ঢাকা, শনিবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

প্রসঙ্গ : কোরবানি ঈদ ও মফস্বল সাংবাদিকতা

মুহম্মদ নাজিম উদ্দিন, সংবাদকর্মী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৫০ ঘণ্টা, নভেম্বর ৬, ২০১১
প্রসঙ্গ : কোরবানি ঈদ ও মফস্বল সাংবাদিকতা

ঈদ মানেই খুশি, ঈদ মানেই আনন্দ-তা চিরচরিত কথা। ধনী-গরিব নির্বিশেষে ঈদের নামাজে দাঁড়ালে এই বাণীর মর্মকথা খুঁজে পাওয়া যায়।

এর বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন। সবার কথা বাদই দিলাম। মফস্বল সাংবাদিকদের ...! যে কথা বলতেও লজ্জায় মুখ ঢেকে যায়।

ফজলুল বারী ভাই শেরপুরের এক সাংবাদিক পরিবারের ঈদ উদযাপনের বাস্তবধর্মী করুণ কাহিনী তুলে ধরেছেন। বেদনাদায়ক-নির্মম এ সত্য কাহিনি এ দেশের হেভিয়য়েট সাংবাদিক ও সাংবাদিক হাউসের মালিকদের কানে যায় না। শুনেও কুম্ভকর্ণের ঘুমে অচেতন থাকেন। তা না হলে গ্রামবাংলার সাংবাদিকদের জীবনমানের উন্নয়ন হয় না কেন? একমুঠো ভাত আর মোটা কাপড় পরে তারা কী বেঁচে থাকার অধিকার রাখে না। এ নিয়ে কি ভাবার-পুঞ্জিভূত সমস্যা সমাধান ও গবেষণার কেউ নেই।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোরে সেঁজুতিকে নিয়ে লিখেছেন বিদগ্ধ সাংবাদিক সুমি খান। তাঁর লেখার সূত্র ধরে লিখেছেন ফজলুল বারী, আসাদ জামান ভাইসহ আরও কয়েকজন। তাতে উঠে এসেছে সাংবাদিকতার হাঁড়ির খবর। সুযোগ পেয়ে মোক্ষমভাবে কাজে লাগায় সুবিধাবঞ্চিত সাংবাদিকরা। কাগজের বা মিডিয়ার মানুষদের করুণ কাহিনি ভেসে উঠেছে। বাংলানিউজ ধারাবারিকভাবে তা তুলে ধরলে হয় তো গ্রামীণ সাংবাদিকরা ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস খুঁজে পাবে।    

সাংবাদিকতা বিষয়ে পড়াশোনা করিনি বা সুযোগ পাইনি। গ্রাম্য সাংবাদিক হিসেবে যৎসামান্য সুযোগ পেয়েছি তাতে ‘ফলোআপ’ শব্দটির বেশ ভালো সখ্যতা রয়েছে। ফলোআপ এত কঠিন-নির্মম সত্য কাহিনি উঠে আসে তা চর্চা বা জ্ঞানদৈন্যতার অভাবে কখনো আঁচ করিনি। সুমি আপা সূত্র তুলে দিয়েছেন। তা নিয়ে পরবর্তীতে রীতিমত কলম যুদ্ধ-সংগ্রাম শুরু করেছেন কলম সৈনিকরা। বাদ পড়েনি গ্রামবাংলার হাজার হাজার অবহেলিত-নিগৃহীত, ন্যায্যহিস্যা বঞ্চিত নিপীড়িত সাংবাদিকরাও। সেই যুদ্ধে সমানতালে সামিল হয়েছেন আপামর কলম যোদ্ধারা।

১৯৭১ সালে আমরা পেয়েছি একটি গণতান্ত্রিক-স্বাধীন রাষ্ট্র। বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণের স্বপ্ন নিয়ে এ দেশ স্বাধীন হয়েছিল। স্বপ্ন ছিল সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার। একটি সুখী-সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশের। কিন্তু স্বাধীনতার ৪০ দশক পরও আমরা কতটুকু স্বাধীনতা ভোগ করতে পারছি, বৈষম্যহীন সমাজ কি পেয়েছি-সেই প্রশ্ন জাগা আজ স্বাভাবিক। দ্বিধাহীনচিত্তে বলা যায়, এখনো চলছে দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচর-নির্যাতন। ন্যায়-নীতি ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা যেন এখনো সুদূরপরাহত। বিশ্বায়নের যুগে চলছে দুর্বৃত্তায়ন।  

