ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

মহামারিতেও নারীর মুক্তি নেই!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০০২ ঘণ্টা, মে ৭, ২০২০
মহামারিতেও নারীর মুক্তি নেই!

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, সারাবিশ্বে স্বাস্থ্যসম্পর্কিত কাজে নিয়োজিত লোকবলের মধ্যে ৭০ শতাংশই নারী। চীনের স্বাস্থ্যকর্মীদের ৯০ শতাংশই ছিলেন নারী। কিন্তু দুঃখের বিষয়, নারী যেমন একদিকে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সেবায় নিজেদের বিলিয়ে দিচ্ছে, অপরদিকে উদ্বেগজনকভাবে নিজেরা শিকার হচ্ছে ‘নির্যাতন’ নামক ভাইরাসের। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের আগে পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছিল, বিশ্বের প্রায় এক তৃতীয়াংশ নারী কোনো না কোনো সময় নির্যাতনের মুখোমুখি হয়েছেন। কিন্তু এই সংখ্যা লকডাউনের সময় বেড়েছে। জাতিসংঘের তথ্যমতে, করোনার সময় নারী নির্যাতন উন্নত ও দরিদ্র অর্থনীতির দেশ উভয়কেই প্রভাবিত করে। 

রয়টার্সের তথ্যমতে, লকডাউনের প্রথম সপ্তাহেই ভারতে নারী নির্যাতন প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে, তুরস্কে সবাইকে ঘরে থাকার নির্দেশনা দেওয়ার পর থেকে নারী-হত্যার হার বেড়েছে, দক্ষিণ আফ্রিকায় লকডাউনের প্রথম সপ্তাহে অন্তত ৯০ হাজার লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার অভিযোগ এসেছে। অস্ট্রেলীয় সরকারের কাছে অনলাইনে সাহায্য প্রার্থনার হার বেড়েছে ৭৫ শতাংশ।

এক সপ্তাহে ফ্রান্সে ঘরোয়া নির্যাতন বেড়েছে প্রায় ৩২ শতাংশ। অপরদিকে, যুক্তরাজ্যে সরকারি হটলাইনে নির্যাতনের শিকার নারীদের ফোন ৬৫ ভাগ বেড়েছে (দৈনিক প্রথম আলো, ৩১ শে মার্চ)।  

আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলিনার গবেষক পিটারম্যান ও তার সহলেখকগণ ২০২০ সালে ওয়াশিংটনের সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলোপমেন্ট থেকে প্রকাশিত ‘মহামারি ও নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা’ শিরোনামে গবেষণাপত্রে দেখিয়েছেন, মহামারি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অর্থনৈতিক মন্দার সময় নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার আশঙ্কা বেড়ে যায়। উদাহরণস্বরুপ, আফ্রিকায় ইবোলা সংক্রামণের সময় যৌন নিপীড়ন নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে ইয়াসমীন (২০১৬) দেখান যে, ইবোলার সময় ধর্ষণসহ নারীর বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতা বেড়ে গয়েছিল। অপরদিকে ওয়েংগিং (২০২০) এ তার গবেষণায় উল্লেখ করেন, নারী নির্যাতনের পরিসংখ্যান অনুসারে এই বছরের মার্চে চীন, অষ্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, ইংল্যান্ড এবং আমেরিকায় গত বছরের মার্চের চেয়ে নারী নির্যাতনের হার উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।  

ইউকের বিখ্যাত সংবাদপত্র দ্য গার্ডিয়ানের তথ্যমতে, লকডাউনের কারণে ইংল্যান্ডে নারী নির্যাতন, শিশু নিপীড়ন ও পারিবারিক সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে (দ্য গার্ডিয়ান, ২৮ মার্চ)। অপরদিকে ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্তোফে কাস্তাঁয়ের জানিয়েছেন, লকডাউনের পর ফ্রান্সের বেশ কয়েকটি পুলিশ স্টেশনে পারিবারিক সহিংসতার অভিযোগের হার ৩০ শতাংশ বেড়েছে। জাতিসংঘ বলেছে, তুলনামূলকভাবে দরিদ্র ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোয় ঘরে যারা নিপীড়নের শিকার হন, তাদের ক্ষেত্রেও পারিবারিক সহিংসতা বৃদ্ধি পেতে পারে।

