বাংলাদেশের রপ্তানিখাতে নিটওয়্যার ও তৈরি পোশাক শিল্পের অবদান অপরিসীম। এ সেক্টরের প্রতি সরকারেরও সুনজর ও সহানুভূতি বরাবরই ছিল এবং দেশের পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা সরকারের কাছে এ জন্য কৃতজ্ঞ।
১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকারই প্রথম এই খাতে নগদ সহায়তা চালু করে। শুরুতে ২৫ শতাংশ নগদ সহায়তা দেওয়ার ফলে এরইমধ্যে দেশের রপ্তানিমুখী পোশাক খাতে বিশেষ করে নিটওয়্যারের একটি শক্তিশালী পশ্চাৎ সংযোগ শিল্প গড়ে উঠেছে। এখন দেশেই তৈরি হচ্ছে বিশ্বমানের সূতাসহ আনুষঙ্গিক উপকরণ। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে জারিকৃত নগদ সহায়তা সংক্রান্ত সার্কুলারসমূহের অস্পষ্টতা ও সমন্বয়হীনতার কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক, অডিট ফার্ম, বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট, স্থানীয় ও রাজস্ব অডিট অধিদপ্তর ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানসমূহের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণ এ সংক্রান্ত সার্কুলারসমূহ নিজেদের মতো করে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা বা অপব্যাখ্যা প্রদান করায় নানাবিধ জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে (এফ ই সার্কুলার-০৯, ২০০১, এফই সার্কুলার-০৭, ২০০৩, এফই সার্কলার-১২, ২০১০ ইত্যাদি)।
২০০৩ সাল থেকেই সার্কুলারসমূহের জটিলতা ও অস্পষ্টতাসমূহ নিরসন করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা সম্বলিত বহু লেখা-লেখির পরও অজ্ঞাত কারণে তার অধিকাংশই আজও সমাধান হয়নি।
এফই সার্কুলার-০৯, ২০০১ এর ফরম খ' এর এক 'দ্বীয়' শব্দ অপসারণ করতেই লেগেছে ১৪ বছর; ২০১৭ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া এফই সার্কুলার ৩৫ এর মাধ্যমে একটি সংশোধনী দিয়ে ফরম খ' এর স্বীয় উৎপাদিত বস্ত্রমূল্য এর স্বীয়' শব্দটি বাদ দিলেও হেডিং এ রয়ে গিয়েছে ‘কম্পোজিট’ শব্দটি যা নিয়ে বিড়ম্বনার শেষ নেই। তাছাড়া ‘স্বীয়' শব্দটি বাদ দিলেও সেখানে নতুন করে অযৌক্তিক কিছু শর্ত জুড়ে দিয়ে আরও নতুন বিড়ম্বনা যোগ করা হয়েছে। ফলে নগদ সহায়তা পেতে চরম বিড়ম্বনা ও হয়রানির মাত্রা পূর্বের ন্যায় অব্যাহত রয়েছে রপ্তানিকারকদের এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ন্যায্য পাওনা থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছেন।
একইভাবে বিড়ম্বনা ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন ক্ষুদ্র-মাঝারী শিল্পের প্রণোদনা প্রাপক উদ্যোক্তারা। আর সার্কুলারসমূহের অস্পষ্টতার সুযোগ নিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন এর সাথে সম্পৃক্ত বিভিন্ন পক্ষ। এতে করে পুরো কারখানার পুঁজি এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ার ওপর একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। অথচ সরকার বরাবরই দেশের এক বিশাল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানসমৃদ্ধ রপ্তানি শিলপের প্রধান এ খাতের উত্তরোত্তর রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন ধরনের নীতিগত সহায়তা দিয়ে আসছে।
