ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বৈদেশিক সহায়তা বিষয়ক সহজবোধ্য আলোচনা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০১ ঘণ্টা, মে ১৩, ২০২০
উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বৈদেশিক সহায়তা বিষয়ক সহজবোধ্য আলোচনা

এক.
বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বৈদেশিক সহায়তা নিয়ে সহজবোধ্যভাবে আলোচনা করার জন্য আমার বন্ধুদের অনুরোধের আলোকেই এই লেখা। আগেই তাই বলে রাখছি, এটা গভীর বিশ্লেষণধর্মী কোনো উপস্থাপনা নয়। তাই পড়ে হতাশ হলে আমি দুঃখিত। তবে বিভিন্ন আলোচনায় আমার বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই এসব বিষয়ের অবতারণা করে থাকে, যার মধ্যে তথ্যের কিছু ঘাটতি আমি লক্ষ্য করেছি। সে কারণে এই লেখায় কিছু তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করেছি। তথ্যগুলো নিয়ে আমার বিশ্লেষণ সঠিক নাও হতে পারে। সে জন্য নিজের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দিয়ে স্বীয় বিশ্লেষণ করে নিলেই ভালো হবে।

দুই.
এই লেখায় বৈদেশিক সহায়তা বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
বাংলাদেশের বাজেটকে দুই ভাগে ফেলা হয়: 
ক) রাজস্ব বাজেট: যেখানে সরকারের বিভিন্ন আয় এবং পরিচালন ব্যয় উপস্থাপন করা হয়ে থাকে 
খ) উন্নয়ন বাজেট: সরকারের অত্যাবশ্যকীয় রাজস্ব ব্যয় মেটানোর পরে বাজেটে যে উদ্বৃত্ত আয় থাকে তা সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কাজে ব্যয় করা হয়ে থাকে

এই উন্নয়ন বাজেটে অন্তর্ভূক্ত কাজসমূহের উদ্দেশ্য হলো সরকারের মধ্যমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য (যেমন: ২০৩১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের মর্যাদা লাভ করা) অর্জনের জন্য বিভিন্ন খাতে (যেমন: যোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি খাতের নতুন উন্নয়নমূলক কাজ) উন্নয়নমূলক কাজ করা যেগুলো সম্পন্ন করতে সরকারের উদ্বৃত্ত আয় যথেষ্ট নয়। প্রয়োজনীয় উন্নয়নমূলক কাজের ঘাটতি ব্যয় মেটানোর জন্য সরকার বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগিদের কাছ থেকে অনুদান, ঋণ বা খাদ্য সহায়তা গ্রহণ করে থাকে।

এই লেখার উপজীব্য হচ্ছে এই বৈদেশিক সহায়তা। সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের মাধ্যেমে এসব সহায়তা প্রক্রিয়াকরণ করা হয়ে থাকে যা পরিকল্পনা কমিশন কর্তৃক প্রণীত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পসমুহের বাস্তবায়নে ব্যয় করা হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ- ২০২০-২১ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের মোট ১০৪টি প্রকল্প অন্তর্ভূক্ত আছে, যার বিপরীতে মোট বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমান প্রায় ছাব্বিশ হাজার কোটি টাকা। এই ছাব্বিশ হাজার কোটি টাকার মধ্যে বৈদেশিক সহায়তার পরিমান প্রায় এগার হাজার পাঁচশত কোটি টাকা, যা বিদ্যুৎ বিভাগের প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়নের জন্য মোট বরাদ্দের শতকরা চুয়াল্লিশ ভাগ (৪৪%)। এ থেকেই বাংলাদেশের উন্নয়নে বৈদেশিক সহায়তার গুরুত্ব কতখানি তা অনুধাবন করা যায়।

