পক্ষান্তরে গ্রামের তুলনায় নগর জীবনে সালিশ-মীমাংসার পরিমাণ কমই বলা যেতে পারে। এখানে শারীরিক শাস্তি দেওয়ার রেওয়াজটাও কম।
গ্রামীণ বিচার ব্যবস্থায় বিচারক হন গ্রামের রাজনৈতিক কিংবা প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ। তারা মেধা ও বুদ্ধি দিয়ে যতটুকু সম্ভব ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার চেষ্টা করেন। বিচারকগণের নিরপেক্ষতা, মানবিক গুণ, শিক্ষা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ততটা চিন্তা করা হয় না। দেখা যায়, বিচার শুরুর আগেই বিচারকদের মধ্যে দুটি গ্রুপ হয়ে বসে থাকে। একটি গ্রুপ অভিযোগকারীকে এবং আরেকটি গ্রুপ অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সমর্থন দেন। ফলে বিচার প্রার্থীগণ সব সময় ন্যায় বিচার পান- সে কথা সন্দেহাতীতভাবে বলা কঠিন।
আপস-মীমাংসার ক্ষেত্রে গ্রামীণ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের প্রভাব কিছুটা হলেও কাজ করে এখানে। তবে বড় ধরনের অপরাধ ঘটলে সেসব অপরাধের বিচার সালিসের মাধ্যমে সমাধান হয় না। সেগুলি নিয়মিত মামলা হিসেবে আদালতেই গড়ায়।
একজন অভিযোগকারী থানায় মামলা করতে গেলে দেখা যায়, তার প্রতি যে অন্যায় করা হয়েছে কিংবা যে সকল অপরাধ সংঘটিত হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি অভিযোগ দায়ের করে আসেন। সংশ্লিষ্ট অপরাধের অন্য যে ধারাগুলি থাকে সেগুলোও ঢালাওভাবে বসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। ফলে, প্রকৃত ঘটনাটি অতিরঞ্জিত হয়ে যায়। অতিরঞ্জিত করতে গিয়ে অনেক সময় মামলার মেরিট নষ্ট করে ফেলেন মামলার অভিযোগকারী এবং পুলিশ মিলে। কঠিন কঠিন ধারা থাকার ফলে অভিযুক্ত ব্যক্তির জন্য জামিন পাওয়াও কঠিন হয়ে যায় তখন। তবে ট্রায়াল পর্যায়ে মামলাটি ভালো আইনজীবীর হাতে পড়লে অনেক ফাঁক-ফোঁকর বেরিয়ে আসে এবং মামলাটি দুর্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু ততদিনে একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি জামিন না পেয়ে দিনের পর দিন কারাগারে বন্দী হয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করেন এবং তার পুরো পরিবার অসহায় হয়ে পড়ে, যা একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি ও তার পরিবারের মানবিক অধিকারের প্রতি চরম প্রবঞ্চনা।
আমাদের দেশে অনেক অভিযোগকারীই রয়েছেন, যারা শুধু হয়রানির উদ্দেশ্যেই মিথ্যা মামলা করে বসেন। প্রাথমিকভাবে, একজন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আমাদের আইন এবং সমাজ নেগেটিভ দৃষ্টিকোণ থেকেই বিবেচনা করে। অভিযোগ মিথ্যাই হোক আর সত্যই হোক, মামলার ধারা কঠিন হলে, প্রথম অবস্থায় একজন অভিযুক্ত ব্যক্তির পক্ষে জামিন পাওয়া বেশ মুশকিল। দেখা যায়, অপরাধ প্রমাণ হওয়ার আগেই একজন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দীর্ঘদিন কারাগারে বন্দী জীবন কাটাতে হয় যা কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত হতে পারে। অপরাধ প্রমাণিত না হলে অভিযুক্ত ব্যক্তি মামলা থেকে খালাস পেয়ে যান। কিন্তু ততদিনে দেখা যায়, একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি সাজা হিসেবে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলি কারাগারে বসে অতিবাহিত করেন। একজন নিরপরাধ ব্যক্তি যখন তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলি কারাগারে বসে বন্দী হয়ে কাটান- তখন যে কী পরিমাণ মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়, তা কেবল সেই অভিযুক্ত ব্যক্তি এবং তার ভুক্তভোগী পরিবারই অনুধাবণ করতে পারেন, আর কেউ নয়।
