ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২০ ঘণ্টা, এপ্রিল ৮, ২০১৮
বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট সবুজ মাঠে পড়ে ছিল স্কুলছাত্রী বিউটির নিথর মরদেহ।

সমাজ কি ক্রমেই অপরাধপ্রবণ হয়ে যাচ্ছে? অপরাধের পরিসংখ্যান ও তথ্য উপাত্ত নিয়ে অপরাধবিজ্ঞানীরা হয়তো সমাজের অপরাধ প্রবণতার ব্যাখ্যা দেবেন। কিন্তু পরিসংখ্যান ও গবেষণায় না গিয়েও একথা বলা যায়, সমাজের অপরাধের ধরনে এক বিরাট পরিবর্তন এসেছে। একসময় চুরিই ছিল সমাজের প্রচলিত অপরাধগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত! চোরেরা পেটের দায়ে, না হয় স্বভাবদোষে চুরিতে করতো।

কিন্তু চুরি করে সহজে পার পাওয়া যেতো না। গ্রাম-পাড়া-মহল্লায় সবাই চোরদের সম্পর্কে ওয়াকেবহাল ছিল।

গ্রামে রাতে কোনো বাড়িতে চুরি হলে জোহর নামাজের আগেই চোরের বিচার হতো। চেয়ারম্যান-মেম্বারের উপস্থিতিতে চৌকিদার চুরির বিচার কার্যকর করতো। শহরের (রাষ্ট্রের) আইনের জন্য গ্রামের বিচারকাজ থেমে থাকতো না।

এখন সামাজিক বিচারের দিন নেই। সেখানে আজ রাষ্ট্রের আইন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দিনকে দিন আইন আরো কঠিন হচ্ছে। কিন্তু সমাজ থেকে অপরাধ ততোটা দূর হয়নি।

সমাজ যতো দিন থাকবে, ততদিন অপরাধও থাকবে, আবার আইনও থাকবে। আইন সমাজের অপরাধের বিচার করবে, আর সমাজ অপরাধের লাগামে টেনে ধরবে। আইন-অপরাধ-সমাজের এই চক্রটি যতদিন চলমান থাকবে ততদিন আইন শক্তিশালী অবস্থানে থাকবে, সমাজে শৃঙ্খলা বিরাজ করবে। আর তা না হলে অপরাধীরা শক্তিশালী হবে, কঠিন আইন দিয়েও অপরাধ দমন করা যাবে না, সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, সামাজিক ভিত নড়বড়ে হয়ে যাবে, ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে সামাজিক সম্পর্কগুলোও। কোনো সমাজই অপরাধমুক্ত নয়। কিন্তু সামাজিক মূল্যবোধ ও আইনের অনুশাসন সমাজ বনাম অপরাধের মধ্যে একটি ভারসাম্য বজায় রাখে।
আমাদের সামাজিক সম্পর্কগুলো আজ অনেকটাই অস্তাচলে। যা আছে তা সামাজিক আনুষ্ঠানিকতায়। কিন্তু আমাদের সামাজিক সম্পর্কগুলো ছিল জীবনঘনিষ্ট যা আজ ম্রিয়মান।

সামাজিক সম্পর্ক বিনষ্ট হওয়ার এ ভাইরাসটির সমসাময়িক শিকার পরিবার। ফলে, আমাদের পারিবারিক সম্পর্কগুলোও আজ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এটি এখন হয়তো ডাল-পালায় আক্রমণ করেছে, কিন্তু লক্ষ্য আরো গভীরে। সেখানে বাবা, মা, ভাই, বোন, শ্বশুর, জামাই, পুত্রবধূ, নাতি-নাতনি, গৃহকর্মী, পিয়ন-চাপরাশি, শিক্ষক, ছাত্র-সবাই একই সাথে একেকজন শিকার ও শিকারি।  