তিন.
বৈদেশিক সহায়তার প্রকারভেদ:
পূর্বেই বলা হয়েছে যে, বৈদেশিক সহায়তা সাধারণত সুনির্দিষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় করা হয়ে থাকে। এর বাইরে কিছু সহায়তা আছে যা বাজেট সহায়তা (Budget Support) এবং খাদ্য সহায়তা হিসেবে পাওয়া যেতে পারে। এই বাজেট সহায়তা খাতভিত্তিক হতে পারে বা উম্মুক্ত ও হতে পারে। এর অর্থ হচ্ছে, উন্নয়ন সহযোগী সুনির্দিষ্ট খাতে (যেমন: শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি) ব্যাবহারের জন্য এটি দিতে পারে অথবা যে কোনো খাতে ব্যবহারের জন্য ও দিতে পারে। যেমন: এই করোনা সংকটকালে সরকারের সবচেয়ে চাহিদা হচ্ছে উম্মুক্ত বাজেট সহায়তা যা সরকার তার প্রয়োজনমাফিক যে কোনো খাতে ব্যয় করতে পারে।  

এই বৈদেশিক সহায়তা হতে পারে ঋণ বা অনুদান বা খাদ্য সাহায্য। ঋণের আবার বিভিন্ন প্রকারভেদ আছে। অনমনীয় এবং নমনীয় ঋণ (Concessional and con-concessional Loan), সরবরাহকারীর ঋণ (Supplier’s Credit)। সরকার ইদানিংকালে খুব কমই অনুদান পেয়ে থাকে (৫%)। স্বাভাবিকভাবেই সবাই এই ঋণের সুদের হার এবং শর্ত নিয়েই বেশি আলোচনা করে থাকে। সরকার কি দেশকে ঋণের বোঝা চাপিয়ে দেউলিয়া করে দিচ্ছে, অর্থনৈতিক কূটনীতির অদক্ষতার কারণে বেশি সূদে ঋণ নিচ্ছে, এমন প্রশ্ন আমার অনেক বন্ধুই করে থাকে এবং যথেষ্ট তথ্য উপাত্ত ছাড়াই অনেকক্ষেত্রে নিজস্ব মূল্যায়ণ দিয়ে দেন যা হয়ত সঠিক নয়। তাদের জন্য কিছু তথ্য তাই এখানে উল্লেখ করব।  

তার আগে উল্লেখ করা প্রয়োজন কোনো ঋণ অনমনীয় (অনেকে বলেন হার্ড লোন) বা নমনীয় (সফট লোন নামেও পরিচিত) কিনা তা আমরা বিবেচনা করে থাকি সেই ঋণের মধ্যে অনুদান উপাদান (Grant Element) কতটুকু তা থেকে। সহজ ভাষায় অনুদান উপাদান হচ্ছে, যে কোনো ঋণের চুক্তিকৃত পরিমান ও ঋণটি যখন সুদে আসলে সম্পূর্ণ পরিশোধ করা হবে সেই সময় বিবেচনায় নিয়ে একটি ডিসকাউন্ট হার (যা সাধারণত ১০% হয়ে থাকে) ব্যবহার করে সেই পরিশোধকৃত অর্থের বর্তমান মূল্য এই দুটির পার্থক্য যা শতকরা হিসেবে প্রকাশ করা হয়ে থাকে। আমি দুঃখিত যে এই কঠিন বিষয়টি আরও সহজ ভাষায় বলতে পারছি না। তবে কিছু বিষয় সহজভাবে চিন্তা করলে এটা সম্পর্কে ধারনা হতে পারে।  

যে কোনো অনুদানের ক্ষেত্রে অনুদান উপাদান (Grant Element) ১০০%। আর ঋণ যদি চলমান বাজার মূল্যে (ডিসকাউন্ট হারের সমান সুদের হার) ও পরিশোধের শর্তে গ্রহণ করা হয় তবে তার অনুদান উপাদান ০%। সুতরাং, ঋণের অনুদান উপাদান নির্ভর করে মূলত তার সুদের হার, ঋণচুক্তি কার্যকরের সময় ও সুদসহ ঋণের আসল পরিশোধের শুরুর সময়ের ব্যবধান (Grace Period) এবং ঋণ পরিশোধের সময়কালের (Repayment Period) ওপর। কোনো ঋণের সুদের হার যত কম, ঋণচুক্তি কার্যকরের সময়কাল ও সুদসহ ঋণের আসল পরিশোধের শুরুর সময়ের ব্যবধান (Grace Period) যত বেশি এবং ঋণ পরিশোধের সময়কাল (Repayment Period) যত বেশি সেই ঋণের অনুদান উপাদানও ততোবেশি। সাধারণত আন্তর্জাতিকভাবে ঋণের অনুদান উপাদান ২৫% বা তার বেশি হলে আমরা তাকে নমনীয় (সফট লোন) ঋণ এবং এর চেয়ে কম হলে অনমনীয় (হার্ড লোন) ঋণ বলা হয়ে থাকে।  