নিট ও তৈরি পোশাক শিল্পের অবদানের কথা বিবেচনায় রেখেই এবং দেশীয় পশ্চাৎ সংয়োগ শিল্পের বিকাশের স্বার্থে বিগত বহু বছর যাবতই বাজেটে দেশীয় সূতা ব্যবহারের বিপরীতে ৪ শতাংশ হারে (বাস্তবে যা সর্বোচ্চ ৩.২ শতাংশ) বিকল্প নগদ সহায়তাসহ অন্যান্য প্রণোদনা সুবিধা প্রদান অব্যাহত আছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সাথে কোন প্রকার আলোচনা ছাড়াই ২০১৭ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া এফই সার্কুলার ৩৫ নতুন করে আরও জটিলতা বাড়িয়ে দেয়। যদিও এই সার্কুলার জারির আগে ২০১৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর নগদ সহায়তা কেন্দ্রিক সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য তৎকালীন অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে বৈঠক করেছিলাম আমরা। বৈঠকের মূল উদ্দেশ্যই ছিল তৈরি পোশাক রপ্তানির বিপরীতে সরকার প্রদত্ত নগদ সহায়তা পরিশোধ সংক্রান্ত সার্কুলারগুলোর জটিলতা নিরসন।
সে সভায় উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী জনাব তোফায়েল আহমেদ (এমপি), অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর।
উক্ত সভায় বিকেএমইএ, বিজিএমইএ, বিটিএমএ ও ইএবি'র পক্ষ থেকে বস্ত্রখাতের নগদ সহায়তা পেতে বিভিন্ন সমস্যা, বিড়ম্বনা ও হয়রানির কথা তুলে ধরা হয় এবং সরাসরি প্রত্যাবাসিত এফওবি রপ্তানি মূল্যের ওপর নগদ সহায়তা প্রদানের দাবি জানানো হয়। সবকিছু শুনে মন্ত্রী মহোদয় সার্কুলারগুলোর জটিলতা দূর করে সহজীকরণ করার সিদ্ধান্ত দেন এবং সরাসরি প্রত্যাবাসিত রপ্তানি মূল্যের ওপর নগদ সহায়তা প্রদানের সম্ভাব্যতা যাচাই করার নির্দেশনা প্রদান করেন। কিন্তু বৈঠকের সূত্র ধরে, আমাদের সাথে কোনো প্রকার আলোচনা ছাড়াই গত ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭ এফই সার্কুলার-৩৫ জারি করা হয় যাহাতে সমস্যাসমূহ সমাধানের পরিবর্তে নতুন করে আরও জটিলতা তৈরি করা হয়েছে।
বস্ত্রমূল্য নির্ধারণের সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা:
বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মূদ্রা নীতি বিভাগের এফই সার্কুলার ০৯/২০০১ এ ২য় অনুচ্ছেদের (ক) এ বলা হয়েছে, ‘তন্তু হইতে সূতা ও পরবর্তী সকল পর্যায়ের উৎপাদন বাংলাদেশে সম্পাদিত হইয়াছে এরূপ রপ্তানির জন্যই কেবল বিকল্প নগদ সহায়তা সুবিধা প্রযোজ্য থাকিবে। কিন্তু বর্তমানে নগদ সহায়তা প্রাপ্যতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে হিসাবায়নের পদ্ধতিটি জটিল করে রাখা হয়েছে, যেমন- প্রত্যাবাসিত এফওবি মূল্য (প্রত্যাবাসিত মূল্য -ফ্রেইট চার্জ) এর ৮০ শতাংশ (মূল্য সংযোজনের ন্যূনতম মাত্রার (২০) বিয়োজনোত্তর অংক ১০০-২০=৮০ এবং প্রদর্শিত বস্ত্রমূল্য, এ দুটির মধ্যে যেটি কম দাঁড়াবে তার ৪ শতাংশ। আমরা ধরে নিই, এই হিসাবে প্রচলিত নগদ সহায়তা ১০০ এর ৮০ শতাংশ এর ৪ শতাংশ = সর্বোচ্চ ৩.২ শতাংশ পাওয়ার সুযোগ আছে। কোনো অবস্থাতেই এর বেশি পাওয়ার সুযোগ নেই। আর এখানে বস্ত্রমূল্য নির্ণয়ের সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা বা পদ্ধতি নেই এবং করাও কোনভাবেই সম্ভব নয়। কারণ কাপড়ের বিভিন্ন ধরনের ফ্যাশনেবল ডিজাইন ও গুণগত মানের তারতম্যের কারণে মূল্য নির্ধারণে বিভিন্ন পদ্ধতি বা প্যারামিটার অবলম্বন করতে হয় যা অত্যন্ত টেকনিক্যাল। যেমন- বস্ত্র তৈরিতে নিটিং চার্জ ও ডাইং চার্জের কোনো সীমানা নেই। কারণ বিভিন্ন ধরনের ফ্যাশন ও ডিজাইন এবং কাপড়ের গুণগত মানের তারতম্যের কারণে নিটিং চার্জ (প্রতি কেজি ১৫ থেকে ১৭০ টাকা) এবং ডাইং চার্জ (প্রতি কেজি ৫০ থেকে ৩৫০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে) বিভিন্ন হয়ে থাকে। যেটা নির্দিষ্ট ওই সেক্টরের টেকনিক্যাল ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কারও পক্ষে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। যে কারণে এফই সার্কুলার- ৭/২০০৩ এর ধারা-৪ এ নির্ধারিত ওই চালানে ব্যবহৃত বিভিন্ন কাঁচামালের মূল্যের সঠিকতার বিষয়ে স্বস্ব অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক প্রত্যায়ন পত্র প্রদানের বিধান থাকলেও তা অডিট ফার্মসমূহ বা অডিট কর্তৃপক্ষ আমলে নিচ্ছে না। আর সেখানেই যতসব জটিলতা।
