‘‘নমনীয় শক্তি’’ অভিব্যক্তিটিকে কোনো ধরনের অ-দমনমূলক উপায়ে একটি দেশের পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য এবং অগ্রাধিকারগুলিকে বাস্তবায়ন করার জন্য ব্যবহারযোগ্য একটি জাতীয় ক্ষমতা হিসেবে বোঝা যেতে পারে। দ্বিপক্ষীয় এবং বহুপক্ষীয় কূটনীতিতে বিস্তৃত ব্যাখ্যা দেয়ার দক্ষতা হওয়ার কারণে এটি নিজেই পররাষ্ট্রনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বা ‘‘অনমনীয় শক্তি’’ প্রয়োগের পরিপূরক হিসেবে অর্থাৎ সামরিক শক্তি বা অন্যান্য ধরনের বাধ্যতামূলক কূটনীতির পরিপূরক হিসেবে ভূমিকা পালন করে।
কোনো দেশের কূটনীতিকে বাস্তবায়িত করার জন্য সে দেশের "ধারণা" সম্পর্কে একটি সাধারণ "ব্র্যান্ডিং" বিভিন্নভাবে প্রকাশিত হয়। একটি সমীক্ষা অনুসারে, বিভিন্ন দেশগুলো শাসন, সংস্কৃতি, কূটনীতি, শিক্ষা এবং ব্যবসায় উদ্ভাবনের গুণাবলীর ওপর জোর দিয়ে তাদের অনমনীয় শক্তিকে সাজায়। এই সজ্জিতকরণের জন্য সরকারি এবং ব্যক্তিগত সম্পদের অভিনব ব্যবহার প্রয়োজন যাতে তা বৃহত্তর জাতীয় উদ্দেশ্য সাধন করতে পারে। কোমল কূটনৈতিক সরঞ্জামগুলোর কার্যকর ব্যবহার বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আজকের দিনে যেখানে বিভিন্ন অপশক্তি ও সামাজিক গোষ্ঠীগুলো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে চরমভাবে অপপ্রয়োগ করছে সেখানে এটি খুব একটা সহজ কাজ নয়।
ভারত একটি সংস্কৃতিগতভাবে বৈচিত্রময়, গণতান্ত্রিক দেশ এবং এর রয়েছে একটি বৃহত্তর সম্ভাবনাময় জনগোষ্ঠী যারা আর্থ-সামাজিক গতিশীলতা অনুসরণ করে। এ ধরনের একটি দেশ হিসেবে ভারতের ভাবমূর্তি এমন যে, একটি বন্ধুত্বপূর্ণ দেশ যা গণতন্ত্র, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, স্থিতিশীলতাকে সমর্থন করে এবং সাধারণ বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার কার্যকর উপায় হিসাবে বহুপক্ষীয়তার প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ে নিজের ক্রমবর্ধমান ভূমিকায় আত্মবিশ্বাসী একটি দেশ।
ভারত কোনো আক্রমণাত্মক, সংশোধনবাদী শক্তি নয় এবং এর ক্রমবর্ধমান সামরিক শক্তিকে কাছের এবং দূরবর্তী দেশগুলোর জন্য হুমকি হিসেবে দেখা হয় না।
গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে ভারতের হাজার বছরের সভ্যতা এবং বিকাশের গল্পটি বাস্তবিকভাবেই সারাবিশ্বে যথেষ্ট আগ্রহের উদ্রেক করে কারণ বেশিরভাগ দেশই তাদের নিজস্ব সমন্বিত, অন্তর্ভুক্তিমূলক অগ্রগতির সেরা নীতিটি বাছাই করতে গিয়ে কঠোর অভ্যন্তরীণ বিতর্কের সম্মুখীন হয়েছে। সভ্যতার গভীরতা এবং প্রাচীনতার কারণে প্রায় সমস্ত দেশের জন্যই ভারতের সঙ্গে যুক্ত হবার মতো কিছু না কিছু এবং একটি স্বস্তির স্তর (comfort level) খুঁজে পাওয়া সম্ভব। বিভিন্ন দেশের মধ্যে কৌশলগত অবিশ্বাস গভীরতর করার বিরাজমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে এই জাতীয় পরিস্থিতি আমাদের জাতীয় কৌশলগত লক্ষ্য বাস্তবায়নের একটি উল্লেখযোগ্য উপায়।