চার.
বৈদেশিক সহায়তার প্রয়োজনীয়তা:
সরকারের মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদী উন্নয়ন পরিকল্পনার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য অত্যাবশ্যকীয় হচ্ছে উন্নয়ন খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা। অভ্যন্তরীণ উৎস হতে সম্পদ সরবরাহের সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বিনিয়োগ চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে বর্তমান আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বৈদেশিক সাহায্য অপরিহার্য।

২০১৮-১৯ অর্থ-বছরের বাজেটে মোট সরকারি বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রা ছিল জিডিপির ৮.২০%। জিডিপির ১.৯৬% নীট বৈদেশিক সাহায্য হতে সরকারের বাজেট ঘাটতি অর্থায়নের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত ছিল। মোট বিনিয়োগ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি করে ২০২০ অর্থ-বছরে জিডিপির ৩৪.৪% করা প্রয়োজন ছিল, যা ২০১৮-১৯ অর্থ-বছরে ছিল ৩১.৬%। সে বিবেচনায় বিনিয়োগ চাহিদা পূরণে বৈদেশিক সহায়তার আহরণ ও কার্যকর ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে বিদ্যুৎ, পরিবহন, ভৌত অবকাঠামো, শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ সামাজিক খাতে বিনিয়োগ চাহিদা পূরণের জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক সহায়তা সংগ্রহ করতে হবে।

পাঁচ.
২০১৮-১৯ অর্থ বছরের বৈদেশিক সহায়তার চিত্র: 
(এই অর্থ বছরের প্রকাশিত তথ্য আমার কাছে রয়েছে তাই এই বছরের চিত্রই তুলে ধরা হল) 
২০১৪-১৫ হতে ২০১৮-১৯ পর্যন্ত পাঁচ অর্থ-বছরে বৈদেশিক সহায়তার ছাড়করণের (Disbursement) পরিমান ২৩.১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (যা গড়ে প্রতি অর্থ-বছরে ৪.৬২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)। ২০১৮-১৯ অর্থ-বছরে বৈদেশিক সহায়তার ছাড়করণের পরিমাণ ছিল ৬.২০ বিলিয়ন যা স্বাধীনতা পরবর্তীকালের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। মোট ছাড়কৃত বৈদেশিক সহায়তার মধ্যে অনুদান ২৫৬.৭১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ঋণ ৫৯৫৪.০৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (১ বিলিয়ন = ১০০০ মিলিয়ন)। মোট ছাড়কৃত অর্থের মধ্যে ঋণ ও অনুদানের হার প্রায় ৯৫% ও ৫%। ২০১৮-১৯ অর্থ-বছরে ছাড়কৃত বৈদেশিক সহায়তার মধ্যে ৩৪০৪.৪২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বহুপাক্ষিক (Multilateral; like World Bank, Asian Development Bank) এবং ২৮০৬.৩৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দ্বিপাক্ষিক (Bilateral; like Japan, France, Germany etc.) উৎস হতে পাওয়া গেছে। এ অর্থ-বছরে বহুপাক্ষিক উৎসের মধ্যে বিশ্ব ব্যাংক সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক সহায়তা ছাড় করেছে যার পরিমাণ ১৯৭০.১৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।  

