ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

প্রণব মুখার্জিকে মনে রাখবে বাংলাদেশ

তপন চক্রবর্তী, ডেপুটি এডিটর  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৫, ২০২০
প্রণব মুখার্জিকে মনে রাখবে বাংলাদেশ

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার পেছনে ছিল তার ভূমিকা। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিবার নিয়ে দিল্লিতে থাকার সময়ও তিনি দেখভাল করেছেন, সব বিষয়ে করেছেন সহযোগিতা।

ইতিহাস, রাজনীতি বিজ্ঞান ও আইনে স্নাতকোত্তর শেষ করে কলেজে শিক্ষকতা এবং পরে সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু। কংগ্রেসের রাজনীতিতে যোগ দিয়ে ১৯৮২ সালে হলেন অর্থমন্ত্রী। তিনিই প্রণব মুখার্জি। পাঁচ দশকের রাজনীতির পথ পাড়ি দিয়ে ২০১২ সালে হয়েছিলেন ভারতের ১৩তম রাষ্ট্রপতি।

১৯৯৬ সালে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে গঙ্গার পানি চুক্তিতে নানা পরামর্শ দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ সরকারকে সাহায্য করেছিলেন প্রণব মুখার্জি। এক-এগারোর সরকারের সময় যখন শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করা হয়, মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানির চেষ্টা করা হয়, সেই সময় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার মুক্তির জন্য কাজ করেছেন প্রণব মুখার্জি। পদ্মা সেতুর টেন্ডার প্রক্রিয়া নিয়ে বিশ্বব্যাংকের অহেতুক আপত্তির কারণে থমকে যাওয়া কাজ শুরু করতে বাংলাদেশের উদ্যোগকে সমর্থনও দিয়েছিলেন তিনি।  

বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বরাবরই সুদৃঢ় রাখার পক্ষে ছিলেন তিনি। দীর্ঘকাল অর্থ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চালিয়েছেন। সে কারণে বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতীয় নীতিতেও তার ভূমিকা ছিল। শ্বশুরবাড়ি বাংলাদেশে। দুই পুত্র ও এক কন্যার জনক প্রণব মুখার্জির স্ত্রী প্রয়াত শুভ্রা মুখার্জি  নড়াইলের মেয়ে। ১৯৯৬ সালে কন্যা শর্মিষ্ঠা মুখার্জিকে নিয়ে শেষবারের মতো নড়াইলের গ্রামে বেড়াতে এসেছিলেন প্রণব মুখার্জি।  

২০১৩ সালের ৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সাম্মানিক ডক্টরেট অব ল ডিগ্রি দেয়, ৫ মার্চ তিনি বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ পান।

২০১৮  সালের ১৬ জানুয়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট (ডিলিট) ডিগ্রি দেয়। চট্টগ্রামে এসে তিনি বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেনের জন্মস্থান পরিদর্শনে রাউজান যান। সেখানে মাস্টারদার আবক্ষমূর্তিতে শ্রদ্ধা জানান। তিনি মাস্টারদা সূর্য সেন স্মৃতি ভবনে গিয়ে সূর্য সেন স্মৃতিপাঠাগার উদ্বোধন ও সেখানে রক্ষিত স্মারক খাতায় তার অনুভূতি লেখেন।

রেডিসন ব্লু  চিটাগাং বে ভিউ হোটেলে সুধী সমাবেশে তার হাতে চট্টগ্রাম নগরের চাবি তুলে দেন তৎকালীন সিটি মেয়র। সুধী সমাবেশে প্রণব মুখার্জি প্রীতিলতা ট্রাস্টের কর্মকর্তাদের কাছে ৬ লাখ ২৮ হাজার টাকার চেক তুলে দেন।  

ওই সমাবেশে প্রণব মুখার্জি বলেছিলেন, ‘ভারতবর্ষ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে চট্টগ্রামের অনন্য ভূমিকা ছিল। চট্টগ্রামে না এলে অপূর্ণতা থেকে যেত। বাংলাদেশে অনেকবার এসেছি। কিন্তু চট্টগ্রামে আসার সুযোগ হয়নি। অথচ চট্টগ্রাম না দেখলে বাংলাদেশে আসা সম্পূর্ণ হয় না। ’

তিনি বলেছিলেন, চট্টগ্রাম বাংলাদেশের প্রধান বন্দর বলেই নয়, এই শহরের অন্য গুরুত্বও আছে। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে এখানকার মানুষের যেমন বিপুল ভূমিকা ছিল। ঠিক তেমনি বাংলাদেশকে স্বাধীন করার ক্ষেত্রেও চট্টগ্রাম এগিয়ে ছিল। সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে স্বাধীন বাংলাদেশের বার্তা পৌঁছে দিয়েছিল চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণাও পৃথিবীর মানুষের নজরে এনেছিলেন এই বেতারকেন্দ্রের কর্মীরা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবরই প্রণব মুখার্জিকে তার একজন পারিবারিক অভিভাবক হিসেবে বর্ণনা করেছেন। বলেছেন, তিনি (প্রণব মুখার্জি) সবসময় পাশে দাঁড়িয়েছেন, তাকে আমরা সবসময় পাশে পেয়েছি। শুধু ভারতে না, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও তার একটা অবস্থান ছিল এবং আমাদের পাশে সবসময় ছিলেন; এটাই হলো বড় কথা। তিনি খুব প্রাজ্ঞ একজন রাজনীতিবিদ, সবকিছুতেই একটা দূরদর্শী চিন্তা ছিল।

নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা আটটি বইয়েও ঘটেছে তার চিন্তার প্রতিফলন। ২০১৭ সালে প্রকাশিত বইয়ে বাংলাদেশে ২০০৮ সালের সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়কালে শেখ হাসিনার মুক্তি এবং বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার পেছনের ভূমিকা উঠে আসে।  

তার আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ডে লিখেছেন, ‘১৫ জুনের (১৯৭১) বাজেট অধিবেশনে আমি রাজ্যসভায় বললাম, ভারতের উচিত বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেওয়া। এর জন্য বাংলাদেশের নির্বাচিত মুজিবনগর সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হোক, বলেছিলাম। আমি রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলছি। বলছি, সার্বভৌম গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা। এই রাজনৈতিক সমাধানের সূচক হিসাবে আমি বলেছিলাম, বাংলাদেশকে জিনিসপত্র দিয়ে সাহায্যের কথা, সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বার্থে। ’

বাংলাদেশের সঙ্গে ১৯৭১ থেকে শুরু হওয়া সম্পর্কটা রয়েই গেল মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্তই। এই সম্পর্কের সূত্র ধরেই প্রকৃত বন্ধু হিসেবে প্রণব মুখার্জিকে মনে রাখবে বাংলাদেশ।

লেখক: সাংবাদিক

বাংলাদেশ সময়: ১৮৩০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৫, ২০২০
টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।