি। কম বয়সী এই মেয়েটির বুকের ভেতর নিশ্চয়ই ছিল গভীর হতাশা এবং এই বিশাল পৃথিবীর ওপর তীব্র অভিমান। এই দেশ, এই রাষ্ট্রযন্ত্র, এই সমাজ কোনো কিছু তাকে রক্ষা করতে পারল না—কী ভয়ঙ্কর একটি কষ্ট আর যন্ত্রণা নিয়ে তাকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হল। আমি সেই কষ্টটুকুর কথা কল্পনাও করতে পারি না।
৩.
আগস্ট মাসের আরও একটি মন খারাপ করা ঘটনা হচ্ছে আমাদের পাশের দেশ মিয়নমারে রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার। রোহিঙ্গা চরমপন্থীরা পুলিশ মিলিটারি ক্যাম্প আক্রমণ করার পর তার প্রতিশোধ নেওয়া হচ্ছে সাধারণ রোহিঙ্গা মানুষের ওপর। বাংলাদেশে পাঁচ লাখ থেকে বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে এক দশক থেকে বেশি সময় ধরে বসবাস করছে। গত কয়েক দিনে রোহিঙ্গাদের ওপর রীতিমতো গণহত্যা শুরু হওয়ার পর প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচানোর জন্য বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে ছুটে এসেছে। এটি অনেক বড় একটি ঘটনা, সারা পৃথিবীতে এটা নিয়ে তোলপাড় হচ্ছে। আমরা জানি এসব নিয়ে তোলপাড় হয় কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছু হয় না। রোহিঙ্গাদের নিয়েও হইচই হবে কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেউ আর দায়িত্ব নেবে না, এই অসহায় মানুষগুলোকে অসহায়ভাবে এই দেশে মানবেতর জীবন কাটাতে হবে। একাত্তরের পর বিহারিরা পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে কত যুগ জেনেভা ক্যাম্পে কাটিয়ে দিয়েছে মনে আছে? এই রোহিঙ্গাদের মৃত্যুর উপত্যকায় ফিরিয়ে না দিয়ে মানবিক কারণে বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে দেখে আমি একটুখানি শান্তি পাচ্ছি। আমি কিছুতেই ১৯৭১-এর ঘটনা ভুলতে পারি না, এই দেশের প্রায় এক কোটি মানুষ শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল, যদি ভারতবর্ষ তখন আমাদের আশ্রয় না দিত তাহলে আমাদের কী হতো? ১৯৭১ সালে আগরতলার মোট জনসংখ্যা থেকে বাংলাদেশের শরণার্থীর সংখ্যা বেশি ছিল। সেই কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে মৃত্যুভয়ে কাতর অসহায় মানুষকে একটুখানি আশ্রয় দেওয়া অনেকখানি বড় কাজ। মানুষ হিসেবে অন্য মানুষের জন্য সেটা যদি না করি তাহলে কেমন করে হবে? যে নোবেল কমিটি মিয়ানমারের জননেত্রী অং সান সু চিকে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার দিয়েছিলেন এখন তারা মাথা চাপড়াচ্ছেন কিনা সেটি আমার খুব জানার ইচ্ছা করে।
# লেখক: শিক্ষাবিদ ও লেখক
বাংলাদেশ সময়: ১২৪৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৮, ২০১৭
জেএম/