চীনের উহান শহর থেকে করোনা ভাইরাস দ্রুত বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার সময়ে জনস্বাস্থ্যবিদ ও বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন, মহামারির ইতি টানতে বিশ্বের দরকার নতুন টিকা। ইতিহাসের দ্রুততম সময়ে টিকা উদ্ভাবনের খবর আসতে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্র অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোটি কোটি ডোজ মজুদ রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো কানাডা, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছেও টিকার বাড়তি মজুত আছে। কিছু ধনী দেশ তাদের প্রয়োজনের তুলনায় ৩ থেকে ৯ গুণ পর্যন্ত বেশি টিকা কেনার চুক্তি করতে পেরেছে। টিকার বৈশ্বিক জোটের হিসাবে সম্ভাব্য উৎপাদনের অর্ধেকের বেশি ধনী দেশ তাদের নাগরিকদের জন্য কিনে নিয়েছে। অথচ ওই দেশগুলোর নাগরিকসংখ্যা বিশ্ব জনসংখ্যার মাত্র ১৪ শতাংশ!
জুলাইয়ের আগে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট প্রতিবেশি কোনো দেশকে কোনো টিকা সরবরাহ করতে পারবে না। টিকার ঘাটতির কারণে দিল্লিসহ বহু জায়গায় প্রতিবেশি দেশটি টিকাদান কর্মসূচি স্থগিত করেছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশসমূহে অব্যবহৃত টিকা উৎপাদন কেন্দ্রের খোঁজ করছে যেখানে ভারত নিজেদের জন্য টিকা উৎপাদন করবে। সংকট সামাল দিতে দিশেহারা ভারত সরকার টিকা রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। আমাদের জন্য এ সিদ্ধান্ত একটা দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। ১৩–১৪ লাখ মানুষের দ্বিতীয় ডোজ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
শুধু বাংলাদেশই টিকা নিয়ে এ সমস্যার সম্মুখীন হয়নি। আমেরিকা মহাদেশেও টিকা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কানাডা, মেক্সিকোসহ প্রতিবেশীদের মধ্যে রাজনৈতিক অস্বস্তি দেখা গেছে। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা পেতে আইনী লড়াইয়ে নেমেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
করোনার টিকাকে বৈশ্বিক গণপণ্য হিসেবে বিবেচনা করে ইউনেস্কো ফেব্রুয়ারি মাসে আইএমএফকে সদস্য রাষ্ট্রসমূহের জন্য অর্থছাড়করণের আহবান জানিয়েছে। ২০ এপ্রিল করোনা ভাইরাসের টিকাকে 'বৈশ্বিক গণপণ্য' হিসেবে ঘোষণা করা উচিত বলে আন্তর্জাতিক এক সম্মেলনে মন্তব্য করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, গ্যাভি এবং সংশ্লিষ্ট অন্য সংস্থাগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বিশ্বে প্রতিবছর ফ্লু ও হামের মতো নানা রোগের প্রতিষেধক টিকা তৈরি হয় ৪০০ কোটি ডোজ। কোভিডের কারণে এখন বিশ্বে প্রয়োজন হচ্ছে অতিরিক্ত ১ হাজার ৪০০ কোটি ডোজ টিকা। মেধাস্বত্ব ছাড় দিলে উৎপাদন বাড়বে। ২০২০ সালের মে মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিড-১৯ মোকাবিলার জন্য সব দেশের প্রতি স্বেচ্ছায় জ্ঞান, মেধাসম্পদ, প্রযুক্তি এবং তথ্য-উপাত্ত ভাগাভাগি করে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল।
ইতোমধ্যে গ্লোবাল জাস্টিস, ১৭০টি দেশের রাষ্ট্র/সরকারপ্রধান, নোবেল বিজয়ী ব্যক্তিগণ ও নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলী কোভিড-১৯-এর টিকার মেধাস্বত্বের অব্যাহতি দেওয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট বাইডেনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। বিশ্ব যে শিগগিরই এ মহামারি থেকে মুক্তি পাবে, এমন সম্ভাবনা নেই। রোগ নিরাময়ে কার্যকর কোনো ওষুধেরও দেখা নেই। সুতরাং, পেটেন্ট অব্যাহতির দাবি এবং নিজেদের টিকা নিজেরা বানানোর প্রস্তুতিই জরুরি।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনের হিসাবে বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ মানুষকে গণটিকা দান কর্মসূচির আওতায় আনতে পারলে তৈরি হবে হার্ড ইমিউনিটি, যার ব্যাপক অর্থনৈতিক সুফল রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের হিসেবে যার আর্থিক মূল্য প্রায় ২ হাজার ৪৮ কোটি ডলার বা পৌনে দুই লাখ কোটি টাকা।
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের মতো করোনা মহামারিও একটি বৈশ্বিক সমস্যা। মহামারি কাটিয়ে উঠতে সবারই একসাথে কাজ করা উচিত। ১১ মার্চ তারিখে "অনলি টুগেদার" ক্যাম্পেইনের উদ্বোধনকালে জাতিসংঘের মহাসচিব বলেছেন, করোনা ভ্যাক্সিন সর্বত্র সবার জন্য উম্মুক্ত করা ছাড়া কেউই এ সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবে না।
প্রায় ৮০০ কোটি লোককে টিকার আওতায় আনার কোনো বিকল্প নেই। ফর্মুলা উন্মুক্ত করে পৃথিবীর সকল উপযুক্ত লোককে টিকা প্রোগ্রামের আওতায় এনে হার্ড ইমিউনিটি তৈরির মাধ্যমে করোনা মহামারি'র ইতি টানাই এখন বিশ্বের সব দেশ ও স্বাস্থ্য সংস্থা'র একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত।
জাতিসংঘের মহাসচিবের ওনলি টুগেদার ক্যাম্পেনের বক্তব্যের শেষ অংশগুলোর বাস্তবায়নই পৃথিবীর মানুষদের আবার স্বাভাবিক জীবনধারায় ফিরিয়ে নিতে পারে। "শুধু একসাথেই আমরা আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীদের রক্ষা করতে পারি, রক্ষা করতে পারি পৃথিবীর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মানুষদের, পুনরুজ্জীবিত করতে পারি আমাদের অর্থনীতিকে, পারি মহামারির ইতি টানতে এবং নিজেদের পুনরুদ্ধার করতে। "
লেখক: যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক, চট্টগ্রাম।
mmhaider21@gmail