ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

জান্নাতীর মুখের হাসি

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫২২ ঘণ্টা, নভেম্বর ১, ২০১৯
জান্নাতীর মুখের হাসি ছবি:সংগৃহীত

১.
বেশ কিছুদিন আগের কথা। একটি প্রতিষ্ঠান শিশুদের নিয়ে একটি অনুষ্ঠানে আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। আমি নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে করি কারণ শিশুদের অনেক অনুষ্ঠানে এবং মাঝে মাঝে বাচ্চাদের স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের সাথে কথা বলার সুযোগ পাই। তবে এবারে যে অনুষ্ঠানে আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে সেটি অন্য যে কোনো অনুষ্ঠান থেকে ভিন্ন। কারণ এই অনুষ্ঠানে আসছে ঢাকা শহরের বিভিন্ন বাসার ছোট ছোট গৃহকর্মীরা।

ঠিক সময়ে হলে উপস্থিত হয়ে দেখি হল বোঝাই ছোট ছোট শিশু। গৃহকর্মীদের যে এক ধরনের মলিন চেহারা বা পোশাক থাকে আজকে সেটি নেই, সবাই সেজেগুজে এসেছে।

বিশেষ করে যারা স্টেজে গান গাইবে বা নাচবে তারা আলাদাভাবে সেজে এসেছে। আয়োজকরা গৃহকর্তা বা গৃহকর্ত্রীদের অনুমতি নিয়ে তাদেরকে পুরোদিনের জন্য নিয়ে এসেছিল, সারাদিন নানাভাবে কাটিয়ে বিকেলে এখানে এসেছে। বাচ্চাগুলো প্রথমে নাচ-গান এরকম নানা ধরনের অনুষ্ঠান করল, তারপর এক সময়ে আমাকে স্টেজে তুলে দেওয়া হল তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলার জন্য।

বড় মানুষদের অনুষ্ঠানে যখন আমাকে বক্তব্য রাখতে হয় তখন সবসময়েই কী বলব কিংবা কীভাবে বলব সেটা নিয়ে এক ধরনের সমস্যায় পড়ে যাই। ছোট বাচ্চাদের অনুষ্ঠানে আমার কখনোই সেই সমস্যা হয় না। আমি যে কোনো সময় তাদের সাথে যে কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারি। কিন্তু এই প্রথম আমি মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে এই বাচ্চাগুলোকে কী বলব ভেবে পেলাম না। স্কুলের ছেলেমেয়েদের সাথে আমি লেখাপড়ার কথা বলতে পারি, এই বাচ্চাদের আমি সেটা বলতে পারব না। তাদের কেউই স্কুলে লেখা পড়ার সুযোগ পায়নি। ছোট ছেলেমেয়েদের আমি মাঠেঘাটে দৌড়াদৌড়ি করে খেলাধূলা করার কথা বলতে পারি। এই বাচ্চাদের আমি সেটা বলতে পারব না, তারা বাসায় কাজ করে, বাসন ধোয়, ঘর ঝাড় দেয়, কখন তারা খেলাধুলা করবে? আমি সুযোগ পেলেই বাচ্চাদের দেশের কথা বলি, তাদের মনে করিয়ে দিই আমাদের দেশটিতে তাদের জন্য কতো সুযোগ অপেক্ষা করছে। এই বাচ্চাদের আমি কেমন করে দেশের কথা বলব? দেশ কী সত্যিই তাদের কিছু দিয়েছে? সত্যিই কি কিছু দেবে? ছোট ছেলেমেয়েদের আমি ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন দেখানোর চেষ্টা করি। এই ছেলেমেয়েদের আমি কোন ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখাব?

