ক্ষমতার টানা এক যুগের আওয়ামী লীগের দিকে তাকালে মাঝে মাঝে মনে হয় এ যেন এক গতিহারা দুঃখিনী নদী। একসময় যে আওয়ামী লীগে ছিল জাতীয়ভাবে আলোকিত কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বহর, তৃণমূলে ছিল গণমুখী সৎ আদর্শিক ও অভিজ্ঞ রাজনীতির পোড় খাওয়া মুখ সেখানে আজ চিত্রপট একেবারেই ভিন্ন।
একসময় আওয়ামী লীগে একেকটি অঞ্চলভিত্তিক রাজনীতির পোড় খাওয়া দীর্ঘ সংগ্রামের পথহাঁটা জাতীয় নেতাদের নেতৃত্বে সংগঠন আলোকিত হতো। এখন আওয়ামী লীগের সেই বাতিগুলো একে একে নিভে যাচ্ছে। নতুন নেতৃত্ব তৈরি হয়নি। তৈরি করার প্রক্রিয়াও দেখা যাচ্ছে না। একসময় আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের সারা দেশের রাজনৈতিক মহল এমনকি আমজনতাও এক নামে চিনত। এখন ওয়ার্কিং কমিটির যেমন অর্ধেকের বেশির নাম জানে না তেমনি মন্ত্রিসভার সদস্যদের নাম জানতে হয় তালিকা বের করে। আওয়ামী লীগ উপমহাদেশের এক ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সুমহান মুক্তিযুদ্ধে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ইতিহাসের পরতে পরতে সে উড়িয়েছে জয়ের নিশান। এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের যে গৌরব আওয়ামী লীগ বহন করে তা আর কোনো দলের নেই। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর পরিবার-পরিজনসহ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুতই করা হয়নি, খুনিদের সরকার চার নেতাকে কারাগারে হত্যা করে দলের হাজার হাজার নেতাকে কারাবন্দী করেছে, নির্বাসিত করেছে, নির্দয় নির্যাতন করেছে। তবু জনগণের মাঝখান থেকে জন্ম নেওয়া আন্দোলন-সংগ্রামে অপ্রতিরোদ্ধ আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ১৯৮১ সালে দলের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে সভানেত্রী নির্বাচিত হয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা গভীর অন্ধকার সময়ে এসে গণতন্ত্রের বাতি জ্বালিয়ে জীবনবাজি যুদ্ধ শুরু করলে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। আওয়ামী লীগ আবারও জনপ্রিয় শক্তিশালী দলে পরিণত হয়। ’৯৬ সালে প্রথম ২১ বছর পর ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করে। আওয়ামী লীগ, গণতান্ত্রিক আন্দোলন, ব্যালটের রায় এ দেশের রাজনীতির অভিধানে সমার্থক শব্দ হলেও গত এক যুগের রাজনীতির দাবা খেলায় ছন্দপতন ঘটেছে। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে হাজার হাজার নেতা-কর্মীর বুকভরা অভিমান রয়েছে। দল ক্ষমতায় এলে মহাদুঃসময়ের দুঃখী কর্মীদের খবর দল নেয় না। মন্ত্রীরা তাদের আর চেনেন না। এমপিরা সিন্ডিকেট গড়ে তাদের ভিড়তে দেন না। দলীয় কোনো সুবিধা-লাভ দূরে থাক তাদের রাজনৈতিক মূল্যায়নটুকুও হয় না। দলের দুঃখের তরীতে তারা তখন ভেসে বেড়ান। দল ক্ষমতায় এলেই সুবিধাবাদীরা উড়ে এসে জায়গা করে নেন পাদপ্রদীপে। আর অভিমানে ছিটকে পড়েন দুর্দিনের লড়াকু আদর্শিক কর্মীরা। বিশেষ করে গত এক যুগে প্রশাসননির্ভর আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে পেশাজীবীদের দলবাজির দৌরাত্ম্য এতটাই আগ্রাসী যে দুর্দিনের কর্মীদের ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই অবস্থা। এক সময় এ দেশে বঙ্গবন্ধু ও ছাত্রলীগবিদ্বেষী অনেক ছাত্র সংগঠন যে ছিল এবং অনেকে যে সেসব ছাত্র সংগঠনের উগ্র নেতা-কর্মী ছিলেন একালে তাদের আচার-আচরণে একদম বোঝা যায় না। তাদের তৎপরতা বক্তব্য আর সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমে স্ট্যাটাস পড়লে মনে হয় তাদের চেয়ে বড় সাবেক ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ এবং মুজিবভক্ত পৃথিবীতে আর কেউ নেই। এই নির্লজ্জদের আগ্রাসী তৎপরতায় ১৯৭৫ সালের পর সেই গভীর সংকটকালে যাঁরা ছাত্রলীগের রাজনীতির পতাকা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উড়িয়েছেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতির প্রচার চালিয়েছেন সাংগঠনিক দক্ষতা ও মেধায় দলকে উজাড় করে দিয়েছেন তাঁরা এখন মুখ দেখাতে পারেন না। দলও তাঁদের খোঁজ নেয় না। তাঁদের মূল্যায়ন হয় না। ওয়ান-ইলেভেনে যাঁরা ঝুঁকি নিয়েছেন, জেল খেটেছেন, নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তবু যাঁরা নেত্রী শেখ হাসিনাকে ছাড়েননি তাঁদের খবরও এখন কেউ নেয় না। মূল্যায়ন তো দূরের কথা। