ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

টিপাইমুখ আন্দোলন...পোশাকি নেতা-নেত্রীর বাহারি শোডাউন?

ফারুক যোশী, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৩, ২০১১
টিপাইমুখ আন্দোলন...পোশাকি নেতা-নেত্রীর বাহারি শোডাউন?

টিপাইমুখ এখন সারাদেশে রাজনীতিকদের এক প্রধান ইস্যু। ইস্যুটি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ এবং জনগণের এতে সমর্থন থাকাটাই উচিত।

সারা দেশের মানুষ এ আন্দোলনের পক্ষে থাকুক বা না থাকুক, অন্তত বৃহত্তর সিলেটের মানুষ এ আন্দোলনে নীতিগত সমর্থন দেবেই। কারণ বিভিন্ন সমীক্ষার মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসছে ভারতের বরাক নদীর টিপাইমুখে বাঁধ হয়ে গেলে সিলেটের বিস্তীর্ণ অঞ্চল বিরান হয়ে যেতে পারে। টিপাইমুখ বাঁধ দিয়ে ভারত বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গেলে কিংবা তাদের প্রয়োজনে বাংলাদেশের পানি নিয়ন্ত্রিত হবে সময়ে-অসময়ে।

এমনিতেই টিপাইমুখের পার্শবর্তী বাংলাদেশের এই এলাকা দেশের সবচেয়ে নিম্নাঞ্চল। অন্যদিকে শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ না থাকলে এতে করে শুষ্ক মৌসুমে একেবারেই শুকিয়ে যাবে গোটা এলাকা। এছাড়া পৃথিবীর অন্যতম প্রধান ভুমিকম্প ঝুঁকিপ্রবণ(দ্বিতীয় ঝুঁকিপ্রবণ)এলাকা হিসেবে চিহ্নিত এই টিপাইমুখ। সেকারণেই এখানে বাঁধ নির্মিত হলে সব সময়ই এখানে অপেক্ষা করবে অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর হাতছানি।

এছাড়া বাঁধ নির্মান করা হলে পরিবেশ বিপর্যয়তো ঘটবেই, এমনকি এই এলাকার হাজারো-লাখো মানুষের বেঁচে থাকার প্রধান উপায় মাছধরার জায়গা থাকবে না, পানি প্রবাহ না থাকায় অনেকটা মরুভূমি হয়ে যাওয়া এই অঞ্চল কৃষিকাজের জন্যে তার একশত ভাগ কার্যকরতা হারাবে। কোনও কারণে ভূমিকম্প হয়ে গেলে বৃহত্তর সিলেটের কতলোক মারা যাবে তার হিসেবও কষা দায় হয়ে পড়বে।

হাল আমলে জাপান পর্যন্ত তাদের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি দিয়েও ঠেকাতে পারেনি এরকম বিপর্যয়। আর সে কারণে আমাদের সবাইকে এ কথা স্বীকার করতেই হবে, এরকম বিপর্যয় সামনে জেনেও কেনইবা বৃহত্তর সিলেট জেলার লাখো-কোটি মানুষের সাথে এই হত্যা-হত্যা খেলা? এরকম বিপর্যয় কোনওকালে ঘটলে এর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকবে না গোটা বাংলাদেশ। খুব স্বাভাবিকভাবেই আগামীর এই বিরান হয়ে যাওয়াটা বড় হয়ে উঠে আসছে, গণমাধ্যমগুলো এরই মধ্যে এ নিয়ে ব্যাপক প্রচার চালাচ্ছে। বিএনপি তার দলীয় লং মার্চে এবং রাজনৈতিক প্রচার-প্রচারনায় এ নিয়ে সোচ্চার। পদযাত্রা করেছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিসহ বামপন্থি দলগুলোও। লংমার্চ করেছেন বাংলাদেশের আরেক সাবেক রাষ্ট্রনায়ক এরশাদ। টিপাইমুখ ইস্যুটা তারা জনসমক্ষে নিয়ে আসতে পেরেছেন। মিডিয়ার প্রধান খবর ছিলো এটা এবং এখনও আছে।

