করোনা ভাইরাসের জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ থাকায় মনোয়ারের মতো অনেকেই আজ কর্মহীন। আর্থিক সমস্যায় দূর্বিষহ দিন যাপন করছেন তারা।
‘কাজ ছাড়া আজ আমি নিদারুণ কষ্টে আছি। আমার মনে হয় প্রাণহীন মানুষ হয়ে বেঁচে আছি। সন্তানদের মুখ দেখলে খুব কষ্ট হয়, আমি কীভাবে তাদের মানুষ করবো?’ আক্ষেপের কণ্ঠে বলছিলেন মনোয়ার।
এ কষ্ট মনোয়ারের একার নয়। জাতিসংঘের শ্রম সংস্থার এক প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বে প্রতি ছয় জনের মধ্যে একজন তরুণ করোনার প্রভাবে আজ কর্মহীন। মহামারির প্রকোপ দীর্ঘমেয়াদে বাড়লে মনোয়ারের মতো তরুণদের ‘লকডাউন’ প্রজন্ম বলতে হবে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) বলছে, করোনার প্রভাবে ৩০৫ মিলিয়ন পূর্ণকালীন চাকরি ইতোমধ্যে মানুষ হারিয়েছে। অনেক তরুণ কর্মী অর্থনৈতিক কষ্টের মধ্যে পড়েছে এবং ভবিষ্যৎ কর্মসন্ধানে তারা আজ দ্বিধাগ্রস্ত।
উক্ত সংস্থার মহাপরিচালক গে-রাইডার সতর্ক করেছেন, ১৫ থেকে ২৮ বছর বয়সী কর্মীদের অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণের অভাবে মহামারি বা পরবর্তী সময়ে কাজ পেতে সমস্যা হবে।
আমি বাংলাদেশের এক এনজিও প্রধানের সঙ্গে কথা বলি লকডাউন ও কর্মী সংকোচনের বিষয়ে। তিনি পরিকল্পনা করছেন, যদি এরূপ অবস্থা স্থায়ী হয়, সেক্ষেত্রে তিনি অপেক্ষাকৃত কম অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কর্মীদের ছাঁটাই অথবা বিনা পারিশ্রমিকে সেবামূলক (Volunteer) কাজে সুযোগ দেবেন।
আবার আসি মনোয়ারের কথায়। চাকরি করার সময় তিনি কিছু সঞ্চয় করেছিলেন, যা দিয়ে আগামী ৬ থেকে ৭ মাস কোনো রকমে পরিবার চালাতে পারবেন।
‘জানি না এরপর কী করবো। ভবিষ্যৎ আমার কাছে এখন অজানা। আমি ভীত সামনের দিনগুলো নিয়ে। যদি আমার পরিবারের কোনো চিকিৎসার খরচ লাগে, আমি জানি না কোথা থেকে সংগ্রহ করতে পারবো, আমার জমানো টাকা নেই, চাকরি নেই, সরকার থেকে কোনো সাহায্য হয়তো পাবো না। ’ তিনি বললেন।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা সুপারিশ করছে, এই বিরূপ পরিস্থিতিতে সরকারের সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে হবে কর্মহীন লোকদের জন্য। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও চাকরির নিশ্চয়তার জন্য কাজ করতে হবে। এখন জরুরি হচ্ছে সবার জন্য করোনা পরীক্ষা এবং কর্মক্ষেত্র নিরাপদ করার জন্য কাজ করা। অর্থনীতিকে সচল করতে কর্মীদের নিরাপদ কর্মস্থল এবং ক্রেতাদের আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে হবে।
বাংলাদেশ সরকার নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করছে। অর্থনীতিকে সচল করতে, জীবন ও জীবিকার মধ্যে ভারসাম্য আনতে ‘লকডাউন’ শিথিল করছে। কিন্তু এ ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল চীনের পর ইউরোপ হয়ে আমেরিকায় অসংখ্য প্রাণহানি ঘটিয়েছে। বাংলাদেশে ক্রমান্বয়ে এর প্রভাব এখন ঊর্ধ্বমূখী।
জাফর ঢাকায় নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করতেন। গত দু’মাস ধরে কাজ বন্ধ থাকায় তিনি গ্রামে ফিরে গেছেন। এ রকম অনেকে কাজ না থাকায় গ্রামে চলে গেছেন। যার ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। গ্রামীণ অর্থনীতির যোগান ও চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য বিনষ্ট হতে পারে। বাড়তে পারে সামাজিক অস্থিরতা।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বলছে, পৃথিবীতে ১৭৮ মিলিয়ন কর্মী যারা তরুণ, তাদের মধ্যে ৪০ শতাংশ কর্মী ইতোমধ্যে বিপদে পড়েছে যারা বিভিন্ন সেবামূলক কাজে নিয়োজিত যেমন হোটেল, পর্যটন, খাদ্য শিল্প ইত্যাদি।
আমাদের সবাইকে এখন ভাবতে হবে কীভাবে আমাদের কর্মসংস্থান সবার জন্য উন্মুক্ত করতে পারি। বিদেশে শ্রমবাজার ধরে রাখার জন্য নীতি নির্ধারকদের এখনই ভাবতে হবে। চাহিদামতো প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে হবে।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, আগামীতে কোন পেশায় শারীরিক দূরত্ব রেখে কাজ করা যায় এরূপ খাত নির্ধারণ করে আমাদের তরুণ সমাজকে প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে। সেটি অনলাইনভিত্তিকও হতে পারে।
কর্মসংস্থান তৈরিতে শুধু সরকারের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। সবার স্বতস্ফূর্ত অবদানের মাধ্যমে সবার জন্য কর্মক্ষেত্র তৈরি করতে হবে এটাই হোক আমাদের আগামীর ভাবনা।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, হোপ ফর দ্য পুওরেস্ট