আমি মাইক্রোফোন হাতে কিছুক্ষণ মঞ্চে দাঁড়িয়ে রইলাম। তারা কী চমৎকার একটি অনুষ্ঠান করেছে এবং দেখে আমি কতো মুগ্ধ হয়েছি এরকম অবান্তর কিছু বলে আমি আমার বক্তব্য শেষ করে দিয়ে বললাম। আমি তাদের সবার জন্য একটা করে বই উপহার এনেছি। আমি বক্তৃতা না দিয়ে বরং তাদেরকে সেই বইগুলো দিই।

আয়োজকরা আপত্তি করলেন না এবং আমি তখন স্টেজে পা ঝুলিয়ে বসে গেলাম। আনুষ্ঠানিক প্রোগ্রামের বারোটা বেজে গেল এবং বাচ্চাগুলো আমাকে ভিড় করে ঘিরে দাঁড়ালো। কতোজন বাচ্চা আসবে আমি জেনে নিয়েছিলাম এবং সবাইকে যেন একটা বই দেয়া যায় সেই সংখ্যক বই নিয়ে এসেছিলাম। বাচ্চাদের অনেকেই লেখাপড়া জানে না। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না তারা খুবই আগ্রহ নিয়ে নিজের উপহারটি নিল। এর মাঝে হঠাৎ একটি শিশু বইটিতে আমার অটোগ্রাফ নিতে চাইল, তখন তার দেখাদেখি সবাই তাদের বই নিয়ে এলো অটোগ্রাফ দেওয়ার জন্য। আমি বসে বসে অটোগ্রাফ দিতে দিতে তাদের সাথে কথা বলেছি। বেশ অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছি, এক-দুইজন বাসায় কাজ করার পাশাপাশি কাছাকাছি কোনো একটা স্কুলে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে। যার অর্থ বাসায় গৃহকর্মী হলেই তাকে সারা জীবন নির্যাতন সহ্য করে একটি অসহনীয় জীবন কাটাতে হবে সেটি সত্যি নয়, গৃহকর্তা কিংবা গৃহকত্রী যদি স্নেহপ্রবণ হন তাহলে এই শিশুদের একটা সুন্দর জীবন উপহার দেওয়া যায়।

আমার মাঝে মাঝেই এই ফুটফুটে শিশুগুলোর কথা মনে পড়ে। এই আয়োজকদের আগ্রহে তারা তাদের দৈনন্দিন একঘেঁয়ে আনন্দহীন জীবনের মাঝখানে একটি দিনকে আলাদাভাবে উপভোগ করেছিল। তারা ছিল খুবই সৌভাগ্যবান গৃহকর্মী! তাদের গৃহকর্তা বা গৃহকর্ত্রী তাদেরকে তাদের মত করে একটি দিন কাটাতে দিয়েছিল। অনুষ্ঠানের আয়োজন করার জন্য নাচ গানের রিহার্সাল করতে দিয়েছিল। কিন্তু অন্য গৃহকর্মীরা কেমন থাকে?

আমরা সাধারণত তাদের খোঁজ পাই না। জান্নাতীর মত একজন শিশু যখন খবরের কাগজের সংবাদ হয়ে যায় তখন হঠাৎ করে কয়েকদিনের জন্য আমরা শঙ্কিত হই। তারপর আবার ভুলে যাই। দেশ নিয়ে, সমাজ নিয়ে পৃথিবী নিয়ে কতো কী গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে যাচ্ছে এই বাচ্চাদের নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার সময় কোথায়?

২.

সংবাদপত্রের তথ্য অনুযায়ী আমাদের দেশে শিশু গৃহকর্মীর সংখ্যা প্রায় বিশ লাখ। এই দেশে জেএসসি পরীক্ষার্থীর সংখ্যাও প্রায় বিশ লাখ। অর্থাৎ এই দেশে স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে, লেখাপড়া করার সুযোগ পেয়েছে এবং জেএসসি পরীক্ষার সুযোগ পেয়েছে এরকম প্রতিটি শিশুর জন্য একজন করে শিশু আছে যারা স্কুলে যাওয়ার বা লেখাপড়া করার সুযোগ পায়নি। জেএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হওয়ার পর সাংবাদিকেরা যখন দেশের ভালো ভালো স্কুলে গিয়ে হাত উঁচু করে ‘ভি সাইন’ দেখায়, আনন্দমুখর হাস্যোজ্জাল ছেলেমেয়েদের ছবি দেখায়, তখন আমাদের কল্পনা করে নিতে হবে যে প্রত্যেকটা হাসিমুখের পিছনে একটি করে মলিন মুখের শিশু আছে, যাকে আমরা কিছু দিতে পারিনি। তাদের অভাবী বাবা-মায়েরা এই শিশুকে পেটেভাতে কিংবা অতি সামান্য বেতনে অপরিচিত নির্বান্ধব আনন্দহীন পরিবেশ সপ্তাহে সাত দিন এবং প্রতি দিন চব্বিশ ঘণ্টা কাজ করতে দিয়ে এসেছে।

