ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

প্রতিবাদের ভাষা, অসন্তুষ্টির প্রকাশ

আবিদ রহমান, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৫০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৬, ২০১২
প্রতিবাদের ভাষা, অসন্তুষ্টির প্রকাশ

জীবন, যাপনের-ধারণের ও বহিঃপ্রকাশের বিভিন্ন উৎসারণের বিভিন্ন ব্যাকরণ ও রীতিনীতি থাকে। রাস্তার হকারের মাইকিং ঔষধের মতো এক দাওয়ায় সর্ব রোগের চিকিৎসা হয় না।

ভিন্ন রোগের ভিন্ন চিকিৎসা। ভিন্ন পদ্ধতি।
 
টাকাভর্তি মানিব্যাগ রাস্তায় ফেলে রাখলে কেউ না কেউ উঠিয়ে নেবে। গায়েব হয়ে যাবে মানিব্যাগটি। টাকা ভর্তি মানিব্যাগ রাস্তায় ফেলে রেখে কুড়িয়ে পাওয়া মানুষের সততা নিয়ে প্রশ্ন তোলা উচিত না। বিনা বাধার সুযোগ দিলে স্বাভাবিক নিয়মেই সেই সুযোগের সুবিধা নিতে কেউ বোধকরি আজকাল দ্বিধান্বিত হন না। যদি সবাই সততার নিয়ম নীতি মেনে চলতেন তাহলে দুনিয়াটা স্বর্গ হয়ে যেতো।
 
আমাদের বাল্যকালে প্রতিবেশীরা ছিলেন বর্ধিত পরিবার। বাবা-জেঠা-ভাইয়ের সংস্করণ মাত্র। গ্রামে-গঞ্জে প্রতিবেশীরা পরস্পরের সুখ-দুঃখ ভাগ বাটোয়ার করে নিতেন বিনা দ্বিধায়। এখন প্রতিবেশীরা থাকেন সামান্য দুই ইঞ্চি সীমানা কিংবা গাছের ডালের প্রাকৃতিক আগ্রাসনের ঝগড়াঝাঁটিতে। পারস্পরিক সম্পর্ক শাশুড়ী-পুত্রবধূর মতো আধিপত্যের লড়াইয়ে। নিজে শ্রেষ্ঠ কিংবা সঠিক প্রমাণে। ফ্ল্যাট বাড়িতে প্রতিবেশীরা পরস্পরের বড়জোর বলেন, হ্যালো হাই। একই ছাদের নীচে বসবাস করা ভিন্ন পরিবার মাত্র। এক ফ্ল্যাটে যখন জন্মদিনের পার্টি চলে তখন অন্য ফ্ল্যাটের বৃদ্ধ বাবার যমে-মানুষে টানাটানি। ভ্রুক্ষেপের কেউ কোথাও নেই।
 
বাংলাদেশের ‘দাদা’ প্রতিবেশী ভারত। দেড়শ’ কোটি বিভিন্ন ভাষী ও সংস্কৃতির মানুষের ভারত ‘বড় ভাই’ সুলভ তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যে পনেরো কোটি বাংগালী মুসলমানের ঘাড়ে অবজ্ঞায় চাপিয়ে দেয় বিভিন্ন ইস্যু। ঈশপের গল্পের মতো ভাগাভাগিতে বাংলাদেশের ভাগে ফেলে গরুর মুখ, খেজুর গাছের গোঁড়া আর দিনের রোদে শীতের কম্বল। বাংগালী গরুকে খাইয়ে তাজা করে। ‘দাদা’ ভারত সেই গরুর দুধ ভোগ করে বিনাপ্রশ্নে। দোষটা কী ভারতের একার?
 