টিপাইমূখ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কিন্তু দীর্ঘদিনের।   ভারত তার জাতীয় প্রয়োজনে এখানে একটি বাঁধ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তার প্রস্তাব সেই ১৯৫৫ সালেই  করে রেখেছিলো। পরে অনেক তর্ক-বিতর্কের পর ১৯৯৩ সালে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু ভারত সরকার তার নিজের দেশেই এ নিয়ে সমালোচনার সম্মুখীন হয়। আসাম-মণিপুর-মিজোরাম প্রভৃতি রাজ্যে এ নিয়ে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়। আসামে আসাম বন্ধ ও হয়েছে। কিন্তু তারপরও যেন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত সরকার তার প্রকল্প বাস্তবায়নে দৃঢ়তারই পরিচয় দিতে চাইছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীও বার বার যেন জানিয়ে দিতে চাইছেন ভারত যা করছে, তাতে বাংলাদেশে কোনও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। অনেকটা বলতে চাইছেন, ভারত যেন তা আমাদের ভালোর জন্যেই করছে। মনমোহন সিং কিংবা ভারতের যেন বাংলাদেশ প্রতিনিধি হয়েই তিনি এ কথাগুলো বলছেন। বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি দিয়েছিলেন উত্তরও পেয়েছেন। কিন্তু তিনি চুপ করে আছেন। কী এমন কথা চিঠির উত্তরে। তবে এটা নিশ্চিত, আশ্বাস আছে। আশ্বাস দেওয়া রাজনীতিবিদ কিংবা রাষ্ট্রপ্রধানদের রাজনৈতিক মিথ্যাচারেরই আরেক নাম। মনমোহন সিংয়ের আশ্বাসও হয়ত তা-ই। কারণ একটা ব্যাপার এখানে লক্ষ্যণীয়, ভারতের অভ্যন্তরেই যেখানে বিভিন্ন রাজ্যে চলছে এ নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম, যেখানে তাদের রাষ্ট্রের ভেতরের মানুষগুলো এই আশ্বাসে আস্থা রাখতে পারছে না, সেখানে আমরা কতটুকুই আস্থা রাখতে পারবো। খুব স্বাভাবিকভাবেই আমরা আস্থা রাখতে পারছি না।

কিন্তু কথা হলো ভারত যদি চায়, তবে হয়ত বাঁধ নির্মাণ করেই ফেলবে। বাঁধ-প্রতিবাদে কিছুই হয়ত যাবে আসবে না। যেমনটা চীন ভারতের ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকায় তাদের ইয়াংলু সাংপো নদীতে বাঁধ দেবার ঘোষণা দিয়ে প্রায় সমান ব্যাপারটাই ঘটাতে যাচ্ছে। এতে করেও বিপদগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ, কেননা ব্রহ্মপুত্রই বাংলাদেশে এসে যমুনা নাম ধারণ করেছে। চীনের এই বাঁধ নির্মাণে ভারত রাষ্ট্রীয়ভাবে যতটুকু প্রতিবাদ করছে, তার চেয়ে বেশি প্রতিবাদ ধ্বনিত হচ্ছে গণমাধ্যমগুলোতে। কেননা গণমাধ্যমই সরকারের দুয়ারে কড়া নাড়তে পারে। আর সেকারণে বাংলাদেশ যদি এর রাষ্ট্রীয় প্রতিবাদ করে, অন্তত সেখানে একটা সুফল মিলতে পারে।

মজার ব্যাপার হলো এখন টিপাইমুখ নিয়ে একটা বাহারি আন্দোলন যেন চলছে দেশে। লংমার্চ নাম নিয়ে প্রধান বিরোধী দল আর এরশাদের যেন চলছে নির্বাচনী প্রচারনা। বিএনপি তার স্বভাবসিদ্ধ ভারত-বিরোধিতার একটি মওকা পেয়েছে। এই মওকা পেয়েই শত-সহস্র গাড়ির বহর নিয়ে চালিয়েছে সিলেটযাত্রা কিংবা টিপাইমূখযাত্রা। শেষ যাত্রাটি করেছেন এরশাদ তার দলবল নিয়ে। তিনি সিলেটে বক্তৃতা দিয়েছেন। বক্তৃতা দিয়েছেন গোলাপগঞ্জে, জকিগঞ্জে। দু‘জায়গায়ই বলেছেন প্রাণের টানে, সিলেটের টানে তিনি সিলেটের এই দুর্দিনে বসে থাকতে পারেননি। তাইতো তিনি ছুটে এসেছেন। সিলেটের মানুষের আজকের এই দুর্দশায় তিনি পাশে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। গোলাপগঞ্জ-জকিগঞ্জে তিনি আগামীতে একক নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা বলে তার সম্ভাব্য প্রার্থীদেরও পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। জকিগঞ্জের সভায় তিনি উচ্চারণ করেছেন একটা খাঁটি কথা। তিনি বলেছেন বৃহত্তর সিলেটের এই দুর্দিনে শুধু তিনিই আসেননি, নিয়ে এসেছেন এক হাজার গাড়ি। অর্থাৎ প্রকারান্তরে বুঝিয়েছেন তার দলেও আছেন পরাক্রমশালী ব্যক্তিরা। হাজার হাজার কোটিপতি। এই কোটিপতিদের নিয়ে করেছেন বিলাসভ্রমণ। সুন্দর টাই-স্যুট পরে জনগণের স্বার্থে রোডমার্চ করেছেন।