আমরা যদি বাংলাদেশের দিকে তাকাই, বাংলাদেশে করোনাকালে নারী নির্যাতনের পরিধি ও ধরণ জানতে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর পর্যালোচনা করে রীতিমতো উদ্বেগজনক পরিস্থিতি পাওয়া গেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা মানবধিকার সংস্থা থেকে এখনও সেরকম রিপোর্ট বা তথ্য পাওয়া যায়নি। তাই গত মার্চ ২০ থেকে এপ্রিল ২০ পর্যন্ত মোটামুটি ৫টি দৈনিক পত্রিকার রিপোর্ট পর্যালোচনা করে যে ঘটনাগুলো বেশি পাওয়া গেছে তার মধ্যে ধর্ষণ, যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন, গৃহকর্মী নির্যাতন এবং আত্মহত্যা উল্লেখযোগ্য। তুলনামূলকভাবে ধর্ষণের পরিমান সবচেয়ে বেশি এবং ৮০% ক্ষেত্রে ভিকটিম শিশু। পাশাপাশি ৪ এপ্রিল দৈনিক প্রথম আলোর সূত্রমতে, ঢাকা মহানগর এলাকায় ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত মাত্র ১০ দিনে ধর্ষণ, যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন ও অপহরণের ২৮টি মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন ৩৭ জন। এই সময়ের মধ্যে ৯টি ধর্ষণের মামলা হয়েছে। আর যৌতুকের জন্য নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৮টি। এর বাইরে যৌন নিপীড়নের অপরাধে মামলা হয়েছে ৬টি, অপহরণের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৫টি।  

উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর মধ্য দেখা যায়, দাম্পত্য কলহকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় স্বামী তার স্ত্রীকে শ্বাসরোধ করে হত্যা (১১ মার্চ, প্রথম আলো); পারিবারিক কলহের জের ধরে সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলায় এক ব্যক্তি তার স্ত্রীর মুখে অ্যাসিড ছুড়ে ঝলসে দেন (২৮ মার্চ, প্রথম আলো); মাদকাসক্ত স্বামীর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেন শুকলা (২০) নামের এক গৃহবধূ (৮ মার্চ, প্রথম আলো); কুমিল্লা সদরে সাড়ে চার বছরের শিশুকে ধর্ষণ (১৫ মার্চ, প্রথম আলো); পাবনায় এক গৃহবধূকে গণধর্ষণ (২৪ মার্চ, প্রথম আলো); ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার রাংচাপাড়া গ্রামে তৃতীয় শ্রেণির এক মাদ্রাসার ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে বায়ান্ন বছরের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে (১ এপ্রিল, সমকাল) ; কুমিল্লার দেবীদ্বারে এক বুদ্ধি প্রতিবন্ধী কিশোরীকে (১৫) ধর্ষণের অভিযোগে মাদ্রাসা শিক্ষকের বিরুদ্ধে (১ এপ্রিল, সমকাল); জামালপুরে সদর উপজেলার মেষ্টা ইউনিয়নে করোনা রোগী তল্লাশির কথা বলে পুলিশ পরিচয়ে ঘরে প্রবেশ করে এক কিশোরীকে তুলে নিয়ে গণধর্ষণ করেছে ৫ বখাটে (২৮ মার্চ, বিডি নিউজ টোয়েন্টিফোর); দুই বন্ধু মিলে ধর্ষণের পর গলায় দড়ি পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে ছাদ থেকে ফেলে হত্যা এক তরুণীকে (১৫ এপ্রিল, ইত্তেফাক); যৌতুকের দাবিতে ফেনীতে নির্মমভাবে স্ত্রীকে কুপিয়ে হত্যা করে স্বামী (১৫ এপ্রিল, ডেইলি স্টার); ঢাকায় নারী আন্দোলন নেত্রী শারীরিক নির্যাতন করলেন নারী গৃহকর্মীকে (১৭ এপ্রিল, কালের কণ্ঠ); কুষ্টিয়ায় খোকসায় সংখ্যালঘু গৃহবধূর ঘরে ঢুকে ধর্ষণ ও ভিডিও ধারণ (১০ এপ্রিল, সমকাল)।

