১৯৭১ সালের যুদ্ধের সাথে বর্তমান যুদ্ধের খুব বেশি পার্থক্য নেই। পার্থক্য তখন শত্রু ছিল দৃশ্যমান পাকিস্তানি খান সেনা।
করোনা ভাইরাস এমনি এক ভাইরাস যে কেউ, যে কোনো মুহূর্তে আক্রান্ত হতে পারেন। এমনকি বাড়িতে ঘরের মধ্যে বসে থাকলেও আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। যার জ্বলন্ত উদাহরণ আমি নিজেই। ঘরে থাকা সত্ত্বেও আমি কিছুদিন আগে করোনা আক্রান্ত হই। উৎস এখনো অজানা। তাহলে এভাবে আক্রান্ত হতে থাকলে, বিশাল আক্রান্ত জনগোষ্ঠী কি পর্যাপ্ত চিকিৎসা পাবে? তাহলে চিকিৎসা ছাড়াই কি মারা যাবে অগণিত মানুষ। বিনা চিকিৎসায় একজন রোগীও মারা যাক, এটা আমাদের কারোই কাম্য না। আবার বর্তমান বাস্তবতায় সবাইকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়াও সম্ভব হচ্ছে না। তাহলে কি এ অবস্থা চলতে থাকবে? অবশ্যই না, এমন অবস্থা চলতে দেওয়া যায় না। আমি মনে করি, এই অবস্থা থেকেও উত্তরণের জন্য আমাদেরকে আবারও ফিরে যেতে হবে বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই বিখ্যাত ভাষণে, ‘তোমরা ঘরে ঘরে শত্রুর বিরুদ্ধে দুর্গ গড়ে তোল’। তাই বর্তমান অবস্থায় আমাদের ঘরে ঘরেই করোনার বিরুদ্ধে দুর্গ অর্থাৎ হাসপাতাল গড়ে তুলতে হবে, চিকিৎসাসেবা প্রদান করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ আরও বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখবে। ভিডিও কলে চিকিৎসা দেওয়া যেতে পারে। ফেইসবুক পেইজগুলো থেকে করোনা প্রতিরোধে সচেতনতা এবং চিকিৎসা দেওয়া যেতে পারে, দেওয়া যেতে পারে টেলিমেডিসিন চিকিৎসা, যা আমরা আমাদের কোভিড টিমের মাধ্যমে করে যাচ্ছি। ঘরে বসেই চিকিৎসা পাচ্ছেন অসংখ্য রোগী।
করোনা ভাইরাসের বর্তমান পরিস্থিতি প্রাথমিকভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য যেসব ওষুধ দরকার তার সব আমাদের দেশেই পর্যাপ্ত পরিমাণে আছে। শুধু প্রয়োজন তার সঠিক প্রয়োগ। ডাক্তার যে পরিমাণে আছে তাতেও সমস্যা নেই। শুধু হাসপাতালে বেড এবং সুযোগ সুবিধা প্রয়োজনের তুলনায় কিছুটা কম। তাই এখন খুব ক্রিটিক্যাল রোগী ছাড়া ঘরে ঘরে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা অতি প্রয়োজন। এজন্য দরকার একটি সঠিক পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়ন।
আমি নিজেও করোনায় আক্রান্ত হয়ে, করোনার সাথে যুদ্ধ করছি, একইসাথে আক্রান্তদের টেলিমেডিসিন সেবাও দিয়ে যাচ্ছি। ‘Emergency COVID19 Management by FDSB ফেইসবুক গ্রুপের মাধ্যমে আমরা করোনা রোগীদের সেবা করছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমরা প্রায় চার শতাধিক হাসপাতাল ফেরত রোগীকে বাসায় চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করেছি। যার মধ্যে অনেক বয়স্ক এবং আগে থেকেই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ছিলেন এমন রোগীও আছেন। আমরা ফিমেল ডেন্টাল সার্জন এবং বিশেষজ্ঞ এমবিবিএস ডাক্তাররা মিলে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি।
আমাদের চিকিৎসায় শতভাগ রোগী সুস্থ হয়েছেন। শুধু টেলিমেডিসিন সেবায় বাসায় রেখেই আমাদের টিম তাদের সুস্থ করেছে। করোনা রোগীদের চিকিৎসা করতে গিয়ে আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে কিছু প্রস্তাবনার কথা উল্লেখ করছি। আমি মনে করি এই মুহূর্তে যদি আমার প্রস্তাবনাগুলো সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী বিবেচনা করেন তাহলে অধিকাংশ করোনা রোগীরা বেঁচে যাবেন এবং করোনার বিরুদ্ধে আমাদের জয় সম্ভব ইনশাআল্লাহ। একই সাথে অনান্য রোগীরাও চিকিৎসাসেবা পাবেন।
