বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট ধারণা না পাওয়ায় একজন ব্লগার আক্ষেপের সঙ্গে বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে নিম্নরূপ প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন-
‘বাংলাদেশে অনেক বুদ্ধিজীবী। অমুক বুদ্ধিজীবী, তমুক বুদ্ধিজীবী।
০ বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা কী বা বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী বলতে কী বোঝায়?
০ বুদ্ধিজীবী হতে কী কী যোগ্যতা লাগে?
০ একবার বুদ্ধিজীবী হলে কত দিন থাকা যায় বা মেয়াদ কত?
০ একটা দেশে ন্যূন্যতম সর্বোচ্চ কতজন বুদ্ধিজীবী দরকার হয়?
০ বুদ্ধিজীবী হলে কী কী সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়? ইত্যাদি ইত্যাদি…’
বাংলাদেশে ‘বুদ্ধিজীবী’ ধারণাটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত অভিধান ও শহীদ বুদ্ধিজীবীকোষ এবং বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ― এ প্রকাশিত সংজ্ঞায় নানাভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত অভিধানে বুদ্ধজীবী বলতে তাদেরকে বোঝানো হয়েছে― “যারা সমাজ ও সংস্কৃতি সচেতন এবং জ্ঞান বিজ্ঞানে দক্ষ সুশিক্ষিত মানুষ, যারা বুদ্ধির বলে বা বুদ্ধির কাজ দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। ”
আবার বাংলা একাডেমি প্রকাশিত শহীদ বুদ্ধিজীবীকোষ গ্রন্থে বুদ্ধিজীবীদেরকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে তাহলো― “বুদ্ধিজীবী অর্থ লেখক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পি, কণ্ঠশিল্পী, সকল পর্যায়ের শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, রাজনীতিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, চলচ্চিত্র ও নাটকের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, সমাজসেবী ও সংস্কৃতিসেবী। যারা দেশের স্বাধীনতাকে ভিত্তি করে দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য তাদের বিচার, বুদ্ধি ও বিচক্ষণতা দিয়ে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে কাজ করে। ”
অন্যদিকে বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞান কোষে (২০১৫)― “সামাজিক ও রাষ্ট্রিক সঙ্কটকালে বৌদ্ধিক পরামর্শ দানের মাধ্যমে যথার্থ দিকনির্দেশকারী পণ্ডিতকে বুদ্ধিজীবী বলে বিবৃত করা হয়েছে। ”
বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে উক্ত দেশজ সংজ্ঞাগুলোতে বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ব্যাপক বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তিকে বুদ্ধিজীবী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে এ সংজ্ঞাগুলোতে বুদ্ধিজীবী নির্ধারণের মাপকাঠিটি স্পষ্ট নয়।
বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ (২০১৫)-এ মুদ্রিত নাজিয়া খানম কর্তৃক রচিত ‘বুদ্ধিজীবী’ শীর্ষক টীকায় বৌদ্ধ রাজ শাসন থেকে শুরু করে হিন্দু রাজ শাসন, তুর্কো-মুঘল ইসলামি রাজ শাসন, ১৭৫৭ সাল থেকে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসন, ১৯৪৭ সাল থেকে পাকিস্তানি সেনা শাসন এবং ১৯৭১ সাল থেকে দেশীয় রাজনৈতিক ও সেনা শাসনামলে বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের কালক্রমিক বিকাশ ও বিভিন্ন যুগে তাদের ভূমিকা নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এই টীকায় টীকাকার আদিকাল থেকে শুরু করে মুসলিম শাসনের পতনকাল পর্যন্ত ধর্ম গুরু ও ধর্মনেতাদের ভূমিকা ও রাজ শাসন কাজ পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত দক্ষ কুশলীদের ভূমিকা নিয়ে আলোকপাত করেছেন। তিনি টীকায়― সমাজের সংহতি রক্ষা, সমাজ পরিচালনা ও সামাজিক উন্নয়নে নিয়োজিত বিদ্বৎসমাজকে বুদ্ধিজীবী হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। রচনায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকে ধর্মীয় কারণে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে বিভক্তি এবং ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির জন্য স্বাধিকার আন্দোলন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা নিয়ে আলোকপাত করেছেন। এই দুই যুগে স্বাধিকার আন্দোলনের সাথে যুক্ত বুদ্ধিজীবীগণকে সংগ্রামী ঘরাণার বুদ্ধিজীবী হিসাবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে।
