ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

আন্তর্জাতিক আদালত কি মিয়ানমারের বিচার করতে পারবে?

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫২৮ ঘণ্টা, মে ৩১, ২০১৮
আন্তর্জাতিক আদালত কি মিয়ানমারের বিচার করতে পারবে? নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের তিন প্রজন্মের কান্না (ফাইল ফটো)

রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশের অব্যাহত কূটনৈতিক প্রয়াসের ফলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের অবস্থান থেকে অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের একটি প্রতিনিধিদল রোহিঙ্গাদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে বাংলাদেশ সফর করে গেছে। প্রতিনিধি দলটি সরেজমিনে কক্সবাবাজারে অবস্থিত রোহিঙ্গা আশ্রয়কেন্দ্রগুলো ঘুরে দেখেছে। পরে তারা মিয়ানমারেও গিয়েছে।

বর্তমানে ‘শরণার্থী’ একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। কিন্তু তারপরও শরণার্থী গ্রহণকারী রাষ্ট্র যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হলে এ জাতীয় সমস্যা রাষ্ট্রীয় পরিসরেই ঘুরপাক খায়।

শরণার্থী গ্রহণকারী রাষ্ট্রকে তাই কূটনৈতিক প্রয়াস চালিয়ে যেতে হয়। সেই বিবেচনায় এখন পর্যন্ত ঢাকার সোজাসাপ্টা অবস্থান যে, মিয়ানমার এ সমস্যার সৃষ্টি করেছে এবং তাদেরকেই এর সমাধান করতে হবে।  

আমরাও মনে করি, শরণার্থীদের নিরাপদ ও স্থায়ী প্রত্যাবাসনই এ সমস্যার একমাত্র গ্রহণযোগ্য আইনানুগ ও আন্তর্জাতিক সমাধান। মিয়ানমারকে প্রত্যাবাসনে বাধ্য করতে আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশকে জোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতেই হবে। এখানে কোনো ধরনের অবহেলা বাংলাদেশকে স্থায়ী সংকটের মুখোমুখি করবে।  

আমাদের জন্য প্রত্যাবাসনই একমাত্র আকাঙ্ক্ষিত সমাধান হলেও আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের দৃষ্টিতে প্রত্যাবাসনের পাশাপাশি মিয়ানমার মানবতার বিরুদ্ধে যে অপরাধ করেছে তার বিচার হওয়াও জরুরি। কেবল দেওয়ানি কার্যক্রমই যথেষ্ট নয়, ফৌজদারি পদক্ষেপও জরুরি। মিয়ানমার শুধু একটি জাতিগোষ্ঠীকে নিজ দেশ থেকে বিতাড়ণ করে শরণার্থী বানিয়েই ক্ষ্যান্ত হয়নি, যে প্রক্রিয়ায় তারা এ কাজটি করেছে তা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ।  সে কারণে এ অপরাধের বিচার হওয়া মানবতার দাবি।

মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের হত্যা, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ঘড়-বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও  লুটপাট করে তাদের ভিটেমাটি ছাড়া করেছে। তাদের কুপরিকল্পনার অংশ হিসেবেই এ নিধনযজ্ঞ চালিয়েছে মিয়ানমার।

এ জাতীয় অপরাধের বিচার করার জন্য আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে), আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতসহ (আইসিসি) রয়েছে বিভিন্ন আঞ্চলিক আদালত। এসব আদালতের এখতিয়ারগত ভিন্নতা রয়েছে।

মিয়ানমারের অপরাধ বিচার করার এখতিয়ার আইসিসির আছে কি-না তা জানতে চেয়ে উক্ত আদালতেরই চিফ প্রসিকিউটর আদালতের কাছে গত ৯ এপ্রিল একটি আবেদন করেছেন। আবেদনটি এখনও আদালতের বিবেচনাধীন। আমরা এ বিষয়ে আদালতের ইতিবাচক সিদ্ধান্ত প্রত্যাশা করছি।  

