নিজের মোবাইলের দিকে চূড়ান্ত অবিশ্বাসের সঙ্গে তাকিয়ে থাকা ছাড়া এ মুহূর্তে নিজের করণীয় কী বুঝতে পারছি না!
দুটো মেসেজ নিজের হোয়াটস্যাপে বাইবাই করে ঘুরছে। একটা গত ১৫ অক্টোবরের—সাবধানে থেকো।
পরেরটা ২৪ অক্টোবরের—শুনলাম তুমি কেবিনে ফেরত গ্যাছো। খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠো।
প্রেরকের নাম অঞ্জন বন্দোপাধ্যায়। গ্রহণকারী এই অধম। ঠিক ছয় মাস আগে করোনা আক্রান্ত হয়ে সেই হসপিটালেই আমি ভর্তি এবং প্রথম কয়েকদিন পর্যাপ্ত সংকটে ছিলাম যেখান থেকে অঞ্জন হঠাৎ হারিয়ে গেল। মেডিকা। টেক্সট করেই শুধু থামেনি। এরপর কয়েকবার ফোনও করেছিল। বারবার বলছিলো সাবধানে সাবধানে। হায় আমি সেটা ফিরিয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগই পেলাম না।
কেউ সচেতনে তখন ভাবিনি। কিন্তু এখন ভেবে দেখছি বছর পনেরো-কুড়ি একসঙ্গে কাজ করলেও ওর জীবনের শেষ কয়েক বছর আমরা যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলাম। যদিও এবিপি ডিজিটালে দুর্ধর্ষ কাজ করতে করতে ও হঠাৎ ছেড়ে দেবে, ভাবতেই পারিনি। শুনলাম টিভি নাইন জয়েন করছে। বিস্তর হাসাহাসিও হল যে, এবিপিতে ও হয়তো প্রথম লোক যিনি চলে যাওয়ার পরেও সুপারবস এতো গুণমুগ্ধ এবং সুখ্যাতি করেই যাচ্ছেন।
আমি বললাম যে, অভীকবাবুকে বরাবর আমার অমল দত্তর মতো মনে হয় যে টিমে থাকলে একরকম ওপিনিয়ন। টিমে না থাকলে আর একরকম। বাইচুং টিমে যখন এশিয়ার সেরা। আর অপোনেন্টে গেলে চুং চুং। অথচ তুমি ছাড়ার পরেও একদিন ফোনে কিন্তু উনি উচ্ছসিত প্রশংসা করে বলছিলেন—এইরকম টিম লিডার কম দেখেছেন। অঞ্জন প্রচন্ড হাসলো।
হাসিমুখেই অবশ্য থাকতো। আমার ধারণা লিডার হিসেবে ওর এত সফল হওয়ার কারণ এস্কিমোদের দেশের মতো ঠাণ্ঠা মাথা। ক্ষুরধার বুদ্ধি। আর বাংলার ওপর অসম্ভব ভালো দখল। আলাপন না অঞ্জন? দুই ভাইয়ের মধ্যে কার বাংলা বেশি ভালো কখনো ভেবে বার করতে পারিনি। আর এখন তো এইসব তর্ক নিরর্থক হয়ে পড়লো।
জানতামই না ও যে হসপিটালে ভর্তি। নির্বাচনী ফল বেরোবার পর ফোন করে দু-একবার পাইনি। তারপর যেদিন এটা জানলাম , অঞ্জন অলরেডি হসপিটালে শুধু নয়, ভেন্টিলেশেনের কঠিন পর্যায়ে চলে গিয়েছে। ডাক্তারি পরিভাষায় যার নাম একমো। তাও আশা ছাড়িনি। এরকম একটা জীবন্ত লোক। সবসময় অ্যাক্টিভ। জীবনের মধ্যে যে প্রতি মিনিটে চুর চুর থাকে সে কী করে চলে যাবে? হয় নাকি? মাত্র ৫৫ বছর বয়স। এই তো বাইপাসের ধারে সব হোর্ডিংয়ে ওর আর মৌপিয়ার ছবি।
রাতে শোনার পর দুঃখবোধটাই কেমন অসাড় হয়ে গিয়েছে। এত অবিচুয়ারি মাথা ঠাণ্ঠা রেখে লিখেছি। আজ আর পারলাম না। ভাবতেই পারছি না অঞ্জন ওর বিখ্যাত হাসিটা ত্যাগ করে শুয়ে আছে কাঠের মোটা বাক্সে। যদি থাকেও, ওটা শরীরী অঞ্জন।
আসল অঞ্জন নট আউট থেকে গেল।
বলা হয় না—যে রাজা অপরাজিত থেকে সিংহাসন ত্যাগ করেন তিনি চিরজীবন অপরাজিত থেকে যান। প্রিন্ট সাংবাদিক হিসেবে সফল। ডিজিট্যালকে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। টিভি সাংবাদিকতায় তো কথাই নেই। চলেও গেল টপ ফর্মে। এডিটর থাকতে থাকতে। এরকম নজির বাংলা সাংবাদিকতায় নেই। তা অনেক মহীরূহ দেখেছি। মহীরূহকে নট আউট থেকে যেতে দেখেনি।
অঞ্জন, প্লিজ তোমার বিখ্যাত হাসিটা আবার হাসো। বাংলা সাংবাদিকতা যতদিন থাকবে, তোমার নট আউট থাকাটাও থাকবে।
* পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট সাংবাদিক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে লেখাটি লিখেছেন আরেক সাংবাদিক গৌতম ভট্টাচার্য