“অস্থির সময়ের” জন্য ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী মোদী একটি জনসভায় (জানুয়ারি ২০১৭) নিকট ও সম্প্রসারিত ভৌগলিকতা, অর্থনৈতিক অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সম্পর্কের নেটওয়ার্ক, বিশ্বব্যাপী সুযোগসমূহের সঙ্গে সংযোগকারী মানবসম্পদ শক্তি, বৈশ্বিক উন্নয়ন অংশীদারিত্ব এবং ভারতের সভ্যতা অধিকারের পাশাপাশি বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনর্গঠিত করার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছিলেন পররাষ্ট্রনীতির উদ্দেশ্য হিসেবে। স্থিতিশীল এবং ন্যায়সঙ্গত বৈশ্বিক শৃঙ্খলার এই বিস্তৃত দর্শনে যেমনটা প্রকাশিত হয়েছে, ভূ-রাজনৈতিক প্রবাহের সময়কালে দেশের কৌশলগত লক্ষ্যগুলো এগিয়ে নিতে বহুমুখীতার সন্ধান এই সৌম্য বৈশ্বিক ভাবমূর্তিকে প্রসারিত করার ক্ষেত্রে কোমল শক্তির জন্য অপরিহার্য ভূমিকা রাখে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অন্যান্য সরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা, উন্নয়ন প্রকল্প, দক্ষতা বৃদ্ধি, শিক্ষার্থীদের মতবিনিময় ও বৃত্তি, জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক, প্রশিক্ষণ কর্মসূচি, বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যকলাপ এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের (সৃজনশীল এবং পারফর্মিং আর্টস, প্রত্নতত্ত্ব, স্টাডি চেয়ার, শিক্ষা সম্মেলন ইত্যাদি) জন্য বিস্তৃত দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক কর্মসূচি পরিচালনা এবং সমন্বয়। এটি বিভিন্ন মাধ্যমের বিনিময় প্রচারে এবং বিদেশে ভারতের ভাবমূর্তি তুলে ধরতেও নিযুক্ত রয়েছে।
বিজ্ঞান, তথ্য ও সম্প্রচার, পর্যটন, ক্রীড়া, স্বাস্থ্য, আবহাওয়া, নৌপরিবহন, ফিন্যান্স এবং ব্যাংকিং, বিভিন্ন সংযোগের অবকাঠামোগত প্রকল্প, ইত্যাদি বিভাগ এবং সংস্থাগুলোর নিজস্ব ক্ষেত্রে তাদের নিজেদের সহযোগী প্রকল্প রয়েছে। ভারতের দু’টি প্রধান বহুমুখী উদ্যোগ হল আন্তর্জাতিক সৌর জোট এবং দুর্যোগ প্রতিরোধ অবকাঠামো জোট। এমনকি সশস্ত্র বাহিনীর মতো "হার্ড কোর" এজেন্সিগুলো মানবিক ও দুর্যোগ প্রতিক্রিয়ামূলক অভিযান পরিচালনা করে এবং ভারতীয় উপকূল থেকে দূরে দুর্যোগপূর্ণ অঞ্চলে অন্যান্য দেশের নাগরিকদের সরিয়ে নেয়। এই কার্যক্রমগুলো প্রধানমন্ত্রী তার উপরোক্ত বক্তৃতায় এবং আরও অনেক কিছুতে অগ্রাধিকার দিয়েছেন।
মোট কথা, কোমল শক্তি প্রয়োগের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এই বার্তা দেওয়া দরকার যে ভারত কীভাবে প্রাণচঞ্চল রয়েছে। এটি এমন একটি দেশের গল্প, যা ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতালাভের সময়কালের একটি দরিদ্র, সামাজিকভাবে অসম দেশ থেকে আজকে একটি সাংবিধানিক গণতন্ত্রের অবিচল প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে একটি বড় ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-অর্থনৈতিক দেশে পরিণত হওয়ার সফল যাত্রা শেষ করেছে। এটি এমন লোকদের সম্পর্কে যারা তাদের সভ্যতাগত ভিত্তিতে যথেষ্ট "আত্মবিশ্বাসী" এবং তাদের "বিদেশি" ধারণা থেকে আলাদা করার দরকার নেই। ভারতের ইমেজকে বোঝার জন্য এটি একটি সামগ্রিক আখ্যান যা প্রধানমন্ত্রীর নির্ধারিত পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য ব্যবহার করতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১১০৭ ঘণ্টা, আগস্ট ১৫, ২০২০