ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কী ফান করলেন!

সাইফ বরকতুল্লাহ, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০২৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০১১
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কী ফান করলেন!

ঘটনা ১
হঠাৎই আইনশৃঙ্খলার অবনতি: স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বললেন, শীতে অপরাধ বাড়ে। এটি বাংলাদেশ প্রতিদিনের ২৯ ডিসেম্বরের প্রধান খবর।

রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির হঠাৎ অবনতি ঘটেছে। লাগামহীন হয়ে পড়েছে দুর্বৃত্তরা। সিরিজ ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। প্রকাশ্য দিবালোকে মানুষের সামনে ব্যবসায়ীকে হত্যা করে লুটে নিচ্ছে টাকার ব্যাগ। পাশাপাশি চলছে নীরব চাঁদাবাজি। গুপ্তহত্যা ও অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার হচ্ছে যত্রতত্র। এ অবস্থায় নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ছে মানুষ। উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ী সমাজ।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, পুলিশের দুর্বল টহল ব্যবস্থা ও তল্লাশিতে গাফিলতির কারণে জামিনে মুক্তি পাওয়া দাগী অপরাধী ও ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বেড়ে গেছে। এছাড়া পুলিশের ভেতর বদলি আতঙ্ক এবং পুলিশ প্রশাসনে তদারকির অভাব আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আরেকটি কারণ বলেও মনে করছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।

তবে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেন, ‘এমনিতেই শীতের সময় অপরাধ বাড়ে। এবার অপরাধীরা সেই সুযোগ ভালোভাবেই পেয়েছে বিরোধী দলের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের কারণে। ’
[সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন- ২৯.১১.২০১১]

যেহেতু রিপোর্টটি ২৯ তারিখ প্রকাশিত, সেহেতু রিপোর্টটি তৈরি হয়েছে ২৮ ডিসেম্বর।

ঘটনা ২
এর একদিন পরের ঘটনা। ২৯ ডিসেম্বর ২০১১। সকাল সোয়া এগারটায় মেরুল-বাড্ডা এলাকায় বৃহস্পতিবার বোমা হামলায় পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমানের ভাগ্নে মামুনুর রহমান মামুন (৩৫) নিহত হয়েছেন। তিনি বাড্ডা থানা সেব্চ্ছাসেবকলীগ নেতা ছিলেন। [সূত্র: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম, ২৯.১১.২০১১]।

ঘটনা ৩
দিনাজপুরে ওয়ারেন্ট ছাড়াই আসামি ধরতে গিয়ে গণপিটুনির শিকার হয়েছেন ১০ পুলিশ সদস্য। এতে চারজন আহত হয়েছেন। বুধবার রাত আড়াইটার দিকে দিনাজপুর কোতোয়ালি থানার এসআই জাহাঙ্গীর ও এএসআই মোস্তাফিজুরসহ ১০ জন পুলিশ সদস্য সদর উপজেলার সুন্দরবন ইউনিয়নের উত্তর শিবপুর গ্রামে আসামি ধরতে যায়। তারা ওই গ্রামের মইবর রহমানের ছেলে মহবুলকে (৪০) আটক করলে এলাকাবাসী বাধা দেয় ও ওয়ারেন্ট দেখতে চায়। এতে এলাকাবাসীর সাথে পুলিশের বাক-বিতণ্ডা হয়। এক পর্যায়ে এলাকাবাসী পুলিশ সদস্যদের গণপিটুনি দেয়। এতে চার পুলিশ সদস্য আহত হয়। পরে দুই পিকআপ পুলিশ গিয়ে ১০ পুলিশ সদস্যকে উদ্ধার করে। [সূত্র: ২৯ ডিসেম্বর, আরটিএনএন ডটনেট] ।