কাদের দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছে নারী এই সময়ে? সংবাদপত্রের খবর পর্যালোচনা করে দেখা যায়- স্বামী, প্রতিবেশী, ৬০ উর্ধ্ব বৃদ্ধ কিংবা পথচারী এমনকি সহপাঠীদের দ্বারা সহিংসতার শিকার হয়েছে নারী। কোথায় বেশি ঘটেছে নারী নির্যাতন? পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গ্রামকেন্দ্রিক ঘটনা বেশি হলেও মফস্বল শহরে পৌরসভার ভেতরেও নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। শ্রেণীগত দিক থেকে কারা ভিকটিমাইজড হচ্ছে অর্থাৎ ভিকটিমের শ্রেণীভিত্তিক পরিচয়টা কি? এক্ষেত্রে বেশিরভাগ রিপোর্ট এ উল্লেখ না থাকলেও বোঝা যাচ্ছে, নিম্ন মধ্যবিত্ত কিংবা দরিদ্র শ্রেণির নারীরা বেশি সহিংসতার শিকার হয়েছেন। যেমন- গার্মেন্টস কর্মী, গৃহপরিচারিকা, শিশু, প্রান্তিক নারী।  

আত্নহত্যার ঘটনার কারণ হসাবে দেখা যায়, ধর্ষণ চেষ্টা কিংবা উত্যক্ত করায় আত্মহত্যা, শ্বাশুড়ির সাথে ঝগড়ায় আত্মহত্যা, একটা ব্যতিক্রমী ঘটনা যেটা না বললেই নয়, খাবারের অভাবে ১০ বছরের শিশুর আত্মহত্যার মতো ঘটনা। যৌতুকের দাবিতে নিপীড়ন এবং স্বামী কর্তৃক হত্যার মতো ঘটনাও ঘটতে দেখা যায়।  

তবে নারী নির্যাতনের এই চিত্র বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। গত বছরে ২০১৯ সালের নারী নির্যাতনের চিত্র উঠে আসে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইড উপ-পরিষদের রিপোর্টে। ১৪টি দৈনিক পত্রিকা সংবাদ বিশ্লেষণ করে রিপোর্টে জানায়, গতবছরে ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয় ৪ হাজার ৬২২ জন নারী ও শিশু। এর মধ্য, এক হাজার ৭০৩ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয় যেখানে গণধর্ষণের শিকার ২৩৭ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৭৭ জনকে। ধর্ষণের ঘটনায় আত্মহত্যা করে ১৯ জন। এছাড়া ২৪৫ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে আর সব মিলিয়ে। পাচার করা হয়েছে ১৭ জন নারী ও শিশুকে। এর মধ্যে যৌনপল্লীতে বিক্রি করা হয় ৭ জনকে। অ্যাসিড আক্রমণের শিকার হয় ২৪ জন। বিভিন্ন কারণে ৬৩২ জন নারী ও কন্যাশিশুকে হত্যা করা হয়। বিভিন্ন নির্যাতনের কারণে ২৬৪ জন আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। ২৮৭ জনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়। ফতোয়ার শিকার হয় ২৪ জন। বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটেছে ৯৭টি ও বাল্যবিবাহ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে ১৬৯ জনকে।

এমতবস্থায়, করোনাসহ বিভিন্ন মহামারিতে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার কারণ হিসাবে আমি নিম্নোক্ত বিষয়গুলো চিহ্নিত করেছি। প্রথমত, অর্থনৈতিক দুরাবস্থা ও দারিদ্র্যতার কারণে সৃষ্ট চাপ, কোয়ারেন্টিনে থাকার ফলে সামাজিক দূরত্ব, চিরাচরিত পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা, পারিপার্শ্বিক আর্থ সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের ফলে নীপিড়নমূলক আচারণ, রিপোর্ট করার সুযোগ না পাওয়া।

