আদিম কৃষিভিত্তিক বাঙালি সমাজে যা ছিলো তা হলো- দাসত্ব, পরশ্রীকাতরতা, কুসংস্কারচ্ছন্নতা। প্রভুত্ব মেনে চলাই ছিলো তাদের জীবনের একমাত্র ধ্যান জ্ঞান।
ব্যবহার করেছে।
কেউ ব্যবসায়ের নামে, কেউ ধর্ম প্রচারের নামে, কেউ বাঙালিদের সভ্য করার অছিলায়, কেউ বা করে গেছে দ্বিজাতি তত্ত্বের ধুয়া তুলে। আদতে এরা কেউ বাঙালিদের কথা ভাবে নাই। তারা ভেবেছে তাদের ব্যক্তিস্বার্থ বা গোষ্ঠী স্বার্থের কথা। তাদের স্বার্থান্ধ তলোয়ারের নিচে বলি হতে হয়েছে অবোধ বাঙালি জাতিকে। একবার নয়, বরং বারংবার। সেই জায়গা হতে বিচার করলে বাঙালির ইতিহাস বেশি দূরের নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মের প্রাক্কাল থেকে বাঙালির ইতিহাস দানা বাঁধতে শুরু করেছে। রবীন্দ্রনাথ যদি না জন্মাতেন তবে বাঙালির অস্তিত্ব তরুলতার মত তরতর করে এভাবে দাঁড়াতে পারত কিনা সে প্রশ্ন থেকে যেত! ফলে একটা সময় বাংলা-বিদ্বেষী পাকিস্তানিরা রবীন্দ্রনাথকে মুছে ফেলতে উদ্যত হয়। নিষিদ্ধ করা হয় তাকে বাংলায়। সালটি ছিলো ১৯৬১।
অথচ এই একটি মানুষ যে নিজে বাঙালির রাজ্যপাটে বীজ সৃষ্টি করে তার থেকে বিরাট মহীরুহ দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেছেন একা। সৃষ্টি করে গেছেন বাঙালির স্বকীয়তা, শক্তিশালী সৃষ্টিশীলতা ও সংস্কৃতির ভিত।
বাঙালি নারীদের শাড়ির সাথে খোপায় গোঁজা ফুল। কপালে লাল টিপ। বাঙালি নারী ও পুরুষের স্বতন্ত্রতা। বাংলা সাহিত্যকে তুলে নিয়ে বসিয়ে দিয়েছেন এক অনন্য উচ্চতায়। বলতে গেলে শেষ হবার নয় তার কৃতিত্ব। ফলে এত অপচেষ্টা সত্ত্বেও সেই মুছে-ফেলা রবীন্দ্রনাথ আজ বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হয়ে উঠেছেন। তার আগে বাঙালির দীপ্র পায়ের ছাপ স্পষ্টাকারে কোথাও পাওয়া যায়নি এমনভাবে। তারপর এলেন কাজী নজরুল ইসলাম, ক্ষুদিরাম বসু, মাস্টার দ্য সূর্যসেন, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুসহ আরো অনেকে। পানি পথের যুদ্ধ, পলাশীর যুদ্ধ এবং সিপাহীযুদ্ধে সারা দেশ যখন আলোড়িত, তখনও কোন বাঙালিকে প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে রাজপথে দেখা যায়নি। কিন্তু প্রতি ক্ষণে তাদের দেখা গেছে মাঠে, গামছা কোমড়ে বেঁধে চাষ করতে কিংবা বাড়ির আঙিনায় খুঁটির সাথে হেলান দিয়ে অলস দুপুর কাটাতে। নয়তো দেখা যেত জমিদার কিংবা রাজাদের পায়ের কাছে বসে থাকতে। ধর্ম ছিলো তাদের একমাত্র চালিকা শক্তি।
সেই অবস্থা থেকে বাঙালিদের সরিয়ে আনতে সময় লেগেছে অনেকগুলো বছর। বাঙালিরা মূলত স্বরাজি আন্দোলনের মাধ্যমে নিজেদেরকে ইতিহাসের পাতায় সক্রিয়ভাবে সংযুক্ত করতে থাকে। যার অন্যতম বঙ্গভঙ্গ রদ। তারপর অনেকগুলো বছরের দ্রোহ চড়াই উতরাই পেরিয়ে এল দেশভাগ। অতঃপর নব্য সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানের আগ্রাসন থেকে নিজেদের সংগীত, ললিত কলা, ক্রীড়া, মানবিকতা, শান্তি ও সৌন্দর্যমণ্ডিত আচার- আচরণ, বিশ্বাস, রীতিনীতি, চিরাচরিত প্রথা, কৃষ্টি কালচার এবং জীবনভ্যাস বাঁচানোর এক প্রান্তান্তর প্রচেষ্টা বাঙালির। যার হাতে খড়ি হয় বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার গণআন্দোলনের মধ্যে দিয়ে। বলা বাহুল্য, গণ-আন্দোলনের অন্যতম উদ্যোক্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
