ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

টুকিটাকি ভাবনা || মুহম্মদ জাফর ইকবাল

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯২৯ ঘণ্টা, মে ২৫, ২০১৮
টুকিটাকি ভাবনা || মুহম্মদ জাফর ইকবাল মুহম্মদ জাফর ইকবাল (ফাইল ছবি)।

মাত্র সপ্তাহ দুয়েক আগে এস. এস. সি পরীক্ষার রেজাল্ট হয়েছে। আমাদের দেশের এটা অনেক বড় একটা ঘটনা। দেশের সব পরিবারেরই পরিচিত কেউ না কেউ এস. এস. সি পরীক্ষা দেয়। আগ্রহ নিয়ে রেজাল্টের জন্যে অপেক্ষা করে। রেজাল্ট হবার পর ক্যামেরাম্যানরা নামী দামী স্কুলগুলোতে যায়, ছেলে মেয়েগুলোর আনন্দোজ্জ্বল মুখের ছবি তুলে আমরা পত্রপত্রিকায় দেখি, আমাদের ভালো লাগে।

আমি দুরু দুরু বক্ষে পরের দিন পত্রিকা খুলি, পত্রিকার ভেতরের পাতায় চোখ বুলাই, এখন পর্যন্ত একবারও হয় নাই যখন পরীক্ষায় রেজাল্টের হতাশার কারণে ছেলেমেমেয়রা আত্মহত্যা করে না। দেখে আমার বুকটা ভেঙে যায়।

মানুষের জীবন কতো বড় একটা ব্যাপার তার তুলনায় এস. এস. সি পরীক্ষার গুরুত্ব কতো কম কিন্তু এই দেশের কিশোর কিশোরীদের সেটা কেউ বলে না। অভিমানী ছেলে মেয়েগুলো পরীক্ষায় মনের মত রেজাল্ট করতে না পেরে আত্মহত্যা করে ফেলে। মাঝে মাঝে একটা দুটো ঘটনায় খুটিনাটি বের হয়ে আসে আমরা শুনে হতবাক হয়ে যাই। যখন জানতে পারি এরকম ঘটনার বড় একটা কারণ অভিভাবকদের অবহেলা তখন কোনোভাবেই সেটা মেনে নিতে পারি না। পরীক্ষায় রেজাল্ট তো খারাপ হতেই পারে, যদি হয়েই যায় তখন অভিভাবকদের আপনজনদের বুক আগলে সেই কিশোর কিংবা কিশোরীটিকে রক্ষা করার কথা, তাকে শান্তনা দেওয়ার কথা, সাহস দেওয়ার কথা। অথচ পুরোপুরি উল্টো একটা ঘটনা ঘটে, বেশীর ভাগ জাগায় অভিভাবকদের লাঞ্চনা গঞ্জনা অপমানে ক্ষতবিক্ষত হয়ে ছেলেমেয়েগুলো গলায় দড়ি দেয়। ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে। পৃথিবীর আর কোথাও আমাদের কিছু অভিভাবক থেকে নিষ্ঠুর অভিভাবক আছে কিনা  আমার জানার খুব কৌতূহল হয়।

এটা কেউ অস্বীকার করবে না যে দেশের মানুষ লেখাপড়ার গুরুত্বটি ধরতে পেরেছে, সবাই তাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাতে চায়। কিন্তু কীভাবে কীভাবে জানি লেখাপড়ার আসল অর্থটি কোথায়  হারিয়ে গেছে। সবার ধারণা হয়েছে লেখাপড়ার অর্থ পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করা। পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করেও যে অনেক সময় একটি ছেলে বা মেয়ে কোথাও কিছু  করতে পারছে না সেটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানোর পরও আমাদের অভিভাবকদের টনক নড়ছে না। ছেলেমেয়েদের যে একটা আনন্দময় শৈশব থাকতে হয় সেটি অনেকেই জানে না। শুধু অভিভাবকদের দোষ দেই কীভাবে, আমরা নিজেরাই কী লেখাপড়ার পুরো প্রক্রিয়াটাই শুধু পরীক্ষার মাঝেই সীমাবদ্ধ করে ফেলিনি?

পৃৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ গায়ক, লেখক, শিল্পী, ফুটবল প্লেয়ার বের করতে দেয়া হলে সবাই বিভ্রান্ত হয়ে যায়। কাকে ছেড়ে কার নাম বলবে ধরতে পারে না। কিন্তু সর্বশ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিকের নাম বলতে বলা হলে দেখা যায় কোনো তর্ক বিতর্ক না করে সবাই আলবার্ট আইনস্টাইনের নাম বলছে। আমার ধারণা লেখাপড়ার আসল উদ্দেশ্য কী হওয়া উচিৎ সেটা বোঝার জন্যে আলবার্ট আইনস্টাইনের জীবনের কয়েকটা উদাহরণ পরীক্ষা করে দেখা যায।

তার জীবনের একটা গল্প এরকম। তিনি তখন আমরেকিা এসেছেন, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে থাকেন। এতো বড় একজন বিজ্ঞানী তার নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য ইউনিভার্সিটির কর্তৃপক্ষ খুবই সতর্ক। একদিন রাত্রিবেলা ইউনিভার্সিটির পুলিশ দফতরে একটা টেলিফোন এসেছে। একজন মানুষ টেলিফোন করে আইনস্টাইনের বাসার নম্বরটি জানতে চাইছে। খুব সাভাবিক কারণেই পুলিশ বলল, আইনস্টাইনকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য তার বাসার নম্বরটি গোপন রাখা হয়েছে। এটি কাউকে বলা যাবে না। মানুষটি পুলিশকে জানালো তাকে আইনস্টাইনের বাসার নাম্বর জানালে কোনো ক্ষতি নেই। কারণ তিনি নিজেই আইনস্টাইন। বাসার নম্বাটি ভুলে গিয়ে এখন নিজের বাসাটি খুঁজে বের করতে পারছেন না।

বিখ্যাত মানুষদের নিয়ে অনেক ধরনের গল্প থাকে, কাজেই এই গল্পটি কতখানি সত্যি এবং কতখানি অতিরঞ্জিত আমার জানা নেই। আমরা নিজেরাও অনেক সময় অনেক কিছু ভুলে যাই কিন্তু সেটি কখনো দশজনের সামনে প্রচার করা হয় না, উল্টো আমরা অপদার্থ মানুষ হিসেবে বকা ঝকা খাই। তবে আইনস্টাইনের এই গল্পটির একটা গুরুত্ব আছে, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ একজন বিজ্ঞানী যিনি তার মস্তিষ্ক ব্যবহার করে সারা পৃথিবীর চিন্তার জগতে ওলট পালট করে ফেলতে পারেন তার নিশ্চয়ই একটা নম্বর মনে রাখার ক্ষমতা আছে কিন্তু তিনি তার মস্তিষ্কটিকে তথ্য দিয়ে ভারাক্রান্ত করতে চাইতেন না। আমাদের মস্তিষ্কটি তথ্য জমা রাখার জন্য তৈরী হয়নি, আমাদের মস্তিষ্ক তৈরী হয়েছে তথ্যকে বিশ্লেষণ করার জন্য, তথ্যকে প্রক্রিয়া করার জন্য। সোজা কথায় বলা যায় সমস্যা সমাধান করার জন্য।

কাজেই আমরা যখন দেখি ছেলে মেয়েরা লেখাপড়া করছে শুধুমাত্র পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাবার জন্য কিন্তু সেটা করতে গিয়ে তার মহামূল্যবান মস্তিষ্কটি অপব্যবহার করে সেটাকে অকেজো করে ফেলছে সমস্যা সমাধানের ক্ষমতাটাকে নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে তখন অবশ্যই আমাদের দুশ্চিন্তা হয়।