‘সেঁজুতি আর নাজিম উদ্দিনদের সংগ্রাম’ ফজলুল বারী ভাইয়ের লেখাটি সেই দিন প্রিন্ট করে এনেছিলাম। রাতে আমার স্ত্রী সোনিয়া খুবই উৎসাহ আর মনোযোগ দিয়ে আমাকে পাঠ করে শুনালেন। তবে মাঝপথে তিনি টিপ্পুনি কেটে বললেন, আমারও একদিন এ অবস্থার মুখোমুখি হতে হবে। সেই কথায় মন ভেঙ্গে পড়ে। তাকে মিথ্যা সান্ত¦না দিই। তবে এ বদনেশা ছেড়ে চুপিসারে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে জাগে মনে। কিন্তু এদেশ, মাটি, আলো, বাতাস ও মানুষের মমতার কথা ভাবতে ভাবতে যেন হারিয়ে যায় পরাজিত সৈনিকের মতো। এ কটি দিন কাটে একান্ত টেনশনে। এভারে আর কদিন চলবে। সততার কাছে বার বার যেন হেরে যাচ্ছি। জীবনটা ব্যর্থতায় পর্যবশিত হয়ে যাচ্ছে। ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। সাজাতে পারছি না। অমানিশার ঘোর অন্ধকারে কাটছে জীবন, রাত-দিন। সৎ ও সততার কাছে যেন হেরে যাচ্ছি।  

একজন নাজিম উদ্দিনের মনের দীর্ঘদিনের বঞ্চনার কথা বলতে গিয়ে দেখি গ্রামবাংলা হাজারো অবহেলিত সাংবাদিকদের মন-মননে মিশে যাচ্ছে। তারা তাদের অনুভূতির কথা জনালেন। তাতে সবার দুঃখ-বেদনা যেন এক সাগরে মিশে গেছে। বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে অনেক বন্ধুপ্রতীম গ্রামীণ সাংবাদিক ফোনে ও মেইলে বার বার জানাচ্ছে এই মর্মকথা। নারায়ণগঞ্জ থেকে মো. রাসেল বললেন, তিনি যে পত্রিকায় কাজ করছেন, কয়েক মাস সেই পত্রিকার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপিত হয়েছে বেশ ঘটা করে। সেখানে সাংবাদিকতা, সাংবাকিতার জীবনমান উন্নয়ন নিয়ে বিশিষ্টজনেরা সুন্দর সুন্দর কথামালা আর বক্তৃতার ফুলঝুড়ি ছড়িয়েছেন। কিন্তু তিনি দুই বছরেই সেই পত্রিকার স্বীকৃতিটুকু বা কোনো পরিচয়পত্র পাননি। এই নির্মম সত্য-ই যেন এ সাংবাদিকতা সমাজের বাস্তবতা। এমনটা হয় এ দেশে। অন্য দেশে এমন চিত্র আছে কীনা আমার জ্ঞান দৈন্যতাবশত: জানা নেই।

কোন পত্র-পত্রিকায় গ্রামীণ সাংবাদিকদের এ করুণ কাহিনির চিত্র কখনো উঠে আসেনি। ছাপাবে বলেও মনে হয় না। কারণ তারা অন্যায়-অনাচার ও বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণের কথা বলে। ফলোআপ করে। তারা নিজের কর্মীদের উপর কত নির্যাতন করেন, সেই কথা কেন জানবে জনগণ-পাঠক-দর্শকশ্রোতা। মিডিয়া এখন শিল্প মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হলেও কর্মীদের জীবন যেন নগণ্য নাগরিকেরা মর্যাদায় পরিগণিত। উদাহরণ টানলে দেখা যায়, গার্মেন্টস শিল্পে বেতন-বোনাস ও ন্যায্য হিস্যা আদায়ে সংগ্রাম-লড়াই হয়। মিডিয়া আর পত্রিকাওয়ালারা তা পুঁজি করে পত্রিকার কাটতি বাড়ায়। সংবাদ-মিডিয়াকর্মীদের আন্দোলন-সংগ্রামের কথা তেমন কী পাত্তা পায়। সাংবাদিকেরা যে কাগজের জন্য প্রাণ হারায়, সেই পত্রিকায়...।

চট্টগ্রামের বোয়ালখালী প্রেসক্লাবে বসে চুটিয়ে দাবা খেলছেন দুই সংবাদকর্মী। আড্ডায় রয়েছে কয়েকজন। এতক্ষণ ধরে দাবায় খেলায় মত্ত থাকায় কারণ জানতে চাইলে টিপু ভাই বললেন, এখন বন্ধ, নিউজের তাড়া নেই। সাথে সাথে পড়ে যাই হাশির রোল। কে বন্ধ দিয়েছে। টিপু ভাইয়ের উত্তর, নিজেরাই নিজেদের বন্ধ নিয়ে নিয়েছি। নিজেদের দায়িত্ব নিজেদের নিতে হয়। তিনি বললেন, কোরবানির ঈদে কী করব জানি না। শেষমেশ নিজেই যেন কোরবানি হয়ে যেতে হবে মনে হয়।

তার কথা একটু চিন্তা করে দেখি, সত্যিই তো কয়জন মফস্বল সাংবাদিক নিজের ইচ্ছায়-আপন খুশিমনে কোরবানি দিতে পেরেছেন। কীভাবে দেবেন। সম্মানী নামের যে অসম্মানী ভাতা পেয়ে থাকেন তা দিয়ে কী ঈদ ও কোরবানি উদযাপন করা যায়। হয়তো আমার মতো চেয়ে থাকতে হবে পিতা-ভাইয়ের দিকে। তাদের আনুকূল্যে জড় পদার্থের মতো বেঁচে থাকতে। আমার পিতা অনেক দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে আমাকে পড়াশোনা শিখেয়েছেন।