পূর্বকালে বুদ্ধিজীবীদের বুঝাতে শিক্ষিত, বিদ্বান ও জ্ঞানদীপ্তদের বোঝানো হতো। সে সময় বুদ্ধিজীবী বলতে কেবলই প্রথাগত বুদ্ধিজীবীদের বোঝানো হতো, যারা সমাজের সংহতি রক্ষা, সমাজ পরিচালনা ও সামাজিক উন্নয়নে নিয়োজিত ছিল। তখন প্রথাগত বুদ্ধিজীবীরা কোন না কোন ধর্মীয় গোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত ছিল। তারা হিন্দু, মুসলমান ও বৌদ্ধ- এই তিন ধর্মে যথাক্রমে পণ্ডিত, মওলানা ও ভিক্ষু বলে অভিহিত ছিল। আর রাজ শাসনাধীন এই প্রথাগত বুদ্ধিজীবীরা রাজকার্য পরিচালনার সাথে যুক্ত ছিল।
বাংলায় ইউরোপের জ্ঞানদীপ্তির প্রভাব শুরু হলে বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবীদের প্রতি নতুন সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ যুক্ত হতে শুরু করে। ইউরোপে যখন জ্ঞানদীপ্তি বা রেনেসাঁ শুরু হয় তখন বিদ্বৎসমাজ ধর্মীয় ও প্রথাগত নিয়ম-কানুনের পরিবর্তে যুক্তি ও মুক্তচিন্তার মাধ্যমে জাগতিক বিষয়সমূহ বিশ্লেষণে প্রয়াসী হয়। ফলশ্রুতিতে বিশ্বজুড়ে দেশে দেশে প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম শুরু হয়। তখন মানুষ বুঝতে পারে যে, বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের অধীনে শাসন আর নিয়তি নয়, এটি কেবলই জবরদস্তি। ইংরেজরা ইউরোপ মহাদেশের বাসিন্দা হওয়ার ফলে জ্ঞানদীপ্তির প্রভাব তাদের সমাজে আগে থেকেই প্রতিফলিত হয়েছিল। তারা ব্রিটিশ ভারত উপনিবেশকে করায়ত্ত করতে গিয়ে, তাদের প্রশাসন পরিচালনায় দক্ষ ইংরেজি শিক্ষিত সহযোগী শ্রেণী সৃষ্টির পরিকল্পনা হাতে নেয়। সেজন্য তারা কলকাতা মাদ্রাসা (১৭৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত), প্রেসিডেন্সি কলেজ (পূর্বতন হিন্দু কলেজ, ১৮১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত), ক্যালকাটা স্কুল-বুক সোসাইটি (১৮১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত), কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ (১৮৩৫ সালে প্রতিষ্ঠিত) ও বহু জ্ঞানীয় ধারাসম্পন্ন ও ধর্মনিরপেক্ষ পাশ্চাত্য ঘরানার বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (১৮৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত) প্রতিষ্ঠা করে। এ ছাড়া স্থানীয় জ্ঞান সম্পদে নিজেদের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করার জন্য ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ (১৭৮১ সাল) ও এশিয়াটিক সোসাইটি (১৭৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত)-এর মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। অধিকন্তু তারা আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া (১৮৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত) ও লিঙ্গু্ইস্টিক সার্ভে অব ইন্ডিয়ার (১৮৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত) মতো প্রকল্প হাতে নেয়।