মস্তিষ্ক নিয়ে কথা বলতে হলে ঘুরে ফিরে অনেকবারই আইনস্টাইনের কথা বলতে হয়। আমরা কোনো কথা বললে সেটা কেউ গুরুত্ব দিয়ে নেবে না কিন্তু আইনস্টাইন বললে সেটাকে গুরুত্ব না দিয়ে উপায় নেই। আইনস্টাইন বলেছেন জ্ঞান থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কল্পনাশক্তি। এই কথাটি আমি অসংখ্যবার উচ্চারণ করেছি, অসংখ্যবার ছেলে মেয়েদের মনে করিয়ে দিয়েছি। (কোনো কোনো ছেলেমেয়ে আমাকে প্যাচে ফেলে দেওয়ার জন্যে বলে, স্যার তাহলে আমরা লেখা পড়া বাদ দিয়ে দিন রাত গালে হাত দিয়ে কল্পনা করি না কেন? আমি তাদের চেষ্টা করে দেখতে বলেছি তাহলে নিজেরাই আবিষ্কার করবে জ্ঞানের ওপর ভর না করে শুধু কল্পনা বেশী দূর যেতে পারে না। ) কল্পনা শক্তিকে বেশী গুরুত্ব দেওয়ার কারণটি সহজ। আমাদের যখনই জ্ঞানের ঘাটতি হয় আমরা চেষ্টা চরিত্র করে সেই ঘাটতিকে পূরণ করে ফেলতে পারি। কিন্তু যদি কল্পনা করার শক্তি একবার হারিয়ে ফেলি তাহলে সেটা আর ফিরে পাওয়া যায় না।
কাজেই আমাদের লেখাপড়ার উদ্দেশ্যটাই হতে হবে কল্পনাশক্তিকে বাঁচিয়ে রাখার একটা যুদ্ধ। প্রতি পরীক্ষায় গোল্ডেন ফাইভ পেয়ে জীবনের আসল পরীক্ষায় যদি আমরা একটা ছেলে মেয়েকে অপ্রয়োজনীয় অকেজো একটা মানুষ হিসেবে পাই তাহলে সেই দুঃখ আমরা কোথায় রাখব?

সপ্তাহখানেক আগে লেখাপড়া সংক্রান্ত ব্যাপারে আমার দুটি ছোট প্রতিক্রিয়া জানার সুযোগ হয়েছে। প্রথম প্রতিক্রিয়াটি একজন অভিভাবকের, তিনি আমার কাছে জানতে চেয়েছেন তিনি তার ছেলেটিকে কি বাংলা মিডিয়ামেই রাখবেন নাকি ও লেভেলে এ লেভেলে সরিয়ে নেবেন। এসব ব্যাপারে আমি কখনোই কোনো উপদেশ দিই না, এবারেও দিইনি কিন্তু আমি জানতে চেয়েছি কেন হঠাৎ করে এই সিদ্ধান্তটি নিতে চাইছেন। তিনি যেটা বললেন সেটা শুনে আমি হকচকিয়ে গেলাম। অভিভাবকটি আমাকে জানালেন আমাদের দেশের মূল ধারার লেখাপড়ায় তিনি আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস হয় যদি বা ফাঁস না হয়  তাহলে সেই প্রশ্ন হয় খুবই নিম্নমানের, পড়াশোনার পদ্ধতি মান্ধাতা আমলের। তার ধারণা এই পদ্ধতিতে পড়াশোনা করে একজন ছেলে বা মেয়ে বিশ্বমানের লেখাপড়া করতে পারবে না। যেহেতু পাশাপাশি আরেকটি পদ্ধতি রয়েছে এবং সেই পদ্ধতিতে তার লেখা পড়া করানোর ক্ষমতা রয়েছে তাহলে কেন সেটি করাবেন না।

আমি ব্যাপারটি জানার পর আমার পরিচিত অনেকের সাথে এটি নিয়ে কথা বলেছি, আশ্চর্যের ব্যাপার হলো তাদের কেউই ব্যাপারটি শুনে অবাক হলেন না। যে বিষয়টা আমাকে দুশ্চিন্তায় ফেলেছে সেটি হচ্ছে এক সময় এই দেশের লেখাপড়ার ওপর অভিভাবকদের আস্থা ছিল, এখন যতই দিন যাচ্ছে ততই আস্থা চলে যাচ্ছে। পৃথিবীতে সবকিছু ধীরে ধীরে ভালো হবার কথা, মনে হচ্ছে আমাদের দেশে লেখাপড়ার বেলায় উল্টোটি হচ্ছে। সবার ধারণা যতই দিন যাচ্ছে লেখাপড়ার মান কমে আসছে। এর অনেক কারণ আছে, বেশ কিছু কারণের কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত এটাকে একটা সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা না হবে ততক্ষণ তার সমাধান হবে না। কেউ কি লক্ষ করেছে যতদিন শিক্ষা মন্ত্রনালয় স্বীকার করেনি প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে ততদিন প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ হয়নি। যখন স্বীকার করেছে শুধুমাত্র তখনই প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ হয়েছে।