ঘটনা ৪
১৫ ডিসেম্বর সকল জাতীয় পত্রিকার শিরোনাম ছিলো— ‘গুপ্ত হত্যায় আতংকিত দেশ’। ৭২ ঘণ্টায় ১২ জনের লাশ। ১৩ ডিসেম্বর ৩ জনের মুন্সীগঞ্জের ধলেশ্বরী নদীতে, ১৪ ডিসেম্বর ৫টি লাশের খবর আর ১৫ ডিসেম্বর ৪টি। গত ৬ মাসে ৬২৫ জন স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক গুপ্ত হত্যার শিকার হয়েছে। সবাই সাদা পোশাকধারী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণের পর লাশ পাওয়া যায় বিভিন্ন জায়গায়। দেশের মানুষ এতই আতঙ্কিত যে, প্রথম আলোর ১৫ ডিসেম্বরের সংখ্যায় গুপ্ত হত্যা নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয় উক্ত রিপোর্টে ৭০ জন মন্তব্যকারীর মধ্যে আনেকে নাম প্রকাশ করেননি – মন্তব্য সরকারের বিরুদ্ধে গেলে গুপ্ত হত্যার শিকার হতে হবে এ ভয়ে, যারা নাম প্রকাশ করেছে তারাও নিজেদের আতঙ্কের কথা প্রকাশ করেছে, না জানি পরিচয় মিললে কি ঘটে ভাগ্যে।

কয়েকটি পরিসংখ্যান
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী ২০০৯, ২০১০ ও চলতি বছরের (২০১১) নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় তিন বছরে (৩৫ মাসে) ৩৫৯ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে নিহত হন। এর মধ্যে রয়েছেন ২০০৯ সালে ১৫৪ জন, ২০১০ সালে ১২৭ জন ও ২০১১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে ৭৮ জন। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর তিন বছরে দেশে ১২ হাজারেরও বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। সে অনুযায়ী প্রতিদিন প্রায় ১১ জন করে খুন হয়েছেন। রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ৫৯২ জন এবং আহত হয়েছেন ৪০ হাজার ১৯০ জন। চলতি বছর ইউপি নির্বাচনী সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ৮৩ জন। তবে পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ১০ হাজার ৬০০ উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০০৯ সালে ৪২১৯ জন ও ২০১০ সালে ৪৩১৫ জন। খুনসহ ডাকাতি, দুর্ধর্ষ চুরি, অপহরণ, নারী নির্যাতন, শিশু নির্যাতন, মাদক কেনাবেচাসহ ৫ লাখেরও বেশি অপরাধের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২০০৯ সালে ১ লাখ ৫৭ হাজার ১০৮টি, ২০১০ সালে ২ লাখ ৪৩ হাজার ৫৩৪টি ও চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে ১ লাখ ৩৭ হাজার অপরাধের ঘটনা ঘটে। গত তিন বছরে শুধু রাজধানী ঢাকায় ৫ হাজার ৫৭৬টি বেওয়ারিশ লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা অধিকার-এর তথ্য অনুযায়ী, সরকারের ২ বছর ১১ মাসে ৪ সাংবাদিক নিহত, ২৮০ সাংবাদিক আহত, ৮৮ জন লাঞ্ছিত ও ৯৫ জন হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন। [সূত্র, ২৬ ডিসেম্বর ২০১১, দৈনিক আমার দেশ]

স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর কথা: উদ্বিগ্ন মানুষ
ক্রসফায়ার, গুপ্তহত্যা, নৃশংস খুন ও গুমসহ সহিংস ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি চরম উদ্বেগজনক। তবে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেন, ‘এমনিতেই শীতের সময় অপরাধ বাড়ে। এবার অপরাধীরা সেই সুযোগ ভালোভাবেই পেয়েছে বিরোধী দলের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের কারণে। ’ এর আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন বলেছিলেন, গুপ্তহত্যা সম্পর্কে তার কিছু জানা নেই। পত্রিকা পড়ে তিনি জানতে পেরেছেন। এ ব্যাপারে সবেমাত্র তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

যেখানে নিত্যদিন ঘটছে হত্যার ঘটনা, সেখানে সরকারের কর্তা ব্যক্তিদের এমন কথাবার্তায় হতাশ সাধারণ মানুষ। অন্তত এ অবস্থায় ফান নয়, দায়িত্বশীল কথাবার্তা আশা করে প্রত্যেক নাগরিক।

লেখক সাংবাদিক ও গবেষক

বাংলাদেশ সময়: ১০১৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।