• প্রতিটি সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালে ফ্লু কর্নার তৈরি করা, যেখানে করোনা টেস্ট সহজলভ্য করতে হবে।
• যেহেতু শ্বাস কষ্টে মারা যাচ্ছেন অধিকাংশ করোনা রোগী, তাই প্রয়োজন অনুযায়ী করোনা রোগীর অক্সিজেনের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে পারলে বেঁচে যাবে বেশিরভাগ করোনা রোগী। তাই পর্যাপ্ত পরিমাণ অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
• কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এই মহামারিকালেও অক্সিজেনের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে, ফলে গরীব রোগীদের পক্ষে অক্সিজেন নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ বিষয়ে সরকার কঠোর নজরদারি করবে আশা করছি।
• অক্সিজেন সরবরাহে এলাকাভিত্তিক ছোট বড় সকল হাসপাতালে অক্সিজেন ব্যাংক তৈরি করা যেতে পারে। প্রয়োজনে সরকার অক্সিজেনে ভর্তুকি দিয়ে হলেও অক্সিজেন সরবরাহ করতে হবে। এক্ষেত্রে সমাজের উচ্চবিত্তরা, বিভিন্ন সংস্থা এগিয়ে আসতে পারে। এলাকার স্বেচ্ছাসেবকদের ট্রেনিং দিয়ে করোনা রোগীদের প্রয়োজনে এম্বুলেন্স, হাসপাতালের রোগীকে যেতে সহায়তা করা, করোনা টেস্টের ব্যাপারে সাহায্য করার ব্যবস্থা করতে হবে।
• করোনা টেস্টের রিপোর্ট অনেক ক্ষেত্রেই ভুল বা ফলস নেগেটিভ বা পজিটিভ আসে। সেক্ষেত্রে রোগীর লক্ষণ থাকলে প্রাসঙ্গিক আরও কিছু টেস্ট যা করোনাকে ইংগিত করে, সেই টেস্টগুলো করা যেতে পারে। যত তাড়াতাড়ি প্রাথমিক পর্যায়ে রোগীর চিকিৎসা শুরু করা যায় ততোই ভালো। লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসা দেওয়া শুরু করা যেতে পারে।
• যেহেতু রোগীর তুলনায় ডাক্তার কম দেখা যাচ্ছে তাই বিএমডিসি সনদধারী সকল ডাক্তারের পাশাপাশি সকল নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের একটি সরকারি নীতিমালার আওতায় এনে করোনার ট্রেনিং দিয়ে কাজে লাগানো যেতে পারে।
• বয়স্ক বিভিন্ন কোমরবিটি রোগে আক্রান্ত এবং গর্ভবতী ডাক্তারদের শুধুমাত্র টেলি-মেডিসিন ভিডিও কলে রেখে, করোনা সেবায় নিযুক্ত রাখা যেতে পারে। তাদের সরাসরি রোগীর সংস্পর্শে আসতে না দেওয়াই ভালো । তারা আমাদের দেশের সম্পদ।
• ‘করোনা হলেই আমি মারা যাবো’ মানুষের মন থেকে এই ভীতি দূর করতে হবে। এক্ষেত্রে লিফলেট, মাইকিং, সংবাদপত্র, রেডিও এবং টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে বেশি করে করোনা সচেতনতায় ছোট নাটিকা, টিভিসি, গান, ডাক্তার পরামর্শমূলক অনুষ্ঠান বেশি বেশি প্রচার করা যেতে পারে।
• এলাকাভিত্তিক সব হাসপাতাল, ক্লিনিকে করোনা ট্রেইনড ডাক্তার রাখা যেতে পারে।
• এলাকারভিত্তিক বিশিষ্ট ব্যক্তি, বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতাকর্মী, চেয়ারম্যান, মেম্বার, স্বেচ্ছাসেবক, যুবদের নিয়ে সমন্বিত ভাবে নিজ নিজ এলাকার করোনা রোগীর সেবা এবং করোনা প্রতিরোধে একযোগে কাজ করা শুরু করতে হবে।
• প্রতিটি সরকারি বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকে সংক্রমণ প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনা কঠিনভাবে অনুশীলন করা যেতে পারে। ফলে একদিকে ডাক্তারদের যেমন আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা কমে যাবে, তেমনি সেবা নিতে আসা রোগীরাও আক্রান্ত হবেনা।
লেখক: ডেন্টাল সার্জন, অর্থডন্টিক্স ডিপার্টমেন্ট, বিএসএমএমইউ