দ্বিপাক্ষিক উৎসের মধ্য হতে জাপান সর্বোচ্চ ১১৯৫.৬৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক সহায়তা ছাড় করেছে। ২০১৮-১৯ অর্থ-বছরের ছাড়কৃত বৈদেশিক সহায়তার মধ্যে খাদ্য সাহায্য ও প্রকল্প সাহায্য এর পরিমাণ যথাক্রমে ৫.৭১ ও ৬২০৫.০৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থ-বছরে ২৫০.০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বাজেট সহায়তা পাওয়া গেছে। তবে বৈদেশিক সাহায্যের ছাড়করণ সরাসরি প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সম্পর্কিত বিধায় প্রকল্প বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয়/বিভাগের কর্মদক্ষতার উপর ছাড়করণ বহুলাংশে নির্ভরশীল।  

বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি: বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) অর্থায়নে বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা ক্রমহ্রাসমান হলেও এখনো উল্লেখযোগ্য অংশ বৈদেশিক সাহায্য হতে নির্বাহ করা হয়ে থাকে। ২০১৮-১৯ অর্থ-বছরের সংশোধিত এডিপিতে প্রকল্প সহায়তা বাবদ বৈদেশিক সহায়তার পরিমাণ ছিল মোট এডিপি আকারের ৩০.৫৪%। ২০১৮-১৯ অর্থ-বছরের সংশোধিত এডিপিতে বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পের মোট সংখ্যা ছিল ৩৬৫ টি। যার মধ্যে কারিগরি সহায়তা প্রকল্প ১৫৪টি এবং বিনিয়োগ প্রকল্প ২১১টি। এ অর্থ-বছরে বৈদেশিক সহায়তার সিংহভাগই পরিবহন ও ভৌত অবকাঠামো খাতের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে মন্ত্রণালয়/বিভাগ ভিত্তিক বরাদ্দ বিবেচনায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সর্বাধিক বরাদ্দ প্রাপ্ত ছিল আলোচ্য বছরে।  

ছয়.
নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ ও বৈদেশিক সহায়তার ব্যয়: 
আমার বন্ধুদের অনেকেই ঢালাওভাবে বৈদেশিক সহায়তা গ্রহণকে খারাপ হিসেবে দেখেন এবং বিস্তারিত বিশ্লেষণ না করেই ঋণ প্রদানকারী সংস্থাসমুহকে বেনিয়া বা আরও খারাপ ভাষায় আক্রমন করে থাকেন। বিশেষ করে বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক ইত্যাদি থাকে আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য যেহেতু এই দুটি প্রতিষ্ঠানই বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি সহায়তা দিয়ে থাকে। আমরা ভুলে যাই যে তারা আমাদের উন্নয়নের প্রধান সহযোগী। আবার যেমন আমি বর্তমানে সরকারি চাকরি থেকে ছুটি নিয়ে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচিতে কর্মরত আছি। যারা বছরে প্রায় ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান সহায়তা যোগান দিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা করে থাকে, তাদেরকেও অনেক সময় আমরা না বুঝে মহাজন বা লোন শার্ক আখ্যা দিয়ে ফেলি। উন্নয়ন সহযোগীদের যদি কোনো খারাপ উদ্দেশ্য থেকে থাকে তা আমাদের অর্থনৈতিক কূটনীতির দক্ষতা দিয়ে প্রতিহত করতে হবে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার কিন্তু তা করতে পারছে।  

এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের প্রদেয় ঋণের বিষয়টি একটু আলোকপাত করা যাক। জুলাই ২০১৮ এর আগে পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের প্রদত্ত ঋণের কোন সুদ ছিলো না, ঋণচুক্তি কার্যকরের সময় ও সুদসহ ঋণের আসল পরিশোধের শুরুর সময়ের ব্যবধান ছিল ১০ বছর এবং ঋণ পরিশোধের সময়কাল ছিল ৩০ বছর। তবে সার্ভিস চার্জ ছিল ০.৭৫% এবং কমিটমেন্ট চার্জ ছিল ০.২৫% (কমিটমেন্ট চার্জ হচ্ছে ঋণচুক্তি কার্যকর হবার পরেও চূক্তি অনুযায়ী অর্থ ছাড় না করার জন্য চার্জ যা আবেদনের ভিত্তিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নেয়া হতো না)। সে সময়কাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের প্রদত্ত ঋণের অনুদান উপাদান ছিল ৫০% এর ওপরে।  