ইংরেজ শাসন পাকাপোক্ত করার প্রয়োজনে ইংরেজদের কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এ সমস্ত প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পে এ দেশের জনগণ কাজ করার সুযোগ পায়। এর ফলে দেশীয় বিদ্বৎসমাজ পাশ্চাত্য ধারার ধর্মনিরপেক্ষ জ্ঞানের সাথে পরিচিত হতে শুরু করে। দেশে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাশ্চাত্য ধারার শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে অনেকে বিলাতে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পায়। ফলশ্রতিতে তৎকালীন বিদ্বৎসমাজের জ্ঞানীয় জগতে এক বিপ্লবের সূচনা হয়। সে সময় ইউরোপের বিদ্বৎজনদের মতো এ দেশের বিদ্বৎজনরাও যুক্তি ও মুক্তচিন্তার আলোকে জৈবনিক ও জাগতিক বিষয় ও বিষয়বস্তুকে পর্যবেক্ষণে প্রয়াসী হয়। এর ফলে স্থানীয় বিদ্বৎসমাজ নানামুখী বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়। বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের এই বিপ্লবকে ‘বাংলার নবজাগরণ’ হিসাবে অভিহিত করা হয়। মূলত রাজা রামমোহন রায়ের (১৭৭৫-১৮৩৩) জীবৎকালীন সময় থেকে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) জীবৎকালীন সময়কে ধরা হয় নবজাগরণের সময়কাল। বাংলার নবজাগরণের এ সময়কালে সৃষ্টি হয় আধুনিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ অনেক কৃতি মনিষীর এবং বিদ্বৎসমাজের। এছাড়া এই সময় বেশকিছু সামাজিক (যেমন-সতীদাহ প্রথা বিলোপের আন্দোলন) ও ধর্মীয় আন্দোলন (যেমন-ব্রাহ্মসমাজ ও রামকৃষ্ণ মিশন)-এরও সূচনা হয়।
নবজাগরণের জোয়ারে সাহিত্য ও সংস্কৃতি পরিমণ্ডলে যেসব মনীষী সৃষ্টি হয়েছেন তারা হলেন- রামমোহন রায়, অক্ষয় কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। বিজ্ঞান, ইতিহাস ও দর্শনের পরিমণ্ডলে যেসব মনীষী সৃষ্টি হয়েছেন তারা হলেন- জগদীশ চন্দ্র বসু, প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, রাজেন্দ্র লাল মিত্র, রমেশ চন্দ্র দত্ত, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কৃষ্ণ কমল ভট্টাচার্য্য। ধর্মীয় পরিমণ্ডলে যেসব মনীষী সৃষ্টি হয়েছেন তারা হলেন- স্বামী বিবেকানন্দ এবং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। উপরের মনিষীদের তালিকায় লক্ষণীয় যে বাংলার নবজাগরণ বাংলার হিন্দু সমাজকে যতোটুকু প্রভাবিত করে, মুসলমান সমাজকে ততটুকু প্রভাবিত করতে পারেনি।
বাংলার নবজাগরণের প্রভাব মুসলমান সমাজের মধ্যে কিছুটা পরিলক্ষিত হয় বঙ্গভঙ্গের পর ঢাকায় বাংলা ও আসামের রাজধানী স্থাপনের পর, যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা (১৯২১ সাল) হয় এবং মুসলমানদের নেতৃত্বে গণজাগরণী সংগঠন, যেমন-মুসলিম সাহিত্য সমাজ (১৯২৭ সালে প্রতিষ্ঠিত) সৃষ্টি হয়। কাজেই বাংলার এই নবজাগরণের প্রভাবে হিন্দুদের মধ্যে বুদ্ধিজীবী শ্রেণী সৃষ্টি হলেও, মুসলমানদের তেমন কোন বুদ্ধিজীবী শ্রেণী সৃষ্টি হতে দেখা যায়নি। দেশের জ্ঞানসম্পদ ও সাংস্কৃতিক সম্পদ সৃজনে সবচেয়ে যাদের অবদান সে ধরনের তেমন কোনো বুদ্ধিজীবী শ্রেণী সৃষ্টি হয়নি। কাজেই ব্রিটিশ ইন্ডিয়া ভেঙে পাকিস্তান সৃষ্টির পর মূলত: উপন্যাস, নাটক, প্রহসন, কাব্য, গীতিনাট্য ও প্রবন্ধ-সাহিত্য রচয়িতাগণ বুদ্ধিজীবী হিসাবে খ্যাত হন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন: কায়কোবাদ (১৮৫৭- ১৯৫১), আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ (১৮৭১-১৯৫৩) ও মওলানা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী (১৮৭৫-১৯৫০)।
পরবর্তী পর্যায়ে যারা বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত হন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- এস ওয়াজেদ আলী (১৮৯০-১৯৫১), ইব্রাহীম খাঁ (১৮৯৪-১৯৭৮), নুরুন্নিসা খাতুন বিদ্যা বিনোদিনী (১৮৯৪-১৯৭৫), শেখ মুহম্মদ ইদরিস আলী (১৮৯৫-১৯৪৫), আবুল কালাম শামসুদ্দীন (১৮৯৭-১৯৭৮), আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৮-১৯৭৯), বেনজীর আহমদ (১৯০৩- ১৯৮৩), আবুল ফজল (১৯০৩-১৯৮৩), মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন (১৯০৪-১৯৮৭), আবদুল কাদির (১৯০৬-১৯৮৪), বন্দেআলী মিয়া (১৯০৬-১৯৭৯), মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা (১৯০৬-১৯৭৭), হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরী (১৯০৬-১৯৬৬), মুহম্মদ এনামুল হক (১৯০৬-১৯৮২) ও বেগম সুফিয়া কামাল (১৯১১-১৯৯৯) প্রমুখ।
