ভূমিদস্যু, জলদস্যুদের মতো এরা গোপনে কিছু করে না। অন্য দস্যুরা যেখানে প্রচারের বাইরে থেকে সব অপকর্ম করতে চায়, এরা চায় উল্টোটা।
আরে যা কিছু বলা, লেখা তো ব্যক্তি-স্বাধীনতা, তাই না! এই স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার সাধ্য ক’জনের আছে? যাদের সেই ‘ক্ষমতা’ আছে, তাদের না ঘাটালে বা সুকৌশলে এড়িয়ে যেতে পারলে নিরাপদে ঘরে বসেই বেশ করে খাওয়া যায়। খুব বিতর্কের জন্ম দেয়া যাবে, কিংবা অনেকের গালমন্দ খাওয়া যাবে এমন একটা ভিডিও করে ছেড়ে দিন, ব্যাস, কেল্লা ফতে। ‘জ্ঞানী’, ‘মূর্খ’, ‘ভদ্রলোক’, ‘ছোটলোক’ সবাই হামলে পড়বে সেই ভিডিওতে।
ভিডিও দেখে কিছু লোক গালমন্দ করবেন, কিছু লোক ‘মজা নেয়া’র জন্য দেখবেন চুপ করে, কেউ কেউ আবার ভিডিও দেখে বিষয়ের গুরুত্ব বা গভীরতা খুব বুঝে বা না বুঝেও বলবেন, ‘হোক না অসুবিধা কী!’ যে যা বলবে বা করবে তাতেই ভিউদস্যুর লাভ। একবার দেখলে বা ভিডিওতে ক্লিক করলেই হলো। আলোচনা-সমালোচনা বাড়বে, ভিউ বাড়বে এবং ‘ভিউদস্যু’রা মহাখুশি হবে।
ভিডিওর ভিউ বেশি হলে আজকাল ট্যাকে টাকা আসে, ‘ভাইরাল ভিডিওর জন্মদাতা’ হিসেবে জনপ্রিয়তার স্বীকৃতিও জুটে যায় অনায়াসে। রোদ্দুর রায় এমনই এক ‘ভিউদস্যু’।
বেঁচে থাকার জন্য সব পরগাছারই একটা শক্তসমর্থ গাছের দরকার হয়। সেদিক থেকে দেখলে বেশিরভাগ ভিউদস্যুকে এক ধরনের পরগাছা বলাই যায়। রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু পরগাছাকে অতীতেও দেখা গেছে। পরগাছার ‘কাজই হলো’ গাছের ‘ক্ষতি’ করে বেঁচে থাকা। তবে কিছু গাছ একটা-দুটো পরগাছার কারণে শেষ হয়ে যায় না।
রবীন্দ্রনাথ সেরকমই এক বটগাছ। সে কারণে অনেক ঝড়-ঝাপটা সয়েও তিনি স্বমহিমায় টিকে আছেন। সমালোচকের অভাব হয়নি কখনো। কোনো কোনো সমালোচক ‘শত্রু’র মতো আচরণও করেছেন। সজনীকান্ত দাসের সম্পাদনায় ‘শনিবারের চিঠি’ কী কী করেছিল তা অনেকেরই জানা আছে। রবীন্দ্রনাথের নোবেল জয় নিয়ে ‘ভ্রান্তি’ নাম দিয়ে এক কবিতায় লেখা হয়েছিল,
‘নোবেল খেলাত গেল যবে কবি
য়ুরোপ ঘুরে,
খুসীর খেয়ালে যারা গিয়েছিল
শ্রীবোলপুরে,
বোলপুর নহে, যেন সে স্বর্গে
পুজিতে তাহারে পাদ্যঅর্ঘ্যে-
ফিরে এল পেয়ে চতুর্ব্বর্গে-
করুণ সুরে
ভর্ৎসনা কত হল বর্ষিত,
আসিল ঘুরে। ’
রবীন্দ্রনাথ একবার বরং সজনীকান্তকে লিখেছিলেন, ‘তোমার বিদ্রুপের প্রখর অগ্নিবাণে বড় বড় মহামহোপাধ্যায়ের পণ্ড পাণ্ডিত্যের বর্মচ্ছেদন যখন করো তখন তার মধ্যে একটা মহাকাব্যিক মহিমা দেখতে পাই। ’
একসময় শনিবারের চিঠি সৌজন্যের, ভব্যতার সব মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথ তখন শনিবারের চিঠি পড়া বন্ধ করেছিলেন। সেই ‘শনিবারের চিঠি’ও রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর লিখেছিল, ‘সেই প্রতিভারও পরে যশ- যে যশের শঙ্খধ্বনি সমুদ্রস্তনিত পৃথিবীর কূলে কূলে প্রতিধ্বনিত হইয়াছে। সেই যশের পরে দীর্ঘ আয়ু- যে আয়ু সেই যশকেও ক্রমাগত বর্ধিত করিয়াছে। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বিধাতার বরপুত্র, জীবনকে এমন করিয়া পূর্ণ রাজশ্রী-মণ্ডিত করিবার সৌভাগ্য অতি অল্প মানুষেরই হইয়া থাকে। এমন আভিজাত্যবান, কান্তিমান, আয়ুষ্মান, প্রজ্ঞাবান ও খ্যাতিমান পুরুষ আমাদেরই দেশে, আমাদের জাতিতেই জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, সেই দিব্য প্রতিভার আলোক আমাদের মুখমণ্ডল উদ্ভাসিত করিয়াছিল- এ গৌরব রাখিবার স্থান নাই। এতদিন রবীন্দ্রনাথ আমাদের সাক্ষাৎজ্ঞানের বস্তু ছিলেন, আজ হইতে তিনি আমাদের ধ্যানের বস্তু হইলেন। ’ (রবীন্দ্রনাথ ও শনিবারের চিঠি, গৌতম ভট্টাচার্য, পৃষ্ঠা ২০৯)।
সজনীকান্তরা ধ্যানে মগ্ন হলেও রবীন্দ্রনাথ তারপরও রেহাই পাননি। রবীন্দ্র সংগীতের ‘শুদ্ধতা’ রক্ষার নামে বিশ্বভারতী একসময় বাড়াবাড়ি করেছে ঠিকই। সেই বাড়াবাড়ির সবচেয়ে বড় শিকার দেবব্রত বিশ্বাস। কিন্তু বিশ্বভারতীর ‘খবরদারি-পর্ব’ শেষে শুরু হয় ‘শিল্পীর স্বাধীনতা’র নামে এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা। এক্সপেরিমেন্ট, ইম্প্রোভাইজেশন বা ফিউশনের নামে কত কী যে হয়েছে, অল্প কথায় বলে শেষ করা অসম্ভব।
সেসব তথাকথিত এক্সপেরিমেন্ট, ইম্প্রোভাইজেশন কিংবা ফিউশনে রবীন্দ্রসঙ্গীতের কথাকে (লিরিক) তবু রেহাই দেয়া হয়েছে। ছোটখাটো প্রশ্ন উঠেছিল শুধু সুর নিয়ে। প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে আজকাল তো যে কেউ সংগীতশিল্পী হয়ে যেতে পারেন, অ্যালবাম, মিউজিক ভিডিও ইত্যাদি বের করে হঠাৎ নামও কামিয়ে ফেলতে পারেন ।
বাংলা গানে এমন কিছু গায়ক, গায়িকার আবির্ভাব দেখে এক দশক আগে কবীর সুমন লিখেছেন, ‘সংগীতের এক প্রৌঢ় ছাত্র ও অনুরাগী হিসেবে আমার বিনীত প্রশ্ন এই যুগের কাছে, বাংলা গান কী এমন দোষ করল যে সংগীতের, গানের, গান গাওয়ার কোন তালিম ও পাঠ না নিয়ে, কিচ্ছু না শিখে, আমাদের সংগীতের বিবর্তন সম্পর্কে, আমাদের দেশের নানা আঙ্গিকের গানবাজনা সম্পর্কে কোনো ধারণা না রেখে, কণ্ঠচর্চা না করে, অতীত ও বর্তমানের গান-বাজনা যথেষ্ট মাত্রায় না শুনে এবং আত্মস্থ না করে, গান লেখা ও সুর করার দীর্ঘ অনুশীলন না করে স্রেফ অনুপ্রাণিত মন-মেজাজ নিয়ে বাংলা গান বানাতে, গাইতে ও বাজাতেই হবে এবং এই আশা ও দাবি করতেই হবে যে আমার গান-বাজনা শোনো?’
গত এক দশকে গানের দুর্দিন আরও বেড়েছে। গান একেবারেই না জেনে, প্রায় সুরহীন হয়েও ব্যক্তিস্বাধীনতার কথা বলে রবীন্দ্র সংগীতে ‘অশ্লীল শব্দ’ ঢুকিয়ে স্রেফ চেঁচামেচি করেও ভিউদস্যু রোদ্দুর রায় তাই বারবার খবরে আসতে পারেন। রোদ্দুর রায়কে থামাতে অবশেষে মামলা হয়েছে। কিন্তু মামলায় কাজ হবে বলে মনে হয় না।
এ ধরনের ‘বস্তুকে’ আসলে চোখ, নাক এবং কান থেকে অনেক দূরে রাখতে হয়। কিছু মানুষ, কিছু লোভী সংবাদকর্মী তা পারে না বলে শিল্পী এবং শ্রোতাদের অসহায়ত্ব বৃদ্ধির পাশাপাশি ভিউদস্যুদলের দৌরাত্ম্যও ক্রমশ বাড়ছে।
লেখক: আশীষ চক্রবর্ত্তী, সাংবাদিক, ডয়েচে ভেলে, জার্মানি
বাংলাদেশ সময়: ০০০০ ঘণ্টা, মার্চ ১২, ২০২০
এইচজে