তবে জুলাই ২০১৮ এর পরে যখন আমরা নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হলাম তখন থেকে বিশ্বব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ি এই শর্তে বাংলাদেশকে আর ঋণ দিতে পারছে না। তাই জুলাই ২০১৮ এর পরে থেকে বিশ্বব্যাংকের প্রদত্ত ঋণের সুদের হার নতুন করে ধার্য করা হয় ১.২৫%, ঋণচুক্তি কার্যকরের সময় ও সুদসহ ঋণের আসল পরিশোধের শুরুর সময়ের ব্যবধান করা হয় ৫ বছর এবং ঋণ পরিশোধের সময়কাল করা হয় ২৫ বছর। তবে আগের মতোই সার্ভিস চার্জ ০.৭৫% বহাল আছে। তদুপরি বিশ্বব্যাংকের বর্তমান শর্তের ঋণের অনুদান উপাদান ২৫% এর কিছুটা ওপরে যদিও বিশ্বব্যাংক আর ইদানিংকালে অনুদান উপাদান সূচকটি ব্যবহার করে না।  

আমি বন্ধুদের অনুরোধ করব, বাংলাদেশের এই বৃহৎ উন্নয়ন সহযোগীদের ঢালাওভাবে আক্রমন না করে যথাযথ ইস্যুতে সমালচনা করার। যেমন: ঋণ প্রক্রিয়াকরণে অনেকক্ষেত্রে অধিক সময়ক্ষেপণ, বিদেশি পরামর্শক নিয়োগে সুপারিশ করা যা অনেক সময়েই দেশি পরামর্শক দিয়েই করা সম্ভব, বিভিন্ন ইস্যুতে সিদ্ধান্ত দিতে ওয়াশিংটনস্থ সদর দপ্তরে যেতে হওয়ায় দেরি করা, কিছু ক্ষেত্রে সরকারের নিজস্ব অগ্রাধিকার প্রকল্পের বাইরে গিয়ে সংস্থার বিবেচনায় অগ্রাধিকার প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারকে চাপ দেওয়া (সরকারের দক্ষতা বৃদ্ধি পাওয়ায় যা বর্তমানে অনেক কমেছে ) ইত্যাদি। তবে একটা বিষয় না বললেই নয়, উন্নয়ন সহযোগীদের নিজস্ব নজরদারির কারণে এবং এসব প্রকল্পে সরকারেরও বিশেষ পরিবীক্ষণ থাকায় বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ বা সুযোগ খুবই কম থাকে। এছাড়া বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্প প্রণয়নে উন্নয়ন সহযোগী অনেক সময় এবং অর্থ ব্যয় করে সরকারকে সহায়তা করে থাকে বলে প্রকল্পের বাস্তবায়ন এবং কাংখিত ফলাফল লাভের নিশ্চয়তা বেশি থাকে।  
 
সাত.
বৈদেশিক সহায়তা গ্রহণের এবং বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা:
সরকার কর্তৃক গৃহীত বৈদেশিক ঋণের সিংহভাগই হলো মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদী ঋণ। সাধারণত মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদী ঋণ নমনীয় প্রকৃতির হয়ে থাকে। ২০১৮-১৯ অর্থ-বছরে সরকার বৈদেশিক ঋণের বিপরীতে সর্বমোট ১৫৬৫.০৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগিদের পরিশোধ করেছে; যার মধ্যে আসল ১১৭৮.৩৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং সুদ ৩৮৬.৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। উল্লেখ্য যে, স্বাধীনতার পর থেকে এ যাবৎ বাংলাদেশ যথাসময়ে ঋণ পরিশোধ করতে সক্ষম হয়েছে। এমনকি ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে কিস্তি পুনঃতফসিলকরণের জন্য বাংলাদেশের কখনো আবেদন করারও প্রয়োজন হয়নি।  