প্রথমত, অর্থনৈতিক সঙ্কট ও দারিদ্রতার কারণে সৃষ্ট চাপের ফলে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা ও নিপীড়নমূলক আচরণ বৃদ্ধি পেতে পারে। লকডাউনে থাকার ফলে পুরুষ প্রচণ্ড অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। দেশ-বিদেশের চিত্র অনুসারে এই মহামারি চলাকালীন ইতিমধ্য কোটি কোটি মানুষ তাদের চাকরি হারিয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখা গেছে। উন্নয়নশীল দেশের সামাজিক রীতি অনুসারে সংসারের অর্থনৈতিক চালিকা পুরুষের কাঁধেই বর্তায়। চাকরি হারিয়ে এবং কর্মসংস্থানের স্থান বন্ধ থাকায় বেশিরভাগ পুরুষই প্রচণ্ড অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়েছে। অনেকেই ধার-দেনাসহ বিভিন্নভাবে সংসার চালোনোর চেষ্টা করেছে। এই অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে মানুষের মনে জন্ম নেয় হতাশা এবং মানসিক অবসাদ। এর ফলে অনেক ক্ষেত্রেই পুরুষ মেজাজ হারিয়ে নারীর প্রতি নির্যাতন করে। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত পরিবারে যাদের মধ্য অর্থনৈতিক সঙ্কট প্রকট, সেইসব পরিবারে এই সহিংসতার পরিমান বেশি।  

স্নাইডার ও তার সহলেখকগণ ২০১৬ সালে আমেরিকায় বিশ্ব মন্দার সময় তাদের গবেষণায় দেখান যে, চাকরিহীন পুরুষ দ্বারা তার সঙ্গীনীকে নির্যাতনের হার কর্মসংস্থানে থাকা পুরুষের কয়েক গুণ বেশি। পাশাপাশি বেলোত্রা, ২০১৯ সালে প্রকাশিত বিশ্বের ৩১টি দেশের উপর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখান, বিশ্বমন্দায় পুরুষের বেকারত্বের কারণে নারী নির্যাতনের হার ২.৫% বেড়েছিল। অপরদিকে ঐ সময়ে নারীর দ্বারা পুরুষের প্রতি সহিংস আচরণ ২.৭৫% কমে গিয়েছিল।

দ্বিতীয়ত, কোয়ারেন্টিনে থাকার ফলে সামাজিক দূরত্ব বৃদ্ধির ফলে নারী নির্যাতন বৃদ্ধি পায়। বস্তুত আমরা অনেকেই ধারণা করে থাকি যেহেতু দৈনন্দিন ব্যাস্ততার কারণে দাম্পত্য জীবনে সময় দেওয়ার সুযোগ পায় না বেশিরভাগ পুরুষ; সেখানে এই কোয়ারেন্টিনের ফলে হয়তো দাম্পত্য সম্পর্ক ও পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় হবে। কিন্তু বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে মহামারিসহ আপদকালীন সময়ে মানুষের মধ্য ভয়, আতঙ্ক, মানসিক চাপ, অবসাদ, দুঃশ্চিন্তা, নিদ্রাহীনতা বৃদ্ধি পায় এবং পারিবারিক সম্পর্কের ওপর তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এছাড়া এই সময় সামাজিক দূরত্বে থাকার ফলে মানুষ তার স্বাধীনতা হারায়, চিত্তবিনোদনের অভাববোধ করে; যার প্রভাব নারী-পুরুষের সম্পর্কেও নেতিবাচকভাবে পড়ে। উদাহরণস্বরুপ- লাউ ২০০৭ সালে হংকং এ পরিচালিত তার গবেষণায় দেখিয়েছেন সার্স, সোয়ান ফ্লু সংক্রমণের সময় বেশিরভাগ নির্যাতনকারী হোম কোয়ারেন্টিনে থাকায় সামাজিক দূরত্বের কারণে সৃষ্ট মানসিক চাপ থেকে নারীর ওপর নির্যাতন করেছেন বলে স্বীকার করেছেন।

