ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

বিদেশির মুখে ও লেখায় বাংলা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪৩৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৬, ২০১৮
বিদেশির মুখে ও লেখায় বাংলা ভাষার ফেব্রুয়ারি আশার ফেব্রুয়ারি

উইলিয়াম রাদিচে’র সঙ্গ একাধিক বার পেয়েছি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মনিরুজ্জামান, যিনি নজরুল ইনস্টিটিউটের পরিচালক ছিলেন, রাদিচে তাঁর কাছে প্রায়ই আসতেন।

বিলাতের এই পণ্ডিত বাংলাভাষা ও সাহিত্যের আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত একজন বিশেষজ্ঞ। তাঁর মুখে এতো চমৎকার ও পরিশীলিত বাংলা শুনেছি যে, বক্তার মুখ না দেখলে বোঝার উপায় ছিল না তিনি বিদেশি।

বিশেষজ্ঞ ও অনুবাদক ড. মার্টিন কেম্পশেনের কথাও প্রসঙ্গত বলা যায়। বাংলাভাষা নিয়ে ব্যাপক কর্মযজ্ঞের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন এই জার্মান৷ তিনি জার্মানিতে বাংলাচর্চার চালচিত্র তুলে ধরেছেন নিজের নিটোল ও শুদ্ধতম বাংলা রচনায়। অনেক স্থানে বক্তৃতা ও আলোচনাতেও সেসব কথা তুলে ধরেছেন। তার তৎপরতা যে একজন বিদেশির, সেটা মনেই হয় না। বাংলাকে তিনি এমন গভীরভাবেই আত্মস্থ করেছেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে জার্মানির নিবিড় যোগাযোগের কথা কারো অজানা নয়৷ তিনি মোট তিনবার জার্মানি সফর করেছিলেন৷ আলবার্ট আইনস্টাইনের মতো জার্মানির সমসাময়িক অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল৷ জার্মান লেখক গোয়েটে ও হাইনের সাহিত্যকর্মের সঙ্গে সবিশেষ পরিচিত ছিলেন তিনি৷ সেদেশে নানা বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূল্যায়ন নিয়মিতই করা হচ্ছে৷ এই কাজের শরিক শান্তিনিকেতনবাসী জার্মান অনুবাদক, লেখক ও সমাজকর্মী মার্টিন কেম্পশেন, যিনি বাংলাদেশের বোদ্ধা মহলে অপরিচিত জন নন।

বেশ ক’বছর আগে ঢাকা ঘুরে গিয়েছিলেন সাদা পাঞ্জাবি পাজামা পরা শ্মশ্রুমণ্ডিত এক বিদেশি সাহেব। কিন্তু তিনি কথা বলছিলেন দিব্যি বাংলায়। হ্যাঁ, একটু কৌতুকের সঙ্গে তিনি নিজেকে ‘সাহেব’ও বলতেন মাঝেমধ্যে। সাধারণ পোশাক-আশাক এবং চলনবলনে তাঁকে কিন্তু এক সৌম্যকান্ত বাঙালি বৃদ্ধের মতোই মনে হতো। আসলে তিনি একজন বিদেশি মিশনারি। নাম ফাদার দ্যতিয়েন। মা-বাবা নাম রেখেছিলেন পল দ্যতিয়েন। পল দ্যতিয়েন জন্মেছিলেন বেলজিয়ামের রশ্ফয় নামের একটি জায়গায় ১৯২৪-এর ৩০ ডিসেম্বর। বাবার নাম ফ্যানি এবং মা এলিজাবেথ।

বাংলাভাষী অঞ্চলে ফাদার দ্যতিয়েন বাংলার বিদ্ব্যৎসমাজে এক পরিচিত নাম। তাঁর মাতৃভাষা ফরাসি হলেও বাংলাভাষায় তাঁর ব্যুৎপত্তি রীতিমত ঈর্ষণীয়। উইলিয়াম কেরীর পুত্র ফেলিক্স কেরী বহু বছর আগে বলেছিলেন, বাংলা তার দ্বিতীয় মাতৃভাষা। একথাটি খুব জোরের সাথে বলতে পারতেন ফাদার দ্যতিয়েনও। ১৯৭১-এ পুস্তকাকারে প্রকাশিত তাঁর বাংলা রচনা ডায়েরির ছেঁড়া পাতা এবং ১৯৭৩-এ প্রকাশিত রোজনামচা  তাঁকে বাংলাভাষার এক শক্তিমান লেখক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

এমন উদাহরণ একটি নয়, একাধিক। ঢাকায় ভাষা ইনসটিটিউটে অনেক চাইনিজ ও কোরিয়ানের দেখা পাওয়া যায়, যারা চমৎকার বাংলা বলেন। ভারতের এমন অনেক গায়ক ও শিল্পী আছেন, যারা বাংলাভাষী না হয়েও অপূর্বভাবে গান গেয়েছেন। অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে এমন উদাহরণ বহু। বলে না দিলে সাধারণত কেউই বুঝতেও পারবে না যে, এইসব গায়ক-গায়িকা ও অভিনেতা-অভিনেত্রী বাংলাভাষী নন।

ভালোবেসে বাংলাকে মুখে বা কলমে তুলে নেওয়া বিদেশিদের সংখ্যা অল্প নয়। বলাই বাহুল্য যে, বাংলা শেখা বা লেখা বাণিজ্যিক অর্থে বা চাকরি-বাকরির দিক থেকে লাভজনকও নয়। তারপরেও বিশ্বের সবচেয়ে শ্রুতিমধুর ভাষা বাংলা শেখার জন্য অনেকেই আগ্রহী হন। কেউ কেউ আর্দশ-স্থানীয় মানেও উত্তীর্ণ করেন নিজেদের বাংলাভাষার জ্ঞান ও দক্ষতাকে। এর ফলে বিদেশে যেমন বাংলাভাষার প্রসার হচ্ছে, বিদেশিদের হাত ধরে বাংলা ভাষাও অপরাপর ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে নানা কিছু আহরণের সুযোগ পাচ্ছে।

আরও একটি বিষয় এতে প্রমাণিত হয়। তাহলো, আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলা বিশ্বের বহু মানুষের কাছেই আগ্রহের বিষয়। কোনও ধরনের আর্থিক বা বৈষয়িক লাভালাভের বাইরে কেবল ভাষাগত আকর্ষণে বিদেশিদের বাংলা শিখতে ছুটে আসাও কম শ্লাঘার নয়! 

বাংলাদেশ সময়: ১০২৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৬ , ২০১৮

জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।