ঋণ ধারণক্ষমতা: বৈদেশিক ঋণের ধারণক্ষমতা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে কতিপয় সূচক আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে অন্যতম ও অধিক প্রচলিত সূচকসমূহ হচ্ছে বৈদেশিক ঋণের স্থিতি এবং বৈদেশিক ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধের সঙ্গে দেশের জিডিপি, রপ্তানী আয়, রাজস্ব আয়ের তুলনামূলক বিশ্লেষণ। ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের ধারণ ক্ষমতার সূচকের মধ্যে বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল জিডিপির ১৩.৯% (যার সহনীয় ঝুকিসীমা হচ্ছে ৪০%) এবং  রপ্তানী+রেমিটেন্স এর ৬৮.৬% (যার সহনীয় ঝুঁকিসীমা হচ্ছে ১৫০%)। আর বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরিমান রাজস্বের ৮.৩% (যার সহনীয় ঝুঁকিসীমা হচ্ছে ৩০%) এবং  রপ্তানী+রেমিটেন্স এর ৩.৯% (যার সহনীয় ঝুঁকিসীমা হচ্ছে ২০%)। এই সূচকগুলো বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের ধারণক্ষমতা সর্বোচ্চ ঝুঁকি সীমার অনেক নিচে। অর্থাৎ বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের ধারণ ক্ষমতা সন্তোষজনক পর্যায়ে আছে এবং সরকার দেশকে অত্যাধিক বৈদেশিক ঋণের বোঝা বাড়িয়ে দেউলিয়া করে দিচ্ছে না।  

অনমনীয় ঋণের ঝুঁকি হ্রাসে গৃহীত উদ্যোগ:
২০৩১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অতিরিক্ত বিনিয়োগ চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। অপরদিকে বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা, ইউরোপকেন্দ্রিক ঋণ জটিলতা ও পরিবর্তনশীল ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নমনীয় ঋণের উৎস সংকুচিত হয়ে পড়েছে। আবার রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠান, স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান সরকারের গ্যারান্টির বিপরীতে অনমনীয় ঋণ গ্রহণ করছে বিধায় বৈদেশিক ঋণের ঝুঁকি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে সে কথাও সত্য। কঠিন শর্তের ঋণের ঝুঁকি প্রশমনের জন্য ঋণের নমনীয়তা পরীক্ষা ও অনুমোদনের জন্য অর্থমন্ত্রী মহোদয়ের সভাপতিত্বে একটি অনমনীয় ঋণ বিষয়ক স্থায়ী কমিটি রয়েছে। যে সকল বৈদেশিক ঋণের অনুদান উপাদান ৩৫% এর কম, সে সকল বৈদেশিক ঋণ এ কমিটিতে পরীক্ষা ও অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করতে হয়। এ কমিটি অনমনীয় ঋণ গ্রহণের প্রস্তাবসমূহ যাচাই বাছাই করে অনুমোদন দিয়ে থাকে। অনমনীয় ঋণ বিষয়ক এই কমিটি ২০১৮-১৯ অর্থ-বছরে ০৩টি অনমনীয় ঋণ গ্রহণের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে।  

আট.
পরিশেষে বন্ধুদের বলতে চাই, বৈদেশিক সহায়তা আমাদের প্রয়োজন এবং সেটা ঋণ হলে তা পরিশোধের সক্ষমতা আমাদের রয়েছে। তবে জনগনণের করের টাকায় পরিশোধিতব্য এ সকল ঋণ ব্যবহার করে অবশ্যই সর্বোচ্চ উপযোগিতা যেন অর্জন করা যায় সেটি নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, বিভিন্ন স্তরে সরকারি কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি চলমান রাখতে হবে এবং সরকার তা করে যাচ্ছে বিভিন্ন সমালোচনা সত্ত্বেও। আমি জানি এই দক্ষতা বৃদ্ধির বিষয়ে আমার বন্ধুদের অনেক উষ্মা রয়েছে। এ বিষয়ে আমার মতামত আরেকদিন লিখব।

(এই লেখার বিভিন্ন তথ্য সূত্র হচ্ছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ এবং উক্ত বিভাগে ২০০৫-২০০৯ সময়কালে আমার চাকরির অভিজ্ঞতা)

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।