এই প্রগতিশীল ভাষা আন্দোলনই পরবর্তিতে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি ও গোড়াপত্তন করে। এই আন্দোলন বাঙালির এক তপস্যালব্ধ ইতিহাস। এই একটা মাত্র ইতিহাস দিয়ে বাংলাদেশ বীজ থেকে প্রস্ফুটিত সদ্য চারা গাছের মত পৃথিবীর বুকে মাথা তুলে বলেছে- বাঙালি বাঁচবে, বাঙালি ইতিহাসের জাল বোনা শুরু করছে। বঙ্কিম বাবু তুমি শোন, বাঙালি বাঁচবে এবং শিরদাঁড়া সোজা করে বাঁচবে।
বাঁচার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে দৃঢ়চিত্তের দূরদর্শী বাঙালি নেতা শেখ মুজিব প্রথমে ১৯৪৮-এর ৪ জানুয়ারি প্রথমে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। ঐ বছর ফেব্রুয়ারিতে গণপরিষদের এক সভায় শায়েস্তা, সোহরাওয়ার্দী, ইকরামউল্লাহ বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের চালচলন ভালো না। তারা আমাদের পূর্ব পাকিস্তানকে উপনিবেশ হিসেবে দেখবে।
বাস্তবিক অর্থেও তাই। আক্রমণমুখী পশ্চিমারা বাঙালিদের তাদের গোলাম ছাড়া আর কিছুই মনে করত না। পশ্চিমারা পূর্ব বাংলার মানুষের রক্ত চুষে খেয়ে সামাজিক অর্থনৈতিক শিল্প সাহিত্যের অট্টালিকা গড়তে লাগল পাকিস্তানে। ফলশ্রুতিতে ’৪৯-এর ২৩ জুন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেন বঙ্গবন্ধু। তখন অবশ্য আওয়ামী মুসলিম লীগ ছিলো। ১৯৫৫ সালে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। কেননা বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন, অসাম্প্রদায়িকতা বাঙালির ন্যায় ও মুক্তির একটি অগ্নিশলাকা যা বাঙালি সংস্কৃতির স্বার্থেই প্রজ্জ্বলিত করতে হবে।
আর তাই ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে সমগ্র জাতিকে তিনি জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে একসূত্রে গ্রথিত করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য ছিলেন। কিন্তু কোনোদিন ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নাম উচ্চারণ করতে তাকে দেখা যায়নি। সব সময় জোর গলায় বলেছেন ‘পূর্ববাংলা’। তাছাড়া বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধু আড়ালে ১৯৬২ সালে তার অনুগত ছাত্রদের নিয়ে একটি গোপন সংগঠন গঠন করেছিলেন। নাম নিউক্লিয়াস। নিউক্লিয়াসের প্রচেষ্টায় ১৯৬৪ সালে সর্বপ্রথম বাংলাদেশ স্বাধীন করার কথা প্রচারে আসে। আসে হৃদয়স্পর্শী স্লোগান- ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। ‘তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি’। ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’। এ সময় গাড়ির নাম্বার প্লেট ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও দোকান পাঠের নাম ফলক ইংরেজির পরিবর্তে বাংলায় লেখার আন্দোলন সংগঠিত হয়।