তাদের মধ্যে কেউ কেউ, যেমন- কাজী আবদুল ওদুদ (১৮৯৪-১৯৭০) ও আবুল ফজল (১৯০৩-১৯৮৩), গোলাম মোস্তফা (১৮৯৭-১৯৬৪) ও জসীমউদ্দীন (১৯০৩-১৯৭৬) শিক্ষাপ্রাতিষ্ঠানিক পেশার সাথে যুক্ত ছিলেন। সামাজিক ভূমিকায় অবতীর্ণ শিক্ষাপ্রাতিষ্ঠানিক বুদ্ধিজীবী বলতে যাদেরকে বোঝায়, তারা ছিলেন হাতে গোণা কয়েকজন, যেমন- কাজী মোতাহার হোসেন (১৮৯৭-১৯৮১), মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ (১৮৮৫-১৯৬৯) ও মুহম্মদ কুদরাত-এ-খুদা (১৯০০-১৯৭৭)।
নবজাগরণের যুগে সৃষ্ট মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশই ইসলামী ভাবাপন্ন ছিলেন। তাদের কেউ কেউ ধর্মনিরপেক্ষ হলেও, পরবর্তীকালে দেশবিভাগকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক বিভেদ শুরু হলে সবাই ইসলামি ভাবাপন্ন বুদ্ধিজীবীতে পরিণত হন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টি হলে মুসলমান অভিজাতবর্গের (পশ্চিম পাকিস্তানে যাদের অধিকাংশ ছিলো ভারত থেকে প্রত্যাবাসিত) নেতৃত্বে সামন্ততান্ত্রিক-সামরিক-ইসলামী পাকিস্তান গঠনের সূত্রপাত হয়, যার প্রতিক্রিয়ায় বাংলা ভাষী পাকিস্তানীদের মধ্যে সাম্যতাভিত্তিক গণতান্ত্রিক চেতনা দানা বাঁধে। এই চেতনা সৃষ্টির ফলে ইতোপূর্বে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের মধ্যে বিপ্লবের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে বুদ্ধিজীবী ধারণাটির প্রতি নতুন সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ যুক্ত হতে শুরু করে।
সে সময় মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজ দু’টি ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। একটি ধারা যার অনুসারী ছিলেন কবি গোলাম মোস্তফা, সৈয়দ আলী আহসান, কাজী দীন মোহাম্মদ ও মীর ফখরুজ্জামান প্রমুখ।
পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে দেশের উন্নয়নের পক্ষে তারা বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ড প্রয়োগে প্রয়াসী হন। অন্য একটি ধারার অনুসারীগণ পাকিস্তানের রাজনৈতিক কাঠামোকে ভেঙে একটি উদার, গণতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী রাষ্ট্র কায়েমের জন্য তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডকে বিনিয়োগে সচেষ্ট হন। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষের বর্ণনা অনুযায়ী এই শ্রেণীর অর্ন্তভূক্ত ছিলেন লেখক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, কণ্ঠশিল্পী, সকল পর্যায়ের শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, রাজনীতিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, চলচ্চিত্র ও নাটকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, সমাজসেবী ও সংস্কৃতিসেবী।
কালের বিবর্তনের প্রথম ধারার বুদ্ধিজীবিগণ পাকিস্তানপন্থী বু্দ্ধিজীবি হিসাবে খ্যাত হলেও, দ্বিতীয় ধারার বুদ্ধিজীবিগণ শুধুমাত্র বুদ্ধিজীবি হিসাবে পরিচিত হন। কবি, লেখক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পি, কন্ঠশিল্পি, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, রাজনীতিক, আইনজীবি, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, নাটকের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, সমাজসেবী ও সংস্কৃতি সেবীদের মধ্যে থেকে যাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে কিছু লিখেন, বক্তৃতা দেন ও প্রচারণা করেন তারাই এই দ্বিতীয় ধারার বুদ্ধিজীবী হিসাবে পরিচিত হতে থাকেন। কার্যত: এ শ্রেণীতে অর্ন্তভূক্ত হন-উদারপন্থী, গণতন্ত্রপন্থী থেকে শুরু করে মানবতাবাদী, সাম্যবাদী ও কমিউনিষ্ট পন্থীগণ। বুদ্ধিজীবী বলে যারা পরিচিত হন, তাদের মধ্যে অতিবিপ্লবী (যেমন-সিরাজুল আলম খান), কমিউনিষ্ট (যেমন-ফয়েজ আহমেদ) ও নাস্তিকরাও (যেমন- আহমদ শরীফ ও হূমায়ূন আজাদ) ছিলেন। সেজন্য বুদ্ধিজীবী ধারণাটির সাথে নাস্তিকতা অনুষঙ্গটিও যুক্ত হয়ে পড়ে।
