১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ হানাদার বাহিনী পুলিশ লাইন দখল করে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড, অগ্নিসংযোগ শুরু করলে মন্টু বাবু আমাদের বাড়িতে চলে এলেন। আমাদের বাড়িটি তখন তিনটি পাকা রুম এবং সেইসাথে একটি সেমিপাকা ঘর নিয়ে ছিল।
জুন-জুলাই মাস থেকে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো দেশগুলোর কারণে গড়ে ওঠা আন্তর্জাতিক চাপে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পাকিস্তানি বাহিনী খুন-খারাবি একটু কমিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। ঠিক এই সময়ে একদিন সকালে পাকিস্তানী সৈন্যরা মন্টু বাবুকে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে যায় ইস্পাহানি বিল্ডিং সংলগ্ন আর্মি এম্বারকেশন ইউনিটে।
আমার আব্বা পৃথিবীর সকল সমস্যার জন্য আম্মার ওপরই ঝাল ঝাড়তেন। মন্টু বাবু রাস্তায় কেন গেল, তার জন্যও প্রথমেই আম্মার ওপর একচোট নিলেন আব্বা। আম্মা মিনমিন করে বললেন, ও কি বাচ্চা ছেলে যে সারাদিন ওকে আমি চোখে চোখে রাখবো? কখন বেরিয়েছে সে, তা আমি জানিই না। এখন যেটা হালিম কোম্পানির বাড়ি নামে পরিচিত, সেই বাড়িটির মালিক ছিলেন ফাতেমী সাহেব নামক একজন অবাঙালি ভদ্রলোক। স্বাধীনতার বেশ পরে হালিম কোম্পানির কাছে বাড়িটি বিক্রি করে করাচি চলে যান ফাতেমী সাহেব।
শিক্ষিত, সজ্জন ব্যক্তি ছিলেন ফাতেমী সাহেব। আব্বা ফোন করে ফাতেমী সাহেবকে অনুরোধ করলেন- মন্টু বাবুকে বাঁচাতে। ফাতেমী সাহেবও মন্টু বাবুকে চিনতেন। ফাতেমী সাহেব খোঁজখবর নিয়ে কিছুক্ষণ পর জানালেন- ভয় নেই, ওরা মন্টু বাবুকে মারবে না। আমরা কিন্তু ধরে নিয়েছিলাম- মন্টু বাবু আর ফিরে আসবেন না।
সকলকে অবাক করে সন্ধ্যার একটু আগে তিনি ফিরে আসলেন অক্ষতভাবে। এসেই আম্মাকে বললেন, ভাবী, দুয়া বাত খাইয়ুম (ভাবী, দুটো ভাত খাবো)। তিনি একটু স্থির হয়ে বসলে আমি কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ওরা ভাত খেতে দেয়নি? মন্টু বাবু বললেন, ইতারা বাত খা’আনা? কউয়া লুটি দিয়েল খাইতো, হঙ্গে ডাইল। ডাইলগিন মজা আছিল, ওয়া (ওরা ভাত খায়? কয়েকটা রুটি দিয়েছিল খেতে, সঙ্গে ডাল। ডালটা মজা ছিল)। তারপর শোনালেন তাঁর সারাদিনের কাহিনী।
“ওরা আমকে ধরে নিয়ে এক জায়গায় বসিয়ে রাখলো। আমি ধরেই নিয়েছি একটু পরেই আমাকে মেরে ফেলা হবে। মনে মনে সব ঠাকুর দেবতাকে স্মরণ করলাম। প্রার্থনা সেরে নিলাম। একজন হাবিলদার এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, কেয়া নাম হ্যায় তুমহারা? আমি ভাবলাম মিথ্যা বলে ধরা পড়ে মরার চাইতে যা সত্যি, তাই বলবো, এতে যা হয় হবে। বললাম, মন্টু কুমার শীল হ্যায় মেরা নাম। হাবিলদার জিজ্ঞেস