১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, আমি যদি কখনো পাকিস্তান শাসনতন্ত্র প্রণয়নের সুযোগ পাই তবে এই প্রদেশের নামকরণ করবো বাংলাদেশ। এদেশের বুক হতে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হতে বাংলা কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকু চিরতরে মুছে ফেলার গভীর ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। একমাত্র বঙ্গোপসাগর ছাড়া আর কোনো কিছুর নামের সাথে বাংলা কথাটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় নাই। তাই জনগণের পক্ষ হতে আমি ঘোষণা করতেছি, আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম হবে, পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধু ‘বাংলাদেশ’। সাথে সাথে সমবেত জনতা উল্লাসিত কণ্ঠে রণধ্বনি তুলে বলে উঠল- বাংলাদেশ। হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমাদের বাঙালির বাংলাদেশ। এ নিয়ে গৌরি প্রসন্ন মজুমদার পরবর্তীতে গান লিখেছেন, ‘শোন একটি মুজিবের থেকে লক্ষ মুজিবের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে ওঠে রণী, বাংলাদেশ। আমার বাংলাদেশ। ’ বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, আটান্নর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা-আন্দোলন, ছিষট্টির ছয়-দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ- প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে গণতন্ত্রের অতন্দ্র সৈনিক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ছিলো এক কিংবদন্তিতুল্য ইতিহাস।
যে বাঙালিরা বঞ্চনা শাসন দাসত্বের শিকলে নিজেকে বন্দী করে রেখেছে হাজার হাজার বছর। মননশীলতার গভীরতম প্রদেশে ধর্মান্ধতা, সংকীর্ণতা, আতঙ্ক যেন বেঁচে থাকার আধার হয়ে উঠেছিল। অপর দিকে মুক্তচিন্তা প্রতিবাদ প্রতিরোধ যেন অস্তিত্ব সংকটের ভয়। বঙ্গবন্ধুর এক কথায় সব ভয় সংকীর্ণতা তাড়িয়ে তারা আবদ্ধ শিকল থেকে মুক্ত হয়ে লিখেছেন মুক্তির কবিতা, মুক্তির ছড়া, মুক্তির গান। ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি, মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি। ’ আতঙ্কগ্রস্থ বাঙালিকে উজ্জীবিত করতে বিদ্রোহী কণ্ঠে গেয়েছেন, ‘কারার ঐ লৌহকপাট, ভেঙে ফেল, কর রে লোপাট, রক্ত-জমাট, শিকল পূজার পাষাণ-বেদী’।
তাতে অত্যন্ত উদ্বেলিত হয়েছিল সমগ্র বাংলাদেশ। টগবগ করে ফুটে উঠেছিল বহু বছরের জমে থাকা অব্যক্ত ক্ষোভ প্রতিবাদ প্রতিশোধের অনল রক্ত শতদল। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিসংগ্রাম যার কোলে পিঠে করে বড় হয়ে বাংলার কৃষক, শ্রমিক, নারী, পুরুষ, ছাত্র, যুবক, লেখক, শিল্পী, সাংবাদিক, ডাক্তার এবং সর্বস্তরের মানুষকে দিয়েছে গৌরবান্বিত ইতিহাস রচনা করার স্পৃহা, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বাঙালিকে স্বাধীনতার পথে হেঁটে যাওয়ার জন্য তৈরি করে দিয়েছিল সেতু- ছয় দফা। জনগণনন্দিত বঙ্গবন্ধু সেদিন তেজোদীপ্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, সাঁকো দিলাম, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার পথে উন্নীত হওয়ার জন্য। ফরাসি বিপ্লবের ভিত্তি যেমন সাম্য, স্বাধীনতা, ভ্রাতৃত্ব।
ব্রিটিশ গণতন্ত্রের ইতিহাস যেমন ম্যাগনাকার্টা। আর বাঙালি জাতির ভিত্তি হচ্ছে ৬ দফা আর ইতিহাস- মুক্তিসংগ্রাম। অথচ তৎকালীন তথাকথিত একশ্রেণীর রাজনীতিকরা বললেন, এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা। সাথে সাথে ফ্যাসিবাদি পাকিস্তান সরকার দমনপীড়ন শুরু করল এই বলে যে, এতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সর্বনাশ, পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভাঙন।