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক চরিত্রই যেন দাঁড়িয়েছে দল যখন বিরোধী দলে থাকবে তখন নেতা-কর্মীরা একটি পরিবারে মমতার বন্ধনে থাকবেন। কঠিন দুঃসময়ে লড়াই-সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। জীবন দেবেন সাহসে, জেল খাটবেন হাসতে হাসতে, পুলিশি নির্যাতনের শিকার হবেন দল বেঁধে। সরকারদলীয় সন্ত্রাসীদের হামলা-মামলার জালে আটকা পড়বেন। তবু তাঁকে পথ থেকে সরানো যায় না। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে নেতাদের হাত ধরেই হাইব্রিড বা সুবিধাবাদীরা দলে এসে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করে। আর দুর্দিনের অভাগা কর্মীরা যেদিকে তাকায় সাগর শুকিয়ে যায়। তাদের দিকে কেউ ফিরে তাকানোর সময় পায় না। পরম মমতায় ডেকে নিয়ে কাজে লাগানোর সময় কারও হয় না। ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয় জেনেও নেতারা এমনটি করেন। কেন্দ্রীয় নেতারা দল থেকে হাইব্রিডদের বের করে দেওয়ার কথা বললেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। এক যুগের রাজনীতিতে আরেকটি দৃশ্য দৃষ্টিকটুর মতো চোখে পড়ে। সেটি হচ্ছে জেলা প্রশাসনের অনেক কর্মসূচি বা র্যালিতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়। অনেক জেলায় ‘মাই ম্যান’ কমিটি করতে গিয়ে এমন নেতাদের পদ-পদবি দেওয়া হয়েছে যাদের একটি মিছিল আনার যোগ্যতা দূরে থাক, নিজের রিকশায় করে একজন মানুষকে দলের কর্মসূচিতে নিয়ে আসার যোগ্যতা রাখেন না। দলের কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে তৃণমূল পর্যায়ের অনেক নেতা বিনা ব্যবসা-বাণিজ্যে অঢেল অর্থসম্পদের মালিক হয়েছেন। কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকে তাদের তিরস্কারের চেয়ে সমাদর করেন বেশি। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যেনতেন পথে রাজনীতি ও দলের নাম ভাঙিয়ে পদ-পদবি ব্যবহার করে অর্থবিত্ত কামানোয় যতটা যোগ্যতার চিহ্ন বহন করে ঠিক তেমনি নির্লোভ আদর্শিক চরিত্র নিয়ে সাদামাটা নিষ্কলুষ জীবনযাপন করাও যোগ্যতার পরিচয় দেয়। একসময় নেতারা খুঁজতেন আদর্শিক দুর্দান্ত সংগঠকদের, এখন যেন নেতারা খোঁজেন তেল চকচকে নব্য টাকাওয়ালাদের। একসময়ের গরিবের দল আওয়ামী লীগ গরিব কর্মীটিকে দূরে রেখে অর্থবানকে কাছে টানে।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশেই প্রবেশ করেনি, অর্থনৈতিক উন্নয়নে পৃথিবীতে রোল মডেল হয়েছে। করোনাযুদ্ধে তাঁর সাফল্য দেখার মতো। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের শত ব্যর্থতার মধ্যেও তিনি তাঁর নেতৃত্ব, দূরদর্শিতা, মেধা ও প্রজ্ঞায় সংকট মোকাবিলা করছেন। মানুষের ঘরে ধান গেছে। খাবারের জন্য কাউকে কষ্ট করতে হচ্ছে না। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের রাজনৈতিক জীবন বর্ণাঢ্য। আন্দোলন-সংগ্রাম, জেল-জুলুম শয়ে বারবার অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তাঁকে এ জায়গায় আসতে হয়েছে। টানা দুবারের আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ’৭৫-এর পর ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। সভাপতি থেকে বিদায় নেওয়ার পরও তিনি ছাত্রলীগের অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর কাছে সাবেক ছাত্রলীগের নেতাদের প্রত্যাশা অনেক বেশি ছিল। ’৭৫-এর পর থেকে দীর্ঘদিন যারা সারা দেশে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দিয়েছেন, দুঃসময়ে ভূমিকা রেখেছেন ওবায়দুল কাদের তাঁদের চেনেন। তাঁদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে তুলে আনতে হবে। তাঁদের সংসদে আনতে হবে। আওয়ামী লীগ আজ রাষ্ট্র পরিচালনায় আছে কিন্তু ক্ষমতা চিরস্থায়ী থাকবে না। বিরোধী দলের কঠিন রাজনীতি মোকাবিলা করার মতো সাংগঠনিক শক্তি ও কাঠামো কি তৈরি আছে?
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন
বাংলাদেশ সময়: ০৮২৩ ঘণ্টা, জুন ০৯, ২০২১