‘ত্রাণ চাই না, টেকসই বেড়িবাঁধ চাই! ‘ভাসতে চাই না, বাঁচতে চাই! ‘কাফনের কাপড় গায়ে জড়িয়ে উপকূলবাসীর এমন প্রতিবাদের মধ্যে স্পষ্ট বার্তা উপকূলের লোকালয়কে রক্ষা বা বাঁচাতে হবে? এই লোকালয়কে বাঁচানোর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট পন্থা ‘টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ’। টেকসই বেড়িবাঁধের অভাবের কারণে ঝড়-সাইক্লোনের পাশাপাশি জোয়ারের কারণে শত শত হেক্টর জমি তলিয়ে যাচ্ছে পানিতে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এখন বিশ্বের কাছে রোল মডেল। এর বাস্তবতার ফুটে উঠেছে ২০১৭ সালে যুক্তরাজ্যভিত্তিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান প্রাইস ওয়াটারহাউস কুপারস (পিডব্লিউসি)। প্রতিষ্ঠানটির ‘সুদূর প্রসারী: ২০৫০ সাল নাগাদ কীভাবে বিশ্ব অর্থনীতিতে ক্ষমতার পরিবর্তন হবে?’ শীর্ষক সাম্প্রতিক গবেষণার প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনের জরিপের ফল অনুযায়ী, ২০৫০ সালে বিশ্বের ২৩তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হবে বাংলাদেশ। আর ওই ধাপে এগোলে ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার হবে বিশ্বে ২৮তম। ২০৩০ সালের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য যেমন আশা জাগানিয়া, পাশাপাশি ২০১৯ সালের জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনে সংস্থাটির পরিবেশ পরিবর্তন বিষয়ক আন্তঃসরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) করা প্রতিবেদনটি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত হতাশার।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ দশমিক ১ মিটার বাড়তে পারে। আগের ধারণার চেয়ে যা ১০ সেন্টিমিটার বেশি। এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০৫০ সালে মধ্যেই বিশ্বের কিছু এলাকা তলিয়ে যাবে। প্রতি বছর নিয়মিত আঘাত হানবে ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কমপক্ষে ৪৫ শতাংশ কমিয়ে আনতে হবে। নয়তো তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যেতে পারে। এটি হলে বিশ্বজুড়ে এর প্রভাব হবে ভয়াবহ। মহাসাগর ও পর্বতগুলোতে জমা থাকা বরফের স্তূপ ইতোমধ্যে গলা শুরু করেছে। সেগুলো আরও দ্রুত গলে পানির উচ্চতা ধারণার চেয়ে বেশি বেড়ে যাবে। ২০৫০ সালের মধ্যে উপকূলীয় অনেক অঞ্চল ডুবে যাবে। প্রায় একই ধরনের আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে ২০১৯ সালের প্রকাশিত ‘প্রসিডিংস অব দি ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস’ নামের জার্নালের জরিপের প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বাড়তে পারে ৬২ থেকে ২৩৮ সেন্টিমিটার পর্যন্ত। গ্রিনল্যান্ড ও অ্যান্টার্কটিকায় জমে থাকা বরফ গলার হার দ্রুততর হওয়ার ফলে বিশ্বের ৮০ লাখ বর্গ কিলোমিটার পরিমাণ ভূমি সাগরের পানিতে তলিয়ে যাবে। এর মধ্যে থাকবে বাংলাদেশের এক বড় অংশ।
মানুষের জীবনমান উন্নয়ন, আধুনিক সভ্যতা বিনির্মাণের দোহাই দিয়ে মানুষ বন উজাড় করে, পাহাড় ধ্বংস করে, আকাশ-মাটি ও সমুদ্রের দূষণ বাড়িয়ে পরিবেশকে দমন করে চলেছে। এই নিষ্ঠুরতার জবাবও প্রকৃতি আমাদেরকে ফেরত দিচ্ছে। প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ-ঝড়, সাইক্লোন, খরা, বন্যা, ভূমিকম্প, বজ্রপাত বেড়েই চলেছে। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে, হারাচ্ছে ফসলি জমি ও আয়ের উৎস। অধিক হারে কার্বন নিঃসরণের কারণে পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়চ্ছে।
‘প্রসিডিংস অব দি ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস’ নামের জার্নালের জরিপের প্রতিবেদনে বলা হয়, যদি কার্বন নির্গমণের হারে বর্তমান হারে চলতে থাকে, তবে ২১০০ সাল নাগাদ পৃথিবীর এখনকার চাইতে প্রায় ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতা বাড়বে। এই উষ্ণতা বৃদ্ধি মানবজাতির জন্য হুমকি স্বরূপ। কার্বন নিঃসরণের জন্য পৃথিবীর মধ্যে যে কয়টি দেশ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এখন বাংলাদেশের উপকূলের সার্বিক চিত্রের ভয়াবহতা পরিলক্ষিত করলে এই আশঙ্কা আমাদের মধ্যে জাগায়, বাংলাদেশের উপকূলের লোকালয় বাঁচবে তো?
বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৬০ সাল থেকে ২০০৭ সালে সিডরের পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রায় মোট ৩৩টি বড় সাইক্লোনের ঘটনার তথ্য পাওয়া যায় এবং এই ঘূর্ণিঝড়গুলোকে ‘সিভিয়ার সাইক্লোনিক স্টর্ম’ বা প্রবল ঘূর্ণিঝড় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। (২০১৯ সালের ০২ মে বিবিসি বাংলার ‘ঘূর্ণিঝড়: বাংলাদেশে আঘাত হানা সবচেয়ে ভয়াল ৫টি সাইক্লোন ‘বিষয়ক প্রতিবেদন)। এসব সাইক্লোনের কারণে অনেক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। উপকূলের অনেক এলাকায় বিশুদ্ধ পানির উৎস ধ্বংস হয়েছে, অনেক স্থাপনা, রাস্তা-ঘাট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কি পরিমান মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান কারও জানা নেই। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ‘সিডর’ খুলনা-বরিশাল উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে। রেডক্রসের তথ্যানুযায়ী, সিডরে ১০ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে ২০১৯ সালে ২৫ মে উপকূল এলাকায় আঘাত হানে প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’।
ইউএনডিপির তথ্যমতে, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ ও ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাংশে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় আইলায় কমপক্ষে ৩ লাখ পরিবার ঘর-বাড়ি হারান। আট লাখ টন খাদ্য ঘাটতি হয়। প্রায় ২শ মানুষ মারা যায়। ‘সিডর এবং আইলার কারণে উপকূলের অনেক এলাকার বিশেষত- সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট জেলার বিভিন্ন এলাকার বাঁধ সম্পূর্ণ ধ্বংস প্রাপ্ত হয়ে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে। সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা, আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর; শ্রীউলা, খুলনার কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নসহ অনেক এলাকায় সারা বছর মানুষ পানি বন্ধ অবস্থায় থাকছে। নিজেদের আবাসন ছেড়ে অনেকেই ‘শেল্টার হাউজ’, রাস্তার পাশে উঁচু জায়গায় বসবাস করছে।
প্রতি বছর বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে মানুষের দুর্দশার অন্ত থাকে না। একুশ শতকে এসে যেখানে বিভিন্ন প্রযুক্তি এবং অবকাঠামো উন্নয়নের ফলে মানুষের জীবনমান বেড়ে চলেছে, সেখানে উপকূলের মানুষের জীবন কাটছে দুর্দশায় ও আশঙ্কায়। ২০২১ সালের মে মাসে উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’। পূর্ব সতর্কতার কারণে অনেক মানুষকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হলেও উপকূলকে বাঁচানো যায়নি প্লাবনের হাত থেকে। ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ বাংলাদেশে আঘাত না হানলেও উপকূলবর্তী এলাকাগুলোর বেড়িবাঁধ ভেঙে গিয়ে ১৪টি জেলার ২৭টি উপজেলার অন্তত কয়েকশ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে বলে জানিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। (বিবিসি বাংলা, ঢাকা, ২৭ মে ২০২১)।
