কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সম্মানসূচক ডি.লিট দিতে হলে আয়োজন করতে হয় বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানের। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো- নোবেল জয়ী পদার্থবিদ প্রফেসর ড. সালামের সম্মানে ১৯৮১ সালের বিশেষ সমাবর্তনটি হয়েছিল ১৯ জানুয়ারি।
১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর উদ্বোধন হওয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরুর মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক একাডেমিক কাযক্রম শুরু হয়েছিল ২৮ নভেম্বর থেকে। মাত্র ৪টি বিভাগ নিয়ে যাত্রা করা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ৮টি অনুষদে ৪৩টি বিভাগ, ৭টি ইনস্টিটিউটে প্রায় ২৫ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত।
১ হাজার ৭৫৩ দশমিক ৮৮ একরের পাহাড়ি-বনানীঘেরা অনিন্দ্য সুন্দর নান্দনিক ক্যাম্পাসের অর্ধ-শত বছরেরও বেশি সময়ের বর্ণাঢ্য ইতিহাসে বিশেষ সমাবর্তন ও সম্মানসূচক ডি.লিট ডিগ্রি দেওয়ার অনুষ্ঠান খুব বেশি হয়নি।
ফলে স্বাভাবিক কারণেই ১৬ জানুয়ারি তারিখটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিক্রমায় লাল হরফে লিপিবদ্ধ থাকবে। পদার্থ বিজ্ঞানী ড. আবদুস সালাম কেবলমাত্র একজন নোবেল পুরস্কার বিজয়ীই ছিলেন না; ছিলেন একজন মানবিকবোধ সম্পন্ন বিজ্ঞান সাধক।
দক্ষিণ এশিয়ার যে কয়জন বিজ্ঞানী কর্মের বহুমাত্রিক প্রতাপে বিশ্বের পাতায় নিজের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ করেছেন, তিনি তাদের অন্যতম ও অগ্রণী।
ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি, বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব প্রণব মুখার্জিও সমকালের একজন নিবেদিতপ্রাণ লোকনায়ক। জীবনভর একজন বাংলাদেশ-সুহৃদ হিসেবে পরিচিত এই ব্যক্তিও পদ্মা-মেঘনা পাড়ের মানুষের চোখে একান্ত আপনজন।
পণ্ডিত-ব্রাহ্মণ, চেহারায় খর্বকায় ‘বাঙালি বাবু’ প্রণবের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক জীবনের পরিধি ঠিক ততটাই বড়ো, বহুবিস্তৃত এবং ঘটনাবহুল। জীবনের গোড়ায়, বস্তুত যৌবনের বেশ কয়েকটি বসন্ত পর্যন্ত রাজনীতিতে আদৌ রুচি ছিল না তার। লেখাপড়া আর শিক্ষকতা নিয়েই মত্ত ছিলেন তিনি। বিগত শতাব্দীর ছয় দশকের মাঝামাঝি তিনি রাজনীতিতে আকৃষ্ট হন হঠাৎ করেই।
১৯৬৯ সালে বাংলা কংগ্রেসের তরুণ সদস্য হিসেবে সংসদের উচ্চকক্ষে তার প্রবেশ ঘটে। সেই থেকে ২০১৭ সালের ২৫ জুলাই রাষ্ট্রপতি ভবন ‘রাইসিনা হিল’ থেকে বিদায় পর্যন্ত বিস্তৃত তার ক্রিয়া-কলাপ; বাংলা বা ভারতের রাজনীতিতে কেন- পুরো দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতেই যার সমতুল্য নজির নেই বললেই চলে।
প্রণব মুখার্জিই একমাত্র বঙ্গসন্তান, যিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। সেটা তার সাফল্যের মুকুটে একটি উজ্জ্বল পালক অবশ্যই। কিন্তু সম্ভবত তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিয়য়টি হলো, ভারতের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে এতো দীর্ঘদিন ধরে দ্বিতীয় কোনো বঙ্গসন্তান সদর্পে নিজের অপরিহার্যতা প্রতিষ্ঠা করে রাখতে পারেননি।
গত অর্ধ-শতক ধরে দিল্লির রাজনীতিতে প্রণব ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই ‘মিস্টার ইনডিসপেনসিবল’ ক্ষমতাসীন অবস্থাতে তো বটেই, ক্ষমতার বাইরে থাকা অবস্থাতেও। তিনি ছিলেন ভারতের ‘প্রথম নাগরিক’। মেয়াদ শেষ হয়েছে বলে সেই অভিধাটি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গিয়েছে, এমন নয়।
ভাবী ইতিহাস তো আরও অনেক পরিচয়ের সঙ্গে তার এই অবিস্মরণীয় পরিচয়টিও স্মরণে রাখবে। আর তার স্বজাতির মণিকোঠায় তিনি তো বেঁচে আছেন এবং থাকবেন ‘প্রথম নাগরিক’ হয়েই। প্রণব মুখার্জি জীবনের সাফল্যের শীর্ষবিন্দুটিকে স্পর্শ করেছিলেন কর্মবহুলতার মাধ্যমে; দিনের আঠারোটি ঘণ্টাই কেবল কাজে মনোনিবেশ করে।
জীবনীকার-সাংবাদিক সুমন চট্টোপাধ্যায়ের বিশ্লেষণে, ‘সাংসারিক দায়-দায়িত্ব তাকে সেভাবে কোনো দিন পালন করতে হয়নি। সামাজিক জীবন বলতে যা বোঝায় সেটাও কস্মিনকালে তার ছিল না। তিনি হোটেল-রেস্তোরাঁয় যেতেন না, বেড়াতে যেতেন না, বিদেশ সফরে গেলেও কাজটুকু শেষ হওয়া মাত্র-ই উঠে পড়তেন বাড়ি ফেরার প্লেনে। অন্যভাবে বলতে গেলে বই পড়া এবং সকালে হাঁটা ছাড়া আর কোনো অভ্যাসই নেই তার। প্রণব মুখার্জির অভিধানে তাই জীবন মানে কাজ, শুধুই কাজ। ’
দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে সমুদ্র, পাহাড় ও প্রাকৃতিক বিভাময়তার মতোই সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক অগ্রসরতার প্রতীক চট্টগ্রামে একালের অন্যতম প্রধান রাজনীতিবিদ প্রণব মুখার্জি আগমন যেমনি ঐতিহাসিক, তেমনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদানের ঘটনাটিও যুগান্তকারী।
বাংলাদেশ সময়: ১০১৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৬, ২০১৮
এমপি/এইচএ