আমি সাংবাদিক, অভাগা সাংবাদিক। এই পেশাকে মমত্ত্ব দিয়ে ভালবাসি, শ্রদ্ধা করি। ন্যুনতম হলেও নীতি-নৈতিকতা মেনে চলার চেষ্টা করি। প্রায় এক দশকের পথচলায় পুলিশ, প্রশাসনপ্রেমিক সাংবাদিক হতে পারেনি। পারেনি মানুষের দুঃখ, দুর্বলতাকে পুঁজি করে টু পয়সা রোজগার করতে। নির্যাতিত-নিপীড়িত, অসহায় লোকজন আমার কাছেই ছুটে আসলে মাঝেমধ্যে রাগে-ক্ষোভে বলেই ফেলি, আরও তো সাংবাদিক আছে। ওদের কাছে না গিয়ে আমার কাছে কেন এসেছে। অন্য সাংবাদিকেরা তো ঠিকই টাকা-পয়সা কামিয়ে নিচ্ছে। এতসব ভেবে দেখার সময় তাদের নেই। তাদের চায় টাকা আর টাকা রোজগার। পাপের টাকাও তাদের পকেট ভর্তি হচ্ছে। ভালো দিন কাটছে তাদের। আমরা কয়জন শুধু নীতি-নৈতিকতার কথা বলে শূন্য উদরে কষ্টে দিন কাটাচ্ছি। ঈদে-কোরবানিতে বকশিসের জন্য হাত না পেতে সব কষ্ট-বেদনা বুকে নিয়ে বেঁচে আছি।

আমি আমার পরিবারের বড় সন্তান। নামের সিরিয়ালে আমার গর্বিত পিতা-মাতার পর আমার নামে পশু কোরবানি হবে। কিন্তু পশু ক্রয়ে আমি একটি টাকাও দিতে পারিনি। কী নির্মম সত্য কথা। বলতে একটুকু বুক কাঁপছে না। কীবোর্ড আরও দ্রুত কাজ করছে। আমি একটি স্থানীয় পত্রিকার পাশাপাশি জাতীয় একটি নামকরা দৈনিকের প্রতিনিধি ছিলাম। স্থানীয় পত্রিকার প্রতিনিধি থাকার অপরাধে দুই মাস আগে জাতীয় দৈনিকটি আমাকে বাদ দিয়ে দেয়। কোনো কারণ দর্শানো ছাড়া বা আত্মপক্ষের সুযোগ পর্যন্ত না দিয়ে হুট করে চাকরিচ্যূত করে। এক মিনিটেই চাকরিচ্যূত হই। গ্রিনিচবুকেও এমন ইতিহাস আছে কিনা জানা নেই। একটি অন্যায়-অনাচার সিন্ধান্ত মাথা পেতে মেনে না নেওয়া ছাড়া আমার গত্যন্তর নেই। চাকরিচ্যূতের কথা পরিবারকে বুঝতে দেইনি। তবে অর্থকষ্টের বিষয়টি তারা অনুভব করছেন। আমার ছোট ভাইয়ের আনুকূল্য নিয়ে পরগাছার মতো এখন বেঁচে আছি। আমি নিশ্চিত, আমার মতো হাজারো অভাগা সাংবাদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে। যারা আপন খুশিতে উদযাপন করতে পারছে না ঈদুল আজহার ঈদ। হৃদয়ের গহীনে জমানো বেদনাবিধূর কথা প্রকাশ করে তাদের চিত্তে আগুন জ্বালানোয় সবার কাছে আমি অভাগা ক্ষমা প্রার্থী। তবুও বলব, ঈদ সবার জীবনে আনন্দ আর খুশির বারতা নিয়ে আসে। এটা সৃষ্টিকর্তার অমোঘ বিধান।

বারী ভাইকে ধন্যবাদ জানাতে হয়, তিনি সুদূর সিডনি থেকে মফস্বল সাংবাদিকদের পাশে দাঁড়ানোর প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন। বারী ভাই, আপনি আমাদের বেদনা জানেন, বাস্তবতা অনুভব করেছেন। কিন্তু আমাদের দেশের মালিকপক্ষ ও ডাকসাইটের সাংবাদিক নেতারা নিজেদের অধিকার-স্বার্থ নিয়ে নিজেরা অনঢ়। সেখানে পিছিয়ে থাকা-অবহেলিত গ্রামবাংলার সাংবাদিকদের খোঁজ নেওয়ার সময় কী তাঁদের আছে। আমরা তো জীবন সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত। শুধু সেইদিনের অপেক্ষায়। একটি ডাক দিলেই হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালার মতো ছুটে আসবে গ্রামীণ সাংবাদিকেরা। বঙ্গবন্ধুর ৭ ই মার্চের সেই বজ্রনিনাদ-তেজোদীপ্ত-কালজয়ী ভাষণ কে দেবেন। কে ডাকবে আমাদের। আমাদের ন্যায্য অধিকার নিয়ে কে বলবে। সেই অপেক্ষায়...।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।