বর্তমানে বিদ্যমান অন্যান্য সকল খাতের নগদ সহায়তা সরাসরি প্রত্যাবাসিত এফওবি মূল্যের উপর দেওয়া হলেও একমাত্র পোশাক খাতেই তা প্রদানের ক্ষেত্রে বস্ত্র মূল্যকে অথবা প্রত্যাবাসিত এফওবি মূল্যের ৮০ শতাংশ (মূল্য সংযোজনের ন্যূনতম মাত্রার বিয়োজনোত্তর অংক) কে আমলে নেওয়া হয়ে থাকে যা নির্ধারণ করা অত্যন্ত জটিল।
অন্যদিকে নগদ সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে অডিট সিস্টেম আরও একটি জটিল বিষয় এবং বিড়ম্বনার অপর নাম। কারণ অডিট ফার্ম সমূহের (বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়োজিত সিএ ফার্ম) অযৌক্তিক ও বিরক্তিকর চরম স্বেচ্ছাচারিতার কারণেই শিল্প মালিকদের নানাভাবে হয়রানি হতে হয় ও সার্টিফিকেট পেতে বিলম্বিত হয় এবং অনেক সময় নগদ সহায়তা প্রাপ্তিতে প্রচুর সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। আবেদনের মাধ্যমে নগদ সহায়তা পেতে ব্যাক টু ব্যাক এলসির মাধ্যমে দেশীয় সূতা ও বস্ত্র দ্বারা উৎপাদিত পণ্য রপ্তানির বিপরীতে মূল্য প্রত্যাবাসিত হওয়ার পর প্রচলিত পদ্ধতিতে এবং নির্ধারিত হারে আবেদন করা হয়েছে কিনা শুধু তাই বিবেচ্য, সেক্ষেত্রে অডিটের কোরো প্রয়োজন পড়ে না, কারণ এক্ষেত্রে ব্যাংকের কাছেই এ রপ্তানি সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় সব দালিলিক প্রমাণ রক্ষিত আছে, পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের এবং স্থানীয় ও রাজস্ব অডিট অধিদপ্তরের অডিটতো রয়েছেই। অথচ অডিটের কারণে নগদ সহায়তার সার্টিফিকেট পেতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৬ মাস থেকে ১ বছর বা তারও বেশি সময় লেগে যায়। এর পর সার্টিফিকেটসহ এই ক্লেইম বাংলাদেশ ব্যাংকে যাবার পর আরও ৬ থেকে ১২ মাস সময় লেগে যাচ্ছে। আবার নগদ সহায়তার উপর ৫ শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তন করা হচ্ছিল (১ জুলাই ২০২০ থেকে আবার ১০% হয়েছে) যা কোনভাবেই কাম্য নয়, কারণ এটা কোন ইনকাম নয়, এটা একটা ভর্তুকী, ভর্তুকীর উপর কোনভাবেই ট্যাক্স হতে পারে না।
বর্তমানে টিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত পোশাক খাতের উদ্যোক্তাগণ প্রতি তিন মাস অন্তর এ টাকাটার জন্য প্রহর গুনতে থাকে, আর টাকাটা পাওয়ার পর তা থেকে অনাদায়ী গ্যাস বিদ্যুৎ বিলসহ বিভিন্ন ধরনের দেনা মিটানো হয়ে থাকে। কারণ রপ্তানি বিল থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে কোনভাবেই উৎপাদন খরচের সকল দেনা পরিশোধ করা সম্ভব নয়। সেখানে কষ্টার্জিত এ টাকার একশত টাকা দিয়ে দশ টাকা নিয়ে গেলে তা বড়ই কষ্ট লাগে।
এমতাবস্থায় নগদ সহায়তা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে ইস্যুকৃত সার্কুলার সমূহের শব্দগত জটিলতা ও অস্পষ্টটতার অবসান ঘটিয়ে এবং উপরোক্ত সকল জটিলতা নিরসন করে অন্যান্য সকল খাতের মতো এ খাতেও সরাসরি প্রত্যাবাসিত এফওবি মূল্যের উপর নগদ সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থা সম্বলিত নতুন একটি মাস্টার সার্কুলার জারি করার যৌক্তিক দাবি জানাচ্ছি এবং অর্থমন্ত্রণালয়ের প্রতি বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি।
লেখক: ১ম সহ-সভাপতি, বিকেএমইএ এবং সিনিয়র সহ-সভাপতি, ইএবি
বাংলাদেশ সময়: ০১৩৯ ঘণ্টা, জুলাই ২৫, ২০২০