কিন্তু বঙ্গবন্ধু দমে যাননি। পর্বতপ্রমাণ প্রতিকূলতায় পিছু হটেননি। ছয় দফা উত্থাপনের পরে সারা দেশ সফর করে মাত্র ৩৫ দিনে মোট ৩৩টি জনসভায় তিনি অত্যন্ত সন্তর্পণে আপামর জনতাকে একটি সুতোয় গাঁথতে করেছেন। এজন্য পদে পদে প্রেফতার হতে হয়েছে তাকে।
তথাপি দিব্যদৃষ্টি দিয়ে কারাগারের অন্ধকার প্রকাষ্ঠে বসে স্বাধীনতার বীজ তথা স্বপ্ন বপন করে গেছেন সাধারণ মানুষের মুক্তির অবতারতুল্য এই মানুষটি।
অবশেষে উঠল নতুন সূর্য, এলো বহুপ্রতিক্ষীত বাংলাদেশের স্বাধীনতা। বাঙালি সমাজ-ব্যবস্থায় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, সুভাষ বসু, এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রমুখের অবদান অবিস্মরণীয় বটে। কিন্তু তারা কেউ বাঙালির পাতে স্বাধীনতার স্বাদ দিতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু দিয়েছেন মুক্তির স্বাদ, স্বাধীনতার স্বাদ, মাথা উঁচু করে চলার সৎ সাহস। বঙ্গবন্ধু মানে একটি নতুন দেশের জন্ম, নতুন করে পথ চলা। একটি রাষ্ট্রের জন্ম তথা তার সৃষ্টির পেছনে রয়েছে একটি ইতিহাস। সেই ইতিহাসের পটভূমি আছে, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আছে, প্রবহমান ঘটনা আছে, ঘটনার পৃষ্ঠায় আছে মিছিল মিটিং, সংগ্রাম আন্দোলন, এক সমুদ্র তাজা রক্ত। তাতে স্পষ্টাকারে মুদ্রিত রয়েছে সেই ধ্রুব সত্যটি, বাংলাদেশ নামক এই মহাকাব্যের রচিয়তা রাজনৈতিক কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
উদারনৈতিক বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার আগে এবং পরে একটি কথাই বারবার উচ্চারণ করেছেন, পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা চলবে না। সাম্প্রদায়িকতা যেন মাথাচাঁড়া দিয়ে উঠতে না পারে। ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাংলাদেশ। মুসলমান তার ধর্মকর্ম করবে, হিন্দু তার ধর্মকর্ম করবে, বৌদ্ধ তার ধর্মকর্ম করবে। কেউ কাউকে বাধা দিতে পারবে না। কিন্তু পঁচাত্তরের পরে বাংলাদেশ সেখান থেকে অনেক দূর সরে গেছে।
ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে নানা ব্যাখ্যা দেওয়া যায় কিন্তু বিকৃত করা যায় না। ইতিহাস বিকৃত করা পাপ। দণ্ডনীয় অপরাধ। ইতিহাস চিৎকার করে বলে যে, বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে ৭১ এর জন্ম হয়েছে প্রাদেশিক নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। ১৯৪৮ থেকে ৭১- দীর্ঘ এই ২৪ বছরের বঞ্চনামূলক শাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে। অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বর। লেখা হয় স্বাধীন বাংলাদেশ নামক এক নতুন অধ্যায়। কবিগুরু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ভারতবর্ষের ইতিহাস প্রবন্ধে লিখেছেন, “সেই জাতিই ভাগ্যবান, যার নতুন প্রজন্ম সঠিক ইতিহাস থেকে অনুপ্রেরণার রসদ খুঁজে পায়।
বঙ্গবন্ধু তার বিরল নেতৃত্বগুণ, শৈল্পিক রাজনৈতিক জ্ঞান, সম্মোহনী শক্তি, অসাধারণ বাগ্মিতা, অন্যায়ের কাছে আপসহীন-মনোভাব, ভাব- প্রকাশের নিজস্ব ধরণ-ভঙ্গী অনাগত নতুন বাঙালি প্রজন্মের জন্য বাঙালির দ্বারাই সেই ইতিহাস তৈরি করে দিয়ে গেছেন। আর তাই কবি-মনীষী সু-সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছিলেন- ‘যতদিন রবে পদ্মা-যমুনা গৌরী-মেঘনা বহমান/ ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান। ’ শুধু তাই নয়, অন্নদাশঙ্কর রায় বাংলাদেশের ডাক নাম