একটি সমাজের মন মানসিকতা ও সামাজিক মূল্যবোধ গঠিত হয় বহু বছর এমনকি যুগ-যুগ ধরে। কিন্তু সেই মূল্যবোধ ও চেতনা ভাঙতে খুব বেশি সময় লাগে না। কয়েক বছর আগেও আমরা শুনতে পাইনি যে, মা-বাবা কখনো সন্তানকে হত্যা করতে পারে। বাবার কাঁধে নাকি সন্তানের লাশের চেয়ে ভারী কিছু নেই। সন্তান কখনো তুচ্ছ কারণে বা সম্পত্তির জন্য বাবা-মাকে হত্যা করতে পারে, তা-ও এই সমাজে আগে বিরল ঘটনা ছিল। কিন্তু সমাজ এখন বদলে গেছে; অপরাধেরও এখন আর পাত্র-মিত্র ভেদ নেই। মনে হচ্ছে, সমাজ এখন ‘সবার সাথে সব অপরাধ’-এর দিকে যাচ্ছে। হত্যা, খুন, ধর্ষণ--এসব অপরাধের সিলেবাস এখন সবার জানা।
সামাজিক মূল্যবোধের কোনো সংজ্ঞা নেই। কিন্তু এর অনুপস্থিতিতেই এর অস্তিত্ব উপলব্ধি করা যায়। চোখ না থাকলে যেমন চোখের মর্যাদা বোঝা যায়, দাঁত না থাকলে দাঁতের, তেমনি মূল্যবোধের অবক্ষয়ে বোঝা যায় মূল্যবোধের মর্যাদা। সমস্যা হচ্ছে, দাঁত না থাকলে দাঁত লাগানো যায়, অনেক ক্ষেত্রে চোখও মেলে, কিন্তু মূল্যবোধ একবার হারালে তা আর ফিরে পাওয়া যায় না।

মানুষ ষড়রিপুর সমাহার। আবার ষড়রিপুকে জয় করার মধ্যেই মানুষের সৌন্দর্য। সামাজিক-পারিবারিক মূল্যবোধ, আইন, ধর্ম, শিক্ষা, এসবই মানুষের ষড়রিপুর বশ মানানোতে ভূমিকা রাখে। এখানেই মানুষের মাহাত্ম্য। না হলে মানুষে আর পশুতে তফাৎ কী!

একটি সমাজ যখন সন্তানকে হত্যা করতে শিখে যায় তখন সেই সমাজের কেউ আর নিরাপদ নয়। কারণ, মনে রাখতে হবে, আমরা সবাই এ সমাজেরই সন্তান। সায়েদ আলী, বিউটি, বাবুল, মনা মিয়া-সবাই কোনো না কোনোভাবে মূল্যবোধের অবক্ষয়ের শিকার। এখানে কেউ অপরাধী, কেউ বা অপরাধের শিকার। কিন্তু আদতে আমরা সবাই ভুক্তভোগী---আজ অথবা কাল।

সন্তানের ধর্ষক বাবুল মিয়াকে ফাঁসাতে নিজ সন্তানকেই বলিদান? একি হত্যা না প্রতিশোধ? নাকি আত্মহনন? কে বড় অপরাধী বাবুল না বাবা, নাকি সহযোগী ময়না মিয়া? সে-বিচার আদালতের হাতে। কিন্তু আমরা জানি এ সমাজে এখন ভাড়াটে খুনি পাওয়া যায়। খুন যখন সমাজে কেউ পেশা হিসেবে গ্রহণ করে তখন সে সমাজে অপরাধ একটি প্রতিষ্ঠিত শব্দ। সমাজ থেকে অপরাধকে প্রতিষ্ঠা দেবার, অপরাধের অনুকূল বাতাবরণ তৈরির সর্বনাশা  প্রবণতা রোধ করতেই হবে।

পুলিশ বলছে, হবিগঞ্জের বিউটির প্রকৃত হত্যাকারী তার কথিত চাচা ময়না মিয়া। বিউটিকে হত্যার সময় তার বাবা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। বাবার পরিকল্পনাতেই বিউটির হত্যাকাণ্ড। এ হত্যাকাণ্ডে  পেশাদার ভাড়াটে খুনিও জড়িত ছিল। সে ভাড়াটে খুনি বিউটির হাত-পা চেপে ধরে রাখে। আর ময়না মিয়া বিউটির শরীরে ছুরি দিয়ে আঘাত করে। এ হত্যাকাণ্ড এখনো তদন্তনাধীন। সামনে রয়েছে বিচারের দীর্ঘ পথ। বিউটি এখন ওপাড়ে। এপারে সে ন্যায়বিচার পেল কি পেল না তাতে তার কী যায়-আসে! কিন্তু আমরা যারা আছি এ সমাজে, যারা থাকতে চাই জন্মলব্ধ ‘মানুষ’ পরিচয় নিয়ে, তাদের জন্য ‘‘বিউটি অ্যান্ড বিস্ট’-এর মাঝের এই লড়াইটি চালিয়ে যেতেই হবে।

বাংলাদেশ সময়: ২১১৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৮, ২০১৮
জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।