এক-দুটি পরিবারের সজ্জন মানুষেরা হয়তো এই শিশুগুলোকে আদর করে নিজের সন্তানের মত দেখে শুনে রাখেন কিন্তু বেশিরভাগ শিশুদের জীবন দুর্বিষহ। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য হচ্ছে, প্রতি বছর গড়ে ৫০টি শিশু গৃহকর্মী নির্যাতনের জন্য মারা যায়। মৃত্যু হচ্ছে নির্যাতনের একেবারে চরম রূপ, একেবারে শেষ পর্যায়, নৃশংসতার সবচেয়ে ভয়াবহ ছবি। কিন্তু সেই শেষ পর্যায়ে পৌঁছানোর আগে আরো আরো অনেকগুলো ধাপ আছে। যদি ৫০ জন শিশুকে নির্যাতন করে হত্যাই করে ফেলা হয়, তাহলে কতোগুলো গৃহকর্মীদের না জানি কতোভাবে নির্যাতন করা হয় যার খবর আমরা কোনোদিন জানতে পারি না। খবরটি শেষ পর্যন্ত যখন খবরের কাগজ পর্যন্ত পৌঁছায় তখন চক্ষুলজ্জার খাতিরে কিছু একটা করতে হয়। কিন্তু যদি খবরের কাগজ পর্যন্ত না পৌঁছায় তখন কী হয়?

আমার মনে অনেকদিন থেকে খুব সহজ একটা প্রশ্ন। যদি প্রতি বছর ৫০ জন শিশু গৃহকর্মীকে নির্যাতন করে হত্যা করে ফেলা হয় তাহলে গড়ে প্রতি বছর ৫০ জন হত্যাকারীদের বিচার করে ফাঁসি দিতে দেখি না কেন? ফাঁসি যদি নাও হয় অন্তত বিচার করার এবং ঠিক ঠিক শাস্তি দেওয়ার খবরটি আমরা শুনতে পাই না কেন? আমরা শুধু নির্যাতনের খবরটি পাই কিন্তু নির্যাতনের বিচার করে শাস্তি দেওয়ার খবরটি কেন পাই না? যদি বছরে ৫০ জনের বিচার করা হয় তাহলে প্রতি মাসে চারটি বিচারের খবর থাকার কথা। প্রতি সপ্তাহে একটি। তাহলে সেই খবরগুলো কোথায়? হত্যা মামলার বিচার কী অনেক গুরুত্ব দিয়ে গণমাধ্যমে আসার কথা নয়?

প্রকৃত কারণটি আমি জানি না। অনুমান করতে পারি যারা এই অসহায় অবোধ শিশুগুলোকে নির্যাতন করে মেরে ফেলেন, তারা সমাজের উপর তলার মানুষ। তারা ছলে বলে কৌশলে মামলার সেই বেড়াজাল থেকে বের হয়ে আসেন। সম্ভবত শেষ পর্যন্ত কিছুই হয় না। যেহেতু খবর দেওয়ার মত কিছুই নেই তাই আমরা কোনো খবরই পাই না। সাংবাদিকেরা একটা একটা করে সবগুলো হত্যাকাণ্ডের তালিকা করে কোনটি বিচারের কোন পর্যায়ে আছে, কারা পুরোপুরি ছাড়া পেয়ে বহাল তবিয়তে নিজের সন্তান এবং পরিবার নিয়ে সুখে দিন-কালপাত করছে সেগুলো আমাদের জানাতে পারে না? আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে।

৩.