যদিও মিয়ানমার এরই মধ্যে দাবি করেছে যে তাদের বিচার করার এখতিয়ার আইসিসির নেই। কারণ মিয়ানমার আইসিসির সদস্য নয়। আইসিসি সনদে সইও করেনি তারা কিংবা এর এখতিয়ারকে ইতিপূর্বে স্বীকারও করে নেয়নি। তাছাড়া, অভিযুক্তরা মিয়ানমারের সৈন্য এবং ‘কথিত’ অপরাধ সংঘঠিত হয়েছে মিয়ানমার ভূখণ্ডেরই রাখাইন রাজ্যে। কিন্তু এখন ঢাকাসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অপেক্ষা, ‘ দেখা যাক, আইসিসি কী করে। ’ 

এটা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় স্পষ্ট করে না বলেও তাদের কথায় প্রকাশ পায় যে, মিয়ানমার যা করেছে আন্তর্জাতিক আইনের বিচারে তা আন্তর্জাতিক অপরাধ তথা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার করার এখতিয়ার আন্তর্জাতিক আদালতের রয়েছে। আইসিসি একটি আন্তর্জাতিক আদালত। সে হিসেবে আইসিসির এ অপরাধের বিচার করার এখতিয়ার থাকারই কথা। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় বা ভূখণ্ডগত এখতিয়ার কোনো বাধা হওয়ার কথা নয়। যদিও আইসিসি রাষ্ট্রীয় এখতিয়ারের বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করেনি।

দেখা যাক, আইসিসি কী কী অপরাধের বিচার করতে পারে। আইসিসি সনদের  (রোম স্টাটিউট অব দ্য ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট) অনুচ্ছেদ ৫-এ কোন কোন অপরাধের বিচার আইসিসি করতে পারে তা বলা হয়েছে। সে অনুযায়ী এই আদালত গণহত্যা (The crime of genocide),  মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, (Crimes against humanity),   যুদ্ধাপরাধ ( War crimes) ও আগ্রাসন (The crime of aggression) এর বিচার করতে পারে। এ প্রত্যেকটি অপরাধই আবার সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আইসিসিতে বর্ণিত প্রায় প্রত্যেকটি অপরাধই করেছে। তবে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধগুলো প্রত্যক্ষ ও সুস্পষ্টভাবেই আইনের দ্বারা প্রমাণিত (বিচারিকভাবে এখনও নয়)।   

অনুচ্ছেদ ৭ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের মধ্যে হত্যা (Murder), নিধন (Extermination), দাসত্ব (Enslavement), নির্বাসন বা জোরপূর্বক কোনো জনগোষ্ঠীকে স্থানান্তর করা (Deportation or forcible transfer of population),  বন্দিত্ব (Imprisonment etc), নির্যাতন (Torture), ধর্ষণ (Rape) যৌন দাসত্ব (Sexual Slavery), পতিতাবৃত্তি (Enforced Prostitution), গুম (Enforced Disappearance), জাতিগত হিংসা বা বিদ্বেষ (Crime of Apartheid) ইত্যাদিসহ আরও অপরাধকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও স্থানীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসীরা রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো হত্যা, নিধন, স্থানান্তর, নির্যাতন, ধর্ষণ, ভীতি সঞ্চার (Persecution against any identifiable group or collectivity on political, racial, national, ethnic, cultural, religious, gender) ও জাতিগত বিদ্বেষের মতো অপরাধে অভিযুক্ত।

আইসিসি সনদের আগেও এগুলো মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবেই চিহ্নিত ছিল। ন্যুরেমবার্গ, টোকিও, যুগোশ্লাভিয়া, রুয়ান্ডা ও সিয়েরা লিওন সনদেও এগুলো মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবেই স্বীকৃত। এসব অপরাধের বিচার করার নজিরও আছে। ফলে, মিয়ানমারে অপরাধের বিচার করতে আইসিসির এখতিয়ার না থাকার প্রশ্নটি অবান্তর।

