ম্যাকক্যাফের বর্ণিল জীবনকে রূপকথার চেয়েও বিস্ময়কর বলে মনে হতো। বার্সেলোনার এক জেলে অনুমিত আত্মহত্যাজনিত মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করা হলে এন্টি-ভাইরাসের উদ্ভাবক ম্যাকক্যাফের বাউন্ডুলে জীবনের গল্পে আরেক নতুন মোড় নেয়।
জসোয়া ডেভিড, যিনি ম্যাকক্যাফেকে নিয়ে ‘জন ম্যাকক্যাফের সর্বশেষ অবস্থান’ শিরোনামে একটি বই লিখেছেন, তিনি এই সংবাদে মর্মাহত।
জসোয়া বলেন, আমি আংশিক বিস্মিত হয়েছিলাম, কারণ সে একবার ২০১৩ সালে গুয়াতেমালায় জেল থেকে বের হওয়ার সময় হার্ট অ্যাটাকের এক মিথ্যে সংবাদ পরিবেশন করেছিলো। তাই এবারও ভেবেছিলাম স্পেন থেকে আমেরিকার হাতে সোপর্দ করার মুহূর্তে বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে এটাও হয়তো তেমনই একটি মিথ্যে খবর। কিন্তু এখন দেখছি স্প্যানিশ সরকার তার মৃত্যু সংবাদ নিশ্চিত করেছে।
একজন অগ্রদূতের উত্থান
ম্যাকক্যাফে ১৯৮০-এর দশকের শেষভাগে সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অ্যান্টি-ভাইরাস সৃষ্টির একজন অগ্রদূত। তার প্রতিষ্ঠান ম্যাকক্যাফে কর্পোরেশন ছিলো সেই সময়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান। যেটা ভবিষ্যৎ ১০০টি ফরচুন কোম্পানির অর্ধেককেই সফটওয়্যার সরবরাহ করতো। ১৯৯৪ সালে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের সিইও পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে ১০০ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে নিজের শেয়ার বিক্রি করে নতুন একটি প্রজেক্টে কাজ শুরু করেন, যেটা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে যায়। ম্যাকক্যাফে যতটা তার ব্যবসায়িক সাফল্যের জন্য ঠিক ততটাই তার অদ্ভুত জীবনাচরণের জন্য মানুষের মনে থাকবেন।
একটি হত্যাকাণ্ডের তদন্তকালে সন্দেহভাজন হওয়ায় পলাতক হিসেবে ছুটে বেড়িয়ে জীবনের অনেকটা সময় কাটান। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্যও ছুটেছেন এবং স্বল্পকালের জন্য অবৈধ ড্রাগ ম্যানুফ্যাকচারিং ও অবৈধ অস্ত্র তৈরির জন্য কারা ভোগ করেন। সবশেষে কর ফাঁকির জন্য তাকে অভিযুক্ত করা হলে আত্মগোপন অবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার তাকে স্পেনে খুঁজে পায়। আত্মহত্যাবিষয়ক প্রশ্ন অর্থ পাচার ও কর ফাঁকির জন্য তিনি অভিযুক্ত ছিলেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার দাবি করে যে তিনি মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার গোপন করেছেন। এই সপ্তাহেই তাকে আমেরিকার হাতে সোপর্দ করার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছিলো। কিন্তু তার পারিবারের আপত্তির মুখে তা স্থগিত হয়ে যায়।
ম্যাকক্যাফের পরিবারের আইনজীবী জেভিয়ার ভিলালবা বলেন, তার মক্কেল আত্মহত্যা করেছে এমন কোনো লক্ষণই নেই। যাই হোক যেদিন আমার মক্কেলের সাথে আমার সর্বশেষ সাক্ষাৎ হয়েছিলো, সেদিন তিনি সোপর্দ বিষয়ক শুনানির জন্য প্রস্তুত ছিলেন। টেলিফোনের মাধ্যমে তার সাথে যোগাযোগ অব্যাহত ছিলো। কোনো সময়ই তিনি বিশেষ কোনো উদ্বেগ প্রকাশ করেননি বা এমন কোনো লক্ষণ প্রকাশ করেননি যার পরিণতিতে এমন একটা সংবাদের মুখোমুখি আমরা হতে পারি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক হুইসেলব্লোয়ার স্নোডেন ম্যাকক্যাফের মৃত্যুতে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, আত্মহত্যার মাধ্যমে ম্যাকক্যাফের মৃত্যু এই ধারণার জন্ম দিচ্ছে যে এরপরের শিকার হয়তো হতে পারে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। তার এই ধারণার পেছনে অ্যাসাঞ্জ ও স্নোডেন সম্পর্কে অল্পবিস্তর আলোকপাত না করলেই নয়।