রেখেছেন ‘মুজিব ল্যান্ড’।
কিন্তু বাংলাদেশ কি পেরেছে দলমত নির্বিশেষে বঙ্গবন্ধুর কীর্তি বহন করতে? পৃথিবী একটা মস্তবড় বই। রাষ্ট্রগুলো এক একটি অধ্যায়। বাংলাদেশ নামক অধ্যায়ের পাতায় একটি প্রশ্ন বারবার ঘুরে ফিরে আসে, স্বাধীনতার মহান স্থপতি ও বাংলাদেশ অধ্যায়ের লেখক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোন দল বা গোষ্ঠীর অর্ন্তভুক্ত হওয়া উচিত কিনা? যার উত্তর অনেকের জানা থাকলেও দলকেন্দ্রিক বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বার্থপরতার কারণে উত্তরটি অন্ধকার ঘর থেকে আলোর মুখ আজও দেখেনি। কোন দল বা গোষ্ঠী যদি বঙ্গবন্ধুকে ‘জাতির জনক’ হিসাবে অস্বীকৃতি জানায় বা জানাতে চায় তাহলে ইতিহাসকে অস্বীকার করা হয়। পরোক্ষভাবে অস্বীকার করা হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধু এবং স্বাধীনতা একে অপরের পরিপূরক। একটির অবর্তমানে অপরটি অচল।
অত্যন্ত অনুতাপের বিষয়- বাংলাদেশের বর্তমান সরকার প্রধান আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক চেতনায় বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী হলেও দলটি বঙ্গবন্ধুকে বুকে ধারণ বা লালন কোনটাই করতে পারেনি। কেননা তারা যদি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে চর্চা করত তাদের মননশীলতায় তবে বঙ্গবন্ধুকে দলীয়করণ রুখতে আবশ্যিকভাবে সহনশীল কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করত, যাতে অন্যান্য রাজনৈতিক দল জাতির পিতাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি আওয়ামী লীগ তা না করে, বরং বঙ্গবন্ধুকে মোড়াকজাত পণ্য করে বিক্রি করে খাচ্ছে সকাল বিকাল। এখানে যদি কেউ দ্বিমত পোষণ করে থাকে, বুঝতে হবে সে বোকার স্বর্গে বাস করছে নয়তো সে একজন চাটুকার তথা আওয়ামী লীগের শত্রু। বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বেচে পদ পদবী হাতিয়ে নেওয়ার ধান্দায় সে মশগুল। তেলবাজ ছা পোষা নেতা কর্মী দিয়ে ভরপুর এখন বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া আওয়ামী লীগ।
তাদের পা থেকে মাথা পর্যন্ত তেলে চপচপে। তারা প্রতিনিয়ত তৈলাক্ত কথায় বঙ্গবন্ধুকে বিক্রি করছে, ক্রয় করছে। একটি বিষয় মনে রাখা অনিবার্য যে, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু কোন সংগঠন বা রাজনৈতিক দলের মধ্যে আর সীমাবন্ধ নেই। সে প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে তুমুল বাজে।
তার নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন না হলে এদেশে ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দল ভিন্ন ভিন্ন এজেন্ডা নিয়ে রাজনীতি করতে পারত না। দলীয়করণ বিষয়টি হলো মৌসুমী ঋতুর মত। এক ঋতুতে যে বৈচিত্রগুলো থাকে, অন্য ঋতুতে সেগুলো থাকে না অর্থাৎ অস্থায়ী। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কোন ঋতু নয়, বিস্তর নীল নির্মেঘ আকাশ, দুস্তর মহাসমুদ্র। বঙ্গবন্ধুকে তা হতে দেয়নি বৃহৎ স্বার্থন্বেষী রাজনৈতিক মহল অথচ বঙ্গবন্ধুর স্থায়ী আকাশ হওয়ার কথা ছিলো। দলীয়করণের ফলে শুধু আওয়ামী লীগ জাতির পিতার স্মরণে বিভিন্ন ধরণের সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক অনুষ্ঠানসহ দিনব্যাপী কর্মসূচি পালন করে থাকে। সেখানে বিএনপিসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দল বিভিন্ন অনুষ্ঠান তো দূরের কথা জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানাতে কার্পণ্য বোধ করেন যা জাতির জন্য লজ্জার। আওয়ামী লীগের দলীয়করণের ফলেই যে এমনটি হয়েছে আসলে তা পুরোপুরি সঠিক নয়। বস্তুত পঁচাত্তরের পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রের ক্ষমতায় থাকা কোন রাজনৈতিক দলই বঙ্গবন্ধুকে যথাযথ সম্মান দেয়নি। এড়িয়ে চলেছে। নিষিদ্ধ করতে চেয়েছে। যেমন নিষিদ্ধ করতে চেয়েছিলো রবীন্দ্রনাথকে। তারই ধারাবাহিকতা এখনো চলছে।
স্বাধীনতার ঊনপঞ্চাশ বছরেও বঙ্গবন্ধুকে এক ঘরে করে রাখা হয়েছে। যে মানুষটির উদাত্ত আহ্বানে দেশ স্বাধীন হলো, সে দেশে সেই মানুষটিই উপেক্ষিত। ১৯৯৬ এর নির্বাচনে যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে তখন ১৫ই আগস্টকে জাতীয় শোক দিবস এবং সরকারি ছুটি হিসাবে ঘোষণা করেন সরকার। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়েত সরকার ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতীয় শোক দিবস পালন বাতিল করে দেয়। যেটি দুঃখজনক, অপ্রত্যাাশিত যা রাজনৈতিক আদর্শ এবং বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে অসামঞ্জস্য। বিষয়টা হলো এমন, পিতার বসতবাড়িতে বাস করে পিতাকেই নির্বাসনে পাঠিয়ে দেওয়া।
জাতি বলতে আলাদা আলাদা দল বা গোষ্ঠ নয়। জাতি বলতে বোঝায় বাংলা ভাষাভাষি সকল ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম,বর্ণ, গোত্র, গোষ্ঠী এবং মতাদর্শেও মানুষজন নিয়ে গঠিত একটি সম্প্রদায়, যারা জাতি হিসাবে বাঙালি এবং নাগরিক হিসাবে বাংলাদেশি। জাতির পিতা একজনই। এই সত্যকে অমান্য করা আর নিজের অস্তিত্বকে অমান্য করা একই কথা। জাতির জনককে দলীয়করণ করা মানে দ্বিতীয়বার তাকে হত্যা করা। অল্পের স্বার্থই সবসময় বৃহত্তর স্বার্থকে জায়গা করে দেয়। প্রবাহমান বাংলায় জাতির জনক, তার আদর্শ, অগ্ন্যৎপাত স্বাধীনতা ও উদ্দীপিত ইতিহাস বাঁচিয়ে রাখতে হলে অবশ্যই বঙ্গবন্ধুকে দলীয়করণ থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তবেই বাঙালির নতুন প্রজন্ম সঠিক ইতিহাস থেকে আলোড়িত হতে পারবে। তার জন্য প্রয়োজন দুই বৃহৎ রাজনৈতিক দলসহ সকলের সদিচ্ছা এবং সুবুদ্ধির বিকাশ।
দলগত চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা, মতামত এবং রাজনৈতিক আদর্শ ভিন্ন হতে পারে কিন্তু জাতির পিতা এক ও অভিন্ন। যার প্রতিফলন ঘটেছে বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে। কট্টরপন্থী বিজেপি কংগ্রেসের দারুণ প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও জাতির পিতার প্রশ্নে তারা এক ও অদ্বিতীয়।
এই মুজিববর্ষে দেশ ও জাতির কল্যাণ তথা বাঙালির স্বোপার্জিত ইতিহাসের স্বার্থে ছোট ছোট স্বার্থ এবং দলগত অহমিকাগুলো কি পদ্মা, মেঘনা, যমুনায় ভাসিয়ে দেওয়া যায় না?
অরিত্র দাস
লেখক, প্রবন্ধলেখক, কলামিস্ট এবং স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশ সময়: ১২৫৭ ঘণ্টা, মার্চ ১৭, ২০২০
এজে