তৃতীয়ত, বাংলাদেশে নারীর ওপর সহিংসতার আরেকটি কারণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার কারণ ব্যাখ্যায় অপরাধবিজ্ঞানীয় নারীবাদী তত্ত্ব অনুসারে, পুরুষশাসিত সমাজে পুরুষ নারীদের ওপর সর্বদা ক্ষমতা প্রদর্শন ও কর্তৃত্ব স্থাপন করতে চায়। লকডাউনের সময় পুরুষের বাইরে পেশা ও অন্য কাজে ব্যস্ত থাকার সুযোগ কম থাকায় গৃহে নারীদের প্রতি কর্তৃত্ব স্থাপন বেড়ে যাচ্ছে। এছাড়া বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থায় সহিংসতার শিকার অনেক নারী চাইলেও আইনের আশ্রয় নিতে পারেন না। পরিবার ও সন্তানের কথা ভেবে অনেক নারীই এসব অত্যাচার সহ্য করেন বাধ্য হয়ে।  

এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত ফরাশি ঔপন্যাসিক, দার্শনিক, প্রাবন্ধিক ও  নারী আন্দোলনের ক্ষেত্রে বহুল উচ্চারিত নাম সিমোন দ্য বোভোয়ার তার লেখা নারীবাদের বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থ ‘ল্য দ্যজিয়েম সেক্স’ ইংরেজিতে ‘দি সেকেন্ড সেক্স’ বাংলায় ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’ গ্রন্থটিতে একটি বিখ্যাত উক্তি করেছিলেন ‘কেউ নারী হয়ে জন্ম নেয় না, বরং হয়ে ওঠে নারী’। তার এই বিখ্যাত উক্তির ভাবার্থ হলো, আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাই নারীকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে সম্মান না দিয়ে অবলা, অর্ধাঙ্গীনী রূপে গড়ে তুলছে। অপরদিকে, নারীর বিরুদ্ধে বৈষম্য ও নির্যাতন ব্যাখ্যায় নারীবাদী তত্ত্বীয় যে বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা আছে, যেমন- লিবারেল, মার্কসিস্ট/সোশ্যালিস্ট, র‌্যাডিক্যাল, ইকো, কালচারাল, গ্লোবাল, পোস্ট-মডার্ন তারাও এই লিঙ্গবৈষম্যকে বোঝার চেষ্টা করে এবং জেন্ডার রাজনীতি, স্টেরিওটাইপিং, লৈঙ্গিক নিপীড়ন, পুরুষতন্ত্র ক্ষমতার সম্পর্ক ও সেক্সুয়ালিটির ওপর গুরুত্ব দেয়।  

চতুর্থত, আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় নারীকে দুর্বল হিসাবে দেখার প্রবণতা আছে, এই প্রবণতা স্বল্পশিক্ষিত থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষিত, সব শ্রেণির মধ্যেই দেখা যায়। তাই সারা দেশে নারী নির্যাতনের একটি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে অনেক আগে থেকেই। আমরা সামাজিক ও পারিবারিক পরিমণ্ডলে এমনভাবেই গড়ে উঠি যেখানে আমাদের শেখানো হয়, নারীরা দুর্বল, তাদের ওপর অত্যাচার করা যায়। এমন অত্যাচার সমাজে যেন প্রতিষ্ঠিত। তাই এই মহামারির সময়ও যে নারীকে আলাদাভাবে বা একজন মানুষ হিসাবে দেখতে হবে সেই বিবেচনাবোধ বা মনস্তত্ত্ব আমাদের ভেতরে তৈরি হয়নি। সঙ্গত কারণেই করোনার এই ক্রান্তিলগ্নেও নারী নির্যাতনের হার কমেনি। যদিও বিখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক, রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ জন স্টুয়ার্ট মিল ১৮৬১ সালে লিখিত ও ১৮৬৯ সালে প্রকাশিত ‘দ্য সাবজেকশন অব উইমেন’ শীর্ষক নিবন্ধে নারীদের অধস্তন হিসেবে দেখার বিষয়টিকে ভুল প্রমাণের চেষ্টা করেন।