অ্যাডওয়ার্ড জোসেফ স্নোডেন (জন্ম- জুন ২১, ১৯৮৩) হলেন একজন হুইসেলব্লোয়ার যিনি একজন প্রাক্তন কম্পিউটার কনসালটেন্ট। তিনি ২০১৩ সালে সিআইএ’ একজন কর্মকর্তা এব্ং সিআইএর সাব-কন্ট্রাক্টর থাকা অবস্থায় ন্যাশনাল এজেন্সির উচ্চমানসম্পন্ন গোয়েন্দা তথ্য ফাঁস করে দিলে আমেরিকার বৈশ্বিক নজরদারির বিষয়টি উন্মোচিত হয়ে পড়ে। অপরদিকে অ্যাসাঞ্জও বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ওয়ান্টেড মানুষ; কারণ তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অত্যন্ত ঘনিষ্ট মিত্রদেশ অস্ট্রেলিয়ার বাসিন্দা হয়েও আমেরিকার অবাধ তথ্য প্রবাহের তথাকথিত উদারনীতির জারিজুরিও ফাঁস করে দিয়েছেন। তিনি একজন অস্ট্রেলিয়ান সম্পাদক, প্রকাশক এবং অ্যাক্টিভিস্ট। তিনি ২০০৬ সালে উইকিলিকস প্রতিষ্ঠা করেন। উইকিলিকস ২০১০ সালে চেলসি ম্যানিং নামের এক মার্কিন সামরিক গোয়েন্দার ফাঁস হওয়া তথ্য প্রচার করে সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে বাগদাদ এয়ারস্ট্রাইক কোলেটারাল মার্ডার ভিডিও (এপ্রিল ২০১০), আফগানিস্তান ওয়্যার লগস (জুলাই ২০১০), ইরাক ওয়্যার লগস (অক্টোবর ২০১০), কোলেটারাল মার্ডার (নভেম্বর ২০১০) ইত্যাদি। এরপর থেকে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জও জীবন বাঁচাতে এক দেশ থেকে অন্য দেশে ছুটে বেড়াচ্ছেন। সেই বিবেচনায় তার এই অনুমান হয়তো ভুল নয়।
স্লোডেন তার টুইটার বার্তায় এও বলেন, যেসব অপরাধী অহিংস অপরাধের দায়ে কারান্তরীণ, ইউরোপের উচিত নয় তাদেরকে এতোটা অন্যায্য ও নিষ্ঠুর কারাগারে সোপর্দ করা, যার পরিণতিতে কোন অপরাধী এখানকার কারাগারে আটক থাকার চেয়ে মৃত্যুকে শ্রেয়তর ভেবে নিতে পারে। যতক্ষণ পর্যন্ত এখানকার আইন সংশোধিত না হয় ততদিন পর্যন্ত এমন আদেশ স্থগিত রাখা উচিত।
ম্যাকক্যাফে অ্যান্টিভাইরাসের প্রতিষ্ঠাতা জন ম্যাকক্যাফেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ওয়ান্টেড তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং ২০২০ সালের অক্টোবর মাসের প্রথম ভাগে ইস্তাম্বুলে যাওয়ার পথে বার্সেলোনা বিমান বন্দরে আটক করা হয়। তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো ছিলো ক্রিপ্টোকারেন্সি উপার্জন, কন্সাল্টিং, পাবলিক স্পিকিং এবং নিজের শেয়ার বিক্রি করার মাধ্যমে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার উপার্জন করে তার কর ফাঁকি দেওয়া। জুনের মাঝামাঝি সময়ে ম্যাকক্যাফেকে স্পেনের জাতীয় আদালতে হাজির করা হলে তিনি তার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ মিথ্যে এবং রাজনৈতিক বলে আত্মপক্ষ সমর্থন করেন।
জন ম্যাকক্যাফের সদ্য বিধবা স্ত্রী জেনিস জোর দিয়ে বলেছেন, তার স্বামী কখনও আত্মহত্যা করার মানসিকতাসম্পন্ন ছিলো না। এই সপ্তাহে মৃত্যুবরণ করার আগে বার্সেলোনার সংশোধনাগার যেখানে তার স্বামীকে আটক করে রাখা হয়েছিলো, তার সামনে দাঁড়িয়ে ম্যাকক্যাফে সর্বশেষ তাকে বলেন, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি এবং সন্ধ্যায় তোমাকে ফোন করবো। ’ তাই তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করেন না যে তার স্বামী আত্মহত্যা করতে পারে। কারণ শেষদিন সে যেসব কথা বলেছে, তা একজন মৃত্যুপথযাত্রীর ভাষ্য হতে পারে না। তিনি স্বামীর মৃত্যুর তদন্ত দাবি করেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃপক্ষের ওপর দায় চাপান।
তিনি আরও বলেন, এই ট্র্যাজিক মৃত্যুর জন্য আমেরিকার সরকার দায়ী। কারণ সব অভিযোগ ছিলো রাজনৈতিক। আমার স্বামী আমেরিকাকেই তার মাতৃভূমি বলে জানতো এবং এখানে ফিরে আসতে চেয়েছিলো। কিন্তু এখন সে মৃত। শুধুই রাজনৈতিক কারণে।
তিনি আরও বলেন, যেহেতু তার স্বামী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেছে, তাই তাকে জীবন দিতে হয়েছে। তার এসব কথা ম্যাকক্যাফের অনুসারীদের অনুমানে ঘি ঢেলেছে আর সে কারণেই সবাই ম্যাকক্যাফের পূর্বতন টুইটগুলো তুলে ধরে দাবি করছে, তিনি আত্মহত্যা করার মতো মানুষ নন। ‘আমি যদি আত্মহত্যা করি, তাহলেও আমি নই’- সমর্থকরা তাদের টুইট বার্তায় এভাবেই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে। সূত্র: চায়না গ্লোবাল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা মহানগর মহিলা কলেজ।
ইমেইলঃ bipi1963@gmail.com