মিথ্যা অভিযোগকারীদের সাজার ব্যাপারে মাননীয় আদালত এবং বিজ্ঞ আইনজীবীদেরকে সজাগ থাকতে হবে বেশি। বিচার হতে হবে দ্বিপক্ষীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে। অর্থাৎ অভিযোগ যদি সত্য হয় তাহলে অপরাধী সাজা পাবে। কিন্তু অভিযোগ যদি মিথ্যা হয়, তাহলে অভিযোগকারীকেও সমানভাবে সাজা ভোগ করতে হবে। এক্ষেত্রে কোনরূপ ছাড় দেওয়া যাবে না। সাজা প্রদান করার ব্যাপারে দৃঢ় মানসিকতা তৈরি করতে হবে আমাদের। শুধুমাত্র আর্থিক জরিমানা করা হলে একজন অভিযুক্ত নিরপরাধ ব্যক্তির আর্থিক, মানসিক এবং মানবিক ক্ষতির প্রতি যথেষ্ট ন্যায় বিচার করা হবে না।
বিচার শেষে একটি মামলা মিথ্যা প্রমাণিত হলে আদালতের মূল্যবান সময় যেমন নষ্ট হয়, তেমনি একজন নিরপরাধ ব্যক্তি অর্থনৈতিক ও মানসিকভাবেও ভেঙে পড়েন অনেকটা। বাংলাদেশে হাজার হাজার মামলার জট সৃষ্টি হওয়ার পেছনে মিথ্যা কিংবা তুচ্ছ বিষয়কে অতিরঞ্জিত করে বড় বড় মামলা করাও অন্যতম একটি কারণ। মামলার ধারা কঠিন হলে, নিম্ন আদালত সেসব মামলায় জামিন দেওয়ার ক্ষেত্রে খুব একটা আগ্রহ দেখান না। ফলে অপরাধের ধারার ভারেই কয়েক মাস বিনা বিচারে জেল খাটতে হয় একজন অভিযুক্তকে।
একটি ক্রিমিনাল মামলা রুজু হওয়ার পর আদালতসমূহ সেটিকে তদন্তের জন্য সংশ্লিষ্ট থানায় পাঠান। কিন্তু দেখা যায়, একটি মামলার তদন্ত রিপোর্ট প্রদান করতে লেগে যায় মাসের পর মাস। গুরুতর অপরাধের তদন্ত রিপোর্ট ছাড়া মামলার কার্যক্রম সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়া যায় না কিংবা অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জামিনে মুক্তি দেওয়াও সম্ভব হয় না। ক্রিমিনাল মামলাসমূহের তদন্তের জন্য একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন সংস্থা গঠন করা গেলে, তদন্তের গতি বর্তমান অবস্থার চেয়ে দ্রুততর এবং স্বচ্ছতর হবে বলে আশা করা যায়। মামলার তদন্তে দেরি হলে অভিযুক্ত ব্যক্তির জামিনের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা উচিত। সন্দেহের বশবর্তী হয়ে একজন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বিনা বিচারে দীর্ঘদিন বন্দী রাখা তার মৌলিক মানবাধিকারের প্রতি অবমাননা এবং অবিচার।
মামলা যথাযথভাবে নিষ্পত্তির জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তার তদন্ত রিপোর্ট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মামলার তদন্তকালীন পর্যায়ে অনৈতিক সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে একটি গুরুতর অপরাধকে লঘু করে দেওয়া কিংবা একটি লঘু মামলাকে গুরুতর করে দেওয়ার বিষয়টি জড়িত থাকে। সুতরাং, তদন্তকার্য পরিচালনার জন্য যদি একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন কর্তৃপক্ষ গঠন করা যায়- সেটি ন্যায়পরায়ণতা, স্বচ্ছতা ও দ্রুততার সাথে রিপোর্ট প্রদান তথা দ্রুত বিচার কার্য শেষ করার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
দণ্ডাবিধি ১৮৬০ এর ধারা ২১১, ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ এর ধারা ২৫০, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এর ধারা ১৭ কে আরও শক্তভাবে প্রয়োগ করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে আমাদের। মিথ্যা অভিযোগকারীকে যথাযথভাবে সাজা প্রদান করতে পারলে মিথ্যা বা হয়রানিমূলক মামলা অনেকাংশে কমে যাবে। অনেক মামলা বছরের পর বছর চলতে থাকে। ফলে, অভিযুক্ত ব্যক্তিকে মাথায় দুশ্চিন্তা নিয়ে জীবনের রোজকার দিনগুলি পার করতে হয়। একটি মিথ্যা মামলার অভিযোগকারীকে সাজা প্রদানের ক্ষেত্রে একজন অভিযুক্ত নিরপরাধ ব্যক্তির বন্দীত্ব, অর্থনৈতিক ক্ষতি, মানসিক দুশ্চিন্তা এবং তার পরিবারের সদস্যদের অসহায়ত্ব- সব কিছু বিবেচনায় আনতে হবে। মিথ্যা মামলায় একজন নির্দোষ ব্যক্তি ও তার পরিবারের যে পরিমাণ মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়, শুধু অর্থনৈতিক জরিমানা কিংবা নামমাত্র সাজা, সেই ক্ষতকে কখনই পূরণ করতে সক্ষম হয় না।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
ইমেইল: raihankawsardu@gmail.com