পঞ্চমত, পারিপার্শ্বিক আর্থ সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের সাথে নীপিড়নমূলক আচারণের একটি সম্পর্ক আছে। যেমন- ইউএনডিপির ২০১৫ সালের এক রিপোর্ট অনুসারে, সিয়েরা লিওনে ইবোলা মহামারির সময় দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চলসমূহে বাল্য বিবাহ, শিশু মাতৃত্ব, বয়স্ক ও ধনী ব্যক্তির সাথে বাল্য বিবাহের পরিমাণ বেড়ে গিয়েছিল। যদিও মহামারিতে এ বিষয়ে আমাদের দেশের নারী নির্যাতনের চিত্র এখনও সঠিকভাবে জানা যায়নি। তবু সংবাদপত্রে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার সংবাদ পর্যালোচনা করে দেখতে পেলাম, তুলনামূলকভাবে গ্রাম ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্য নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার সংখ্যা এই সময়ে বেশি।  

সর্বশেষে বাংলাদেশে নারী নির্যাতন বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম একটি কারণ নির্যাতনের ঘটনা পুলিশে রিপোর্ট না করার সংস্কৃতি। কিছুদিন আগেই একটি জরিপে দেখা গেছে, প্রায় ৮০ শতাংশ নারী কোন না কোন সহিংসতার শিকার হয়। এদের ৭২ শতাংশই সেটি প্রকাশ করে না, অপরাধবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে “ডার্ক ফিগার অব ক্রাইম”। কারণ হিসাবে বলা যায়, বাংলাদেশে আইনের শাসন শক্তিশালীভাবে প্রয়োগ না হওয়া, পুলিশ অনেক ক্ষেত্রেই নারী নির্যাতনের কেস নিতে অপরাগতা, নির্যাতিত নারীকে স্টিগমাইজ করা, নারী নির্যাতনের কেসগুলো দীর্ঘসূত্রতা, অপরাধে দায়ীদের শাস্তি না হওয়া। তাই স্বাভাবিক সময়েই নারীরা তাদের নির্যাতনের ঘটনাগুলো রিপোর্ট করে না। আর এই মহামারির সময় সামাজিক দূরত্বে থাকার কারণে, পর্যাপ্ত সহোযোগিতার মানুষের অভাবে, বাড়তি ঝামেলা মনে হওয়ার কারণে, আতঙ্কগ্রস্ত থাকার কারণে আরও হয়তো তাদের ঘটনাগুলো প্রকাশ করতে পারছে না।

পরিশেষে বলব, নারী নির্যাতন ভাইরাসে আক্রান্ত সমাজকে রোগমুক্ত করার জন্য চাই উপোযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ। প্রথমত, করোনার সময় ও এর পরবর্তী সময়ে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধের জন্য আইন ছাড়াও আমাদের প্রয়োজন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। সহিংসতা প্রতিরোধে নারীদেরও সোচ্চার হতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত হবে এই সময়ে উন্নত অনেক দেশের মত নারী নির্যাতন প্রতিরোধে জরুরি হটলাইন সেবা প্রদান করা। নারী যেন হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা অবস্থায়ও তাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত নির্যাতনের ঘটনা রিপোর্ট করতে পারে সে বিষয়ে স্থানীয় থানার পুলিশ সদস্যদের আরো তৎপর হতে হবে। এখন থেকেই নারী নির্যাতনের হট-স্পট হিসাবে পরিচিত অঞ্চলগুলো চিহ্নিত করতে হবে যেন করোনা পরবর্তী সময়ে ঐ অঞ্চলগুলোতে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ করা যায়।  

গণমাধ্যমসমূহর উচিত হবে করোনা মহামারির সংবাদ প্রচারের পাশাপাশি নারী নির্যাতনের খবরগুলোকেও গুরুত্ব সহকারে প্রচার করা এবং নারী নির্যাতন প্রতিরোধে বিশেষ প্রচারণা চালু করা। আর সামাজিক এই সঙ্কটের মধ্য আমাদের সকলের উচিত হবে নারী ও শিশুর প্রতি ইতিবাচক আচরণ প্রদর্শন। সর্বোপরি নারীকে নারী নয়, মানুষ হিসেবে দেখা শুরু হলেই অনেকাংশে কমে আসবে নির্যাতন।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।  
(কানাডার ইউনিভার্সিটি অব অটোয়ার ক্রিমিনোলজি বিভাগে মাস্টার্সে নারীর বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতার ওপর গবেষণারত)

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।