কপোতাক্ষ ও খোলপেটুয়া নদীর প্রায় শতাধিক পয়েন্টের ভাঙনের কারণে বাঁধ ভেঙে সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগরের কুড়িকাওনিয়া, হরিশখালি, শুভদ্রাকাটি, চাকলা, দিঘলার রাইট, কুড়িকাউনিয়ার লঞ্চঘাট এলাকা; শ্রীউলা, আনুলিয়া ইউনিয়নের নাকলা; শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা, পদ্মপুকুর, বুড়িগোয়ালিনি, মুন্সিগঞ্জ, কৈখালী ইউনিয়নসহ অনেক এলাকা প্লাবিত হয়েছে। প্রবল জোয়ারের প্রভাবে কালীগঞ্জ উপজেলা ও দেবহাটা উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত ইছামতি নদী, কালিন্দি নদী ও কাকশিয়ালি নদীর পানি উপচে লোকালয়ে প্রবেশ করে। খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের আংটিহারা এলাকায়, মহারাজপুর ইউনিয়নের দশালিয়ায়, উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় কপোতাক্ষ নদের বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করেছে।
এছাড়াও পাইকগাছা উপজেলা সোলাদানা, গড়ইখালীসহ বিভিন্ন এলাকার বাঁধ উপচে লোকালয় পানিতে প্লাবিত হয়েছে। দাকোপ উপজেলার কামনীবাসিয়া, পানখালী ও মেরিন কোম্পানির আশপাশসহ বিভিন্ন এলাকায় বেড়িবাঁধ উপচে লোকালয় পানিতে প্লাবিত হয়েছে। বাগেরহাটের সুন্দরবন সংলগ্ন শরণখোলা উপজেলার বলেশ্বর নদের তীর সংলগ্ন বগী, তেড়াবেকা, খুড়িয়াখালী, সোনাতলা গ্রাম ও মোরেলগঞ্জ উপজেলার দোনা, শ্রেণিখালি, নিশানবাড়িয়া ও ছোলমবাড়িয়া গ্রামেও প্রবল জোয়ারের কারণে পানি প্রবেশ করেছে। তাছাড়াও বরিশাল, ঝালকাঠি, নোয়াখালীসহ উপকূলীয় অন্যান্য জেলার অনেক এলাকায় পানি প্রবেশ করেছে।
উপকূলীয় এসব এলাকায় জলাবদ্ধতা এখন সারা বছরব্যাপী চলমান। এখান থেকে ১০ বছর আগেও শুধুমাত্র বর্ষাকাল বা ঝড়-সাইক্লোনের সময় মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় থাকে অন্য ঋতুতে পানি কমলে মানুষের বসবাস এবং আয়ের ক্ষেত্রগুলো উপযোগী হত। কিন্তু, সাম্প্রতিক সময়, বর্ষাকাল বা ঝড়-সাইক্লোনের সময়ের পাশাপাশি জোয়ারের কারণে বাঁধ ভেঙে বা উপচে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করছে। এ এলাকাবাসীর অন্যতম আয়ের উৎস মাছ চাষ। অতিরিক্ত পানি প্রবাহ মাছ চাষকে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত করছে। বেকার হয়ে পড়ছে হাজার হাজার মানুষ। বিশুদ্ধ পানির চরম সংকট দেখা দিচ্ছে। ভেঙে পড়ছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। বিভিন্ন এলাকায় পরিকল্পিত এবং টেকসই বেড়িবাঁধ না থাকার ফলে উপকূলবর্তী এলাকাসমূহ ক্রমান্বয়ে মানুষের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। এমন বাস্তবতায় জনমনের প্রশ্ন, বাঁচানো যাবে কী উপকূলের লোকালয়কে?
লেখক: রিসার্স অ্যাসোসিয়েট, সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪১ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০২১
এএটি