শিশু জান্নাতীর হত্যাকাণ্ডটি আমাদের সবাইকে খুব কষ্ট দিয়েছে। যে ভদ্রমহিলার নির্যাতনে এই শিশুটি মারা গেছে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। স্ত্রীকে ফেলে রেখে স্বামী ভদ্রলোক পলাতক। হয়তো ধরা পড়বেন। হয়তো গ্রেপ্তার হবেন হয়তো কখনো বিচার হবে। হয়তো আইনের নানা ফাঁক দিয়ে বের হয়ে যাবেন কারোই বিচার হবে না। আমরা কয়দিন পরে ভুলে যাব। যখন নূতন আরেকজন জান্নাতী এরকম নৃশংস অত্যাচারে মারা যাবে তখন কয়েকদিনের জন্য আমরা সচকিত হব, আবার খবরের কাগজে লেখালেখি হবে।

আমার মাঝে মাঝেই মনে হয় এই দেশে তার চাইতে বেশি কিছু কি করা যায় না? মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান কিংবা গৃহকর্মীদের সুরক্ষার সংগঠনগুলো নিশ্চয়ই ভেবে ভেবে বের করেছেন ঠিক কীভাবে এই গৃহকর্মীদের রক্ষা করা যায়। কীভাবে তাদের আনন্দময় জীবন উপহার দেওয়া যায়। সেটা সত্যি সত্যি বাস্তবে রূপ দেওয়া কতোটুকু কঠিন?

আমি ইদানিং অনেক কিছু নিয়ে খুব আশাবাদী। যে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে বলতে আমরা প্রায় হাল ছেড়ে দিই হঠাৎ করে দেখি সেটা হয়ে গেছে। আমি বিশেষ করে আমাদের হাই কোর্টের ভূমিকা দেখে খুবই মুগ্ধ। এই দেশের রুগ্ন নদীগুলো যেন আমাদের মত জীবন্ত মানুষ, তাই তাদের প্রায় মানুষের মর্যাদা দিয়ে দেওয়া আমার কাছে অসাধারণ মনে হয়েছে। আমি বিশেষ মুগ্ধ হয়েছি মেয়েদের জন্য আলাদাভাবে কিছু নির্দেশনা দেওয়ার বিষয়গুলোতে। যেমন- বিয়ের সময় শুধু মেয়েদের তাদের কৌমার্য্য বিষয়ে তথ্য দেওয়ার বিধান ছিল। এখন সেই বৈষম্যটি দূর করা হয়েছে। শ্রমজীবী মা’দের সন্তানদের জন্য তাদের কাজের জায়গায় ডে কেয়ার তৈরি করার অসাধারণ একটি মানবিক ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয় কর্মক্ষেত্রে মায়েরা যেন তাদের সন্তানদের বুকের দুধ খাওয়াতে পারেন তার আলাদা জায়গা করে দেওয়ার একটি চমৎকার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

আমাদের দেশের গৃহকর্মীদের প্রায় সবাই মেয়ে। আমি স্বপ্ন দেখি তাদেরকে আলাদাভাবে সুরক্ষা করার জন্য হঠাৎ করে হাইকোর্ট থেকে একটি নির্দেশনা চলে আসবে। একটি শিশুকে স্কুলে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে না পারলে তাকে গৃহকর্মী হিসেবে নেওয়া যাবে না, এটি কী খুব বেশি চাওয়া?

জান্নাতীর মুখের মিষ্টি হাসিটির কথা ভোলা কঠিন। এর চাইতে সুন্দর দৃশ্য আর কী হতে পারে? কেন আমরা হাসিটি রক্ষা করতে পারলাম না?

বাংলাদেশ সময়: ০১২২ ঘণ্টা, নভেম্বর ০১, ২০১৯
এমএমএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।