করলো, কেয়া কাম করতা হ্যায়? আমি বললাম, হাম হাজাম (নাপিত) হ্যায়, স্যার। এটা শোনামাত্র হাবিলদার চিৎকার করে বলে উঠলো, সাবকো আনে বোলো, জিস জিসকা বাল কাটওয়ানা হ্যায় (সবাইকে আসতে বলো, যার যার চুল কাটানো দরকার)। সব সরঞ্জাম ওখানে রেডি ছিল। এরপর একের পর এক সৈন্যের চুল কাটতে শুরু করলাম আমি। কেউ কেউ আবার সেভও করালো। কমপক্ষে ৩০-৪০ জন হবে। আমার মনে ভয় ঢুকলো, কাজ শেষ হলেই গুলি করে মেরে ফেলা হবে আমাকে। দুপুরে খাওয়া ও নামাজের জন্য একটু বিরতি দিয়ে আবার শুরু হলো কাজ। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে আমাকে বলা হলো চলে যেতে। আমি ভয় পেলাম, পেছন ফিরলেই আমাকে গুলি করা হবে। একটু ভরসা পেলাম তখন, যখন ওই হাবিলদার ইয়ে লো বলে তিনটি টাকা আমার দিকে এগিয়ে দিলো। আমি টাকাটা হাতে নিয়ে ঠাকুরের নাম জপতে জপতে চলে এলাম। ”
আপনাকে আবার টাকাও দিয়েছে ওরা, আমার বিস্ময়ভরা প্রশ্ন শুনে জবাব দিলেন মন্টু বাবু। দুরো, বহুত খম দিয়ে ওয়া। এতাইন মাইনষের কাম গইল্লে খমত এক শ টিয়া বিল আইসতো (দূর, অনেক কম দিয়েছে। এতজন মানুষের কাজ করলে কমপক্ষে একশ টাকা বিল আসতো)। আব্বাকে এই ঘটনা বললে আব্বা বললেন, ওকে বলো- পাঠান পাঞ্জাবীরা একটা প্রবাদ বলে, জান বাঁচি, লাখো পায়ি। মানে, জান বেঁচেছে, এতেই লাখ টাকা পেয়েছি। আমি মন্টু বাবুকে এসে কথাটা বললাম। এটা শুনে বললেন, আসলেই তো !
পবিত্র রমজান মাস এলেই আমার মন্টু বাবুর কথা মাঝে মাঝে মনে পড়ে যায়। ৭৭-৭৮ সাল হবে। তখন আমরা সবে কলেজে ঢুকেছি। এই সময় রোজার মাস এলে বন্ধু কাজল, কুদ্দুস, শামীমরা মিলে ভোরে একটু আগে আগে সেহরি খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়তাম। কর্ণার হোটেলে কিছুক্ষণ আড্ডা মেরে এক কাপ চা খেয়ে তারপর মসজিদে যেতাম ফজরের নামাজ পড়তে।
একদিন দেখলাম সেহরি খাওয়ার জন্য যে মানুষটা হাঁকডাক দিয়ে মানুষকে ঘুম থেকে জাগায়, সে মন্টু বাবুর দোকানটা বাদ দিয়ে অন্য দোকানগুলোতে, যার ভেতরে মানুষ থাকতো, সবাইকে জাগিয়ে দিলো। আমার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চাপলো। আমি মন্টু বাবুর দোকানের কাঠের দরজায় জোরে জোরে আঘাত করে নিজের স্বর বিকৃত করে বললাম, ওয়া, উডো উডো। ভাত খ’অ, রোজা রাহো (ওহে, উঠে পড়ো, উঠে পড়ো। ভাত খাও, রোজা রাখো)। আমরা ভেবেছিলাম মন্টু বাবু রেগেমেগে কিছু একটা বলে উঠবেন। কিন্তু আমাদের সবাইকে অবাক করে বললেন- খাই, খাই। খাই এই মাত্র লেইট্টি দে (খেয়েছি, খেয়েছি। খেয়ে এইমাত্র শুয়েছি)। আমরা হাসতে হাসতে কর্ণার হোটেলে ঢুকলাম। পরে অনেকদিন আমার এই খেলা চললো। তবে আমার ভাগ্য ভালো ছিল, মন্টু বাবু কখনো আমার গলার স্বর চিনতে পারেননি।
বাংলাদেশ সময়: ১১৩০ ঘণ্টা, মে ২৪, ২০২০
এসি/টিসি