রোডমার্চ মানে কি ? রোডমার্চে জনতার সাথে নেতাদের সাক্ষাৎ হয়। আদান-প্রদান হয় জাতীয়-আঞ্চলিক বিভিন্ন ইস্যুর। মানুষের সাথে মিলে-মিশে জনতার কথা-বার্তা শোনে জনগণের কাতারে মিলিত হয়েই সত্যিকার অর্থে জনগণের নেতা হয়ে ওঠেন একজন মানুষ কিংবা একজন নেতা।

কিন্তু না, বাংলাদেশের মতো গরীব দেশের মিলিয়নিয়ার নেতা-নেত্রীরা রোডমার্চ করে শোডাউন করেন পৃথিবীর বিখ্যাত কোম্পানিগুলোর কোটি টাকার গাড়ির। এরা জনগণের কাতারে না এসে ধুলা আর বালির সংস্পর্শে না এসে খেটে খাওয়া মানুষের কথা বলে। এয়ার কন্ডিশনড গাড়িতে বসেই মজুরদের কথা বলে এদের সাথে ভেলকিবাজি করে আবারও সেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সুরম্য সংসদ ভবনে চলে যায়। আর সেই ভেলকিবাজীর নামই মূলত রোডমার্চ। রোডমার্চ মূলত শোডাউন... পাজেরো, পোরশে, বিএমডব্লিউ এক্স ফাইভ প্রভৃতির। প্রকারান্তরে কালোটাকার।

আর তাইতো আমাদের প্রশ্ন জাগে, ঐ কালোটাকার মালিকদের নিয়ে। আর যাই করুন না কেন, যতই চেঁচামেচি এরা করেন না কেন, আমরা কেন যেন আস্থা রাখতে পারি না, এদের দিয়ে আদৌ কি টিপাইমূখ আন্দোলন হবে? এ প্রশ্নটি থেকেই যায়। কারণ যে কোনও আন্দোলন-সংগ্রামে বিদেশিদের হাতের ক্রীড়ণক হতে এদের খুব একটা  সময় লাগে না।

এই বাংলাদেশেই হয়েছে সিমিটার বিরোধী আন্দোলন, এখানেই হয়েছে এশিয়া এনার্জির বিরুদ্ধে আন্দোলন। সবকটিতেই ঐ গাড়িওয়ালা দলগুলো মানুষের সাথে মিশতে ব্যর্থ হয়েছে। এশিয়া এনার্জির বিরুদ্ধে আন্দোলনেও বড় দলগুলোর সরব উপস্থিতি ছিলো না, এখনও নেই। হাল আমলের কনোকো-ফিলিপস এর কাছে গ্যাসক্ষেত্র লিজ দেওয়ার প্রতিবাদেও নেই এই খালেদা-এরশাদের বড় বড় দলগুলো। সুতরাং এইসব বাহারি আন্দোলনে আমরা কতটুকুই-বা আস্থা রাখি তাদের উপর। ইতিহাসতো তাদের উপর আস্থা রাখতে সহায়তা করে না।

ফারুক যোশী: যুক্তরাজ্য প্বাসী সাংবাদিক ও কলাম লেখক

Faruk.joshi@gmail.com

বাংলাদেশ সময় ১১৩২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৩, ২০১১

মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।