লেখাপড়া নিয়ে দ্বিতীয় প্রতিক্রিয়াটি পেয়েছি একজন এস. এস. সি পরীক্ষার্থী থেকে। সে খুলনার একটা স্কুলে ভর্তি হয়েছে এবং সেই স্কুলের ছেলে মেয়েরা ক্লাশে আসে না। ক্লাশে না এসে তারা কী করে তার বিস্তারিত বর্ণনা আছে, আমরা সেটা নিজেরাই অনুমান করতে পারব। আমাকে চিঠিটা কয়েকবার পড়তে হয়েছে নিশ্চিত হওয়ার জন্যে যে বিষয়টি একটি স্কুল নিয়ে। কলেজে এধরনের ঘটনা ঘটে সেটা আমরা সবাই জানি এবং মনে হয় আমরা সবাই সেটা মেনেও নিয়েছি। শিক্ষকেরা ক্লাশে পড়ান না এবং অনেকে উৎসাহ নিয়ে বাসায় পড়ান সেটা এখন সামাজিকভাবে স্বীকৃত বিষয়। কিন্তু আমার ধারণা ছিল স্কুলের বিষয়টি আলাদা লেখাপড়া হোক কি না হোক ছেলে মেয়েরা সবাই স্কুলে যায়। কিন্তু এখন দেখছি সেটি সত্যি নয়। যদি স্কুলে যাবার জন্য বাসা থেকে বের হয়ে ছেলেমেয়েরা ক্লাশে না এসে অন্য কোথাও যায়, অন্য কিছু করে তাহলে সেটা খুবই ভয়ংকর ব্যাপার। গল্প উপন্যাসে খুবই খারাপ একটা স্কুল বোঝানোর জন্য আমি নানা ধরনের বিচিত্র ঘটনার কথা লিখি, সেখানেও আমি এটা লিখতে সাহস পাই না যেখানে ছেলেমেয়েরা স্কুলে আসার জন্যে বাসা থেকে বের হয়ে স্কুলে আসছে না। যদি শিক্ষকেরা সেটা অভিভাবকদের নজরে না আনেন আর অভিভাবকেরা এর সমাধান না করেন তাহলে শেষ পর্যন্ত আমরা কোন তলানীতে পৌছাব কে জানে?

এই পর্যন্ত লিখে আমি আবিষ্কার করেছি যে আমি সারাক্ষণই মন খারাপ করা বিষয় নিয়ে লিখে যাচ্ছি, কিন্তু আশেপাশে যে ভালো কিছু নেই তা নয়, সেগুলো দেখে ভবিষ্যৎ নিয়ে যদি স্বপ্ন দেখার সুযোগ করে না নিই তাহলে কেমন হবে?

স্কুলের ছেলেমেয়েদের নিয়ে এই মাত্র অভিযোগ করেছি, আবার এই স্কুলের ছেলেমেয়েরাই প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সবগুলো ছাত্রছাত্রীদের হারিয়ে দিয়েছে। শুধু তাই না, তারা একটা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় স্বর্ণ পদক পর্যন্ত পেয়েছে। একটু খানি সুযোগ করে দেয়া হলে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আমাদের তাক লাগিয়ে দেয়, তাই তাদের নিয়ে মাঝে মাঝে দুশ্চন্তা হয়তো করি কিন্তু হতাশ কখনো হইনি।

শুধু অপেক্ষা করে থাকি দেখার জন্যে দেশটার লেখাপড়ার বিষয়টা কখন আরেকটু গুছিয়ে নেয়া হবে।

লেখক: অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৫২৬ ঘণ্টা, মে ২৫, ২০১৮
টিএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।