১৯৭৫ সালে রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে বুদ্ধিজীবীদের দু’টি ধারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যখন ইসলামী আবহযুক্ত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ এবং স্থানীয় সাংস্কৃতিক আবহযুক্ত বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রশ্নে বুদ্ধিজীবীগণের মধ্যে মেরুকরণ ঘটে। এরপর থেকে পূর্বতন দল ডানপন্থী বুদ্ধিজীবি ও অন্য দল বামপন্থী বুদ্ধিজীবি হিসাবে খ্যাত হতে থাকে। এরূপে স্বাধীনতা আন্দোলনে ভূমিকার জন্য যারা বিপ্লবী বুদ্ধীজীবী হিসাবে খ্যাত হন, তারাই ডানপন্থী বা বামপন্থী বুদ্ধিজীবী হিসাবে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীন দলের সাথে লেজুড়বৃত্তি করার জন্য সমালোচিত হতে থাকেন। এভাবে বুদ্ধিজীবী ধারণাটি দ্বারা যে মহিমা প্রকাশ পায় তা ক্রমান্বয়ে স্তিমিত হতে থাকে।
বর্তমানে ইসলামী আবহযুক্ত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী জনগণ বুদ্ধিজীবী ধারণাটিকে নেতিবাচক অর্থে ব্যবহার করে থাকেন। তাদের মতে― উদারনৈতিক, গণতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী সমাজের কথা বলেন, তা ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম হলে বাস্তবায়ন সম্ভব। কাজেই বাংলাদেশে বর্তমানে বুদ্ধিজীবী শ্রেণীটির সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা নাই। ইসলামী আবহযুক্ত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী জনগণ বুদ্ধিজীবী ধারণাটিকে এখন নেতিবাচক অর্থে ব্যবহার করে থাকে।
বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষা-গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলিতে বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে আছে। দেশে শতশত বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণামূকল প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও, সামাজিক ভূমিকায় অবতীর্ণ একাডেমিক বুদ্ধিজীবী সৃষ্টি হচ্ছে না, যা দেশ ও জাতির বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডে তমসাছন্নতাকেই প্রকাশ করে। বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের তমসাছন্নতার এ যুগে বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার দু’টি ধারা সৃষ্টি হয়েছে। একটি ধারা হলো সুশীল সমাজের অনুসারী ধারা যারা রাষ্ট্র ক্ষমতার এপিঠ বা ওপিঠে অবস্থান করেন। আবার আরেকটি ধারা রয়েছে যারা সমাজ বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, পরিবেশ, নারীবাদ ও ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে ইউরোপীয় চিন্তা-কাঠামোতে নানা ইস্যু নিয়ে আলোচনা ও পর্যালোচনা করেন। এমতাবস্থায় মুক্ত বুদ্ধিবৃত্তি চর্চাকারীরা মূলত: ব্লগে তাদের চিন্তাধারণা প্রকাশ করে থাকেন। তাদের বিচরণ ক্ষেত্র ঢাকা শহরের আজিজ সুপার মার্কেটের আশেপাশে বলে প্রতিভাত হলেও, এ ধরণের মুক্তবুদ্ধি চর্চাকারীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। তাদের অনেককেই এখন নাস্তিকতার অপবাদ মাথায় নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তি চর্চা করে থাকেন। যৌক্তিক ও বৌদ্ধিক আলোচনায় তারা খুবই সংযত। কেননা তারা জানেন যে উগ্র ইসলামপন্থীদের কালো তালিকায় নাস্তিক ও মুরতাদ বলে তালিকাভূক্ত হলে তাদের আর রক্ষা নাই।
লেখক: অধ্যাপক, জাপানিজ ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়