এসব অপরাধের তদন্ত করতে আইসিসি যথেষ্ট স্বাধীন। আইসিসি সনদই তাদের এ স্বাধীনতা দিয়েছে। তারা যে কোনো  মারফতেই এসব অপরাধ সম্পর্কে অবহিত হয়ে তা আমলে নিতে পারে বা অন্তত তদন্ত করতে পারে। অপরাধ তদন্ত করতে আইসিসির কোনো সদস্যের সুপারিশ এমনকি নিরাপত্তা পরিষদেরও কোনো সুপারিশের প্রয়োজন নেই (অনুচ্ছেদ ১৩, ১৫)। এ ক্ষমতা প্রয়োগ করেই ২০০৯ সালে আইসিসি কেনিয়ার সহিংসতার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছিল। ঠিক একই প্রক্রিয়ায় তারা মিয়ানমারের অপরাধও তদন্ত করতে পারে।

এ কথা ঠিক যে অতীতে আইসিসি তার রাষ্ট্রীয় বা ভূখণ্ডগত এখতিয়ার প্রয়োগে যথেষ্ট সংরক্ষণবাদের পরিচয় দিয়েছে। এজন্য আইসিসিকে খোদ তার সদস্য রাষ্ট্রগুলোই যথেষ্ট সমালোচনা করেছে। আইসিসির জন্য সুবিধা হলো; রোহিঙ্গাদের ওপর সংঘঠিত অপরাধে কোনো পরাশক্তি সরাসরি জড়িত নয়, যেমনটি রয়েছে ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইয়েমেনসহ অপরাপর দেশগুলোতে। ফলে, মিয়ানমারের বিচার করা আইসিসির জন্য বড় কোনো চ্যালেঞ্জও নয়।

নিরাপত্তা পরিষদ বা আইসিসির ক্ষমতা ও এখিতয়ার নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। এ দু’টি সংস্থার ‘ক্ষমতার’ চেয়ে ‘ভূমিকার’ প্রশ্নটিই বারবার সামনে চলে এসেছে। তাই এবার আইসিসি ও নিরাপত্তা পরিষদের মিয়ানমারের ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নেওয়ার সময় ও সুযোগ সৃষ্টি  হয়েছে।  

মিয়ানমার আইসিসির সদস্য নয়। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদ যদি রোহিঙ্গা বিষয়টি আইসিসিতে বিচারার্থে প্রেরণ করে বা বিচারের জন্য সুপারিশ করে সেক্ষেত্রে বিচার করতে মিয়ানমারের সদস্য না হওয়া কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। কারণ আইসিসি সনদের ১৩ (খ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, “The Court may exercise its jurisdiction with respect to a crime referred to in article 5 in accordance with the provisions of this Statute if: ...A situation in which one or more of such crimes appears to have been committed is referred to the Prosecutor by the Security Council acting under Chapter VII of the Charter of the United Nations”। এছাড়া অনুচ্ছেদ ৮৭(৭) অনুযায়ীও নিরাপত্তা পরিষদ আইসিসিতে বিচারের সুপারিশ করতে পারে। জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ীই নিরাপত্তা পরিষদ এ পদক্ষেপ নিতে পারে। সুদান বা লিবিয়া কেউই আইসিসির সদস্য না হওয়ায়ও নিরাপত্তা পরিষদ ২০০৫ সালে সুদানের দারফুর সংকট ও ২০১১ সালে লিবিয়া সংকট আইসিসিতে তুলেছিল। এই বিবেচনা থেকে বলা যায়, মিয়ানমার আইসিসির সদস্য হওয়া না হওয়া কোনো অজুহাত হতে পারে না।

হিউমান রাইটস ওয়াচসহ অন্যান্য সংস্থা ও রাষ্ট্রগুলোও এর মধ্যে দাবিটি উত্থাপন করেছে। আমরা আশা করি, নিরাপত্তা পরিষদ অনতিবিলম্বে রোহিঙ্গাদের ওপর সংঘঠিত অপরাধ তদন্ত ও বিচারের জন্য আইসিসিকে সুপারিশ করবে। সেই সঙ্গে নিরাপত্তা পরিষদ তার নিজস্ব এখতিয়ার প্রয়োগ করে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণেও পিছপা হবে না।

লেখক
এরশাদুল আলম প্রিন্স
আইনজীবী ও কলাম লেখক

বাংলাদেশ সময়: ১১২২ ঘণ্টা, মে ৩১, ২০১৮
এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।