গেল চল্লিশ বছরে বঙ্গবন্ধুর সরকার ছাড়া আমাদের নির্বাচিত-অনির্বাচিত-কাঙিক্ষত-অনাকাঙ্ক্ষিত সব সরকার ভারতের ‘কোর্টে’ আমাদের ‘স্বার্থের’ মানিব্যাগটি বারবার ফেলে রেখে আশায় থাকেন কখন দয়াপরবশ ‘দাদা’ ডেকে স্বার্থের মানিব্যাগটি ফেরত দেবে !  কেউ কেউ পানির ন্যায্য হিস্যার বিশাল অংশ ভারতীয় দাদাদের হাতে তুলে দিয়ে আসেন গদগদ আবেগে। কেউবা তালপট্টি-বেরুবাড়ীর মতো ছিটমহলগুলোর ভবিতব্য আলোচনাতেই তোলেন না, যদি দাদারা রাগ করেন? বিনা শুল্কে ভারতীয় পণ্যের বাংলাদেশ যাত্রায় কেউবা অগ্রণী ‘সিপাহী’। নিমিষেই এমপ্লয়মেন্ট ভিসায় এক লাখ ভারতীয়কে বাংলাদেশে বিনা আয়করে ‘আমদানিতে’ কৃতার্থ হন কেউ কেউ। তখন নিম্নবিত্ত বাংগালীরা চিকিৎসার জরুরি ভারতীয় ভিসার অপেক্ষায় অবমাননাকর প্রহর গোনেন।
 
‘দাদাদের’ বাংলা সাপ্তাহিকগুলো দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের অভিজাত ড্রইং রূমের শোভা বাড়ায়। ট্রেনে-বাসে-লঞ্চে-লাইব্রেরিতে ‘দাদা’ লেখকদের বই ঢাকঢোলে বিক্রি হয়। বাংলাদেশেরগুলো ভারতের মুখ দেখে না। ভারতের আকাশ-সংস্কৃতি বাংলাদেশের বাণিজ্য-সংস্কৃতি-ভাষা সব গিলে খেয়ে বাংগালীদের ‘ধন্য’ করে। ‘রাজার পতিতা’ হবার  কৃতার্থের মতো গর্বে বাংলাদেশের সরকারগুলোর বুকের ছাতি ফুলে ছত্রিশ ইঞ্চি ! ইদানীং দাদাদের মুঠো ফোন এসেছে বাংগালীর আভিজাত্যের অলংকার হয়ে! বিপরীতে? ফাঁকা বুলি ছাড়া বাংগালীদের কপালে কিছুই জোটে না। বর্তমান সরকার রমরমা সাড়ম্বরে দাদাদের কাছ থেকে ৭৬টি পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা ‘আদায়’ করেছেন। পণ্যগুলোর এইচএসকোড ও বিস্তারিত খেয়াল করলে দেখা যাবে ৬০টি পণ্যই ফালতু। আইওয়াশ। ভারতের এসব পণ্যের কোনো প্রয়োজন নেই। পণ্যগুলোতে ভারত নিজেই স্বয়ং সম্পূর্ণ। পুরো ভারতে নয় কেবল পশ্চিম বাংলায় বাংলাদেশের চাহিদা সম্পন্ন আকাশ - সংস্কৃতি বিভিন্ন দোহাইয়ে অচ্ছুৎ। ভারতে বাংলাদেশের বিনিয়োগের সম্ভাবনাতো ‘দিল্লি হনুজ দূর অস্ত’!
 
ভারত ‘নিজগুণে’ বাংলাদেশের ‘দাদা’ বনেনি। বাংলাদেশের সরকারগুলো নিজেদের আত্মবিশ্বাসহীন নতজানু মানসিকতায় ভারতকে ‘দাদার’ আসনে বসিয়ে নিজেরাই ‘ধন্য’ হয়েছেন। সীমান্তে বাংলাদেশিদের ওপর অত্যাচার, নির্বিকার গুলি, লুটপাট বহু পুরোনো ‘সংস্কৃতি’।   বিরোধী দলে থাকলে সবাই চেঁচায়। সবাই বিপ্লবী! সরকারে গেলে থাকে ভারতীয় দাদাদের পক্ষে সাফাইয়ে। বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময়কার প্রতিবাদগুলো কী একই ‘নীরব’ চেহারার নয়? অনেক যোগ্য ও প্রতিভাবান কুটনৈতিকে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ কেবলমাত্র সরকারগুলোর মেরুদণ্ডহীন নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণেই কখনোই কোনো কার্যকর কুটনৈতিক উদ্যোগে যায়নি। কখনো কোথাও কোনো সমস্যা সমাধানে কুটনৈতিক ভাষা দেখি না। রাজপথে-পত্রিকায়-বিবৃতিতে যতোটা প্রতিবাদ দেখা যায় তার অংশ বিশেষও যদি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দৃশ্যমান হতো? ভারতের সাথে দ্বিপাক্ষিক ইস্যুতে সরব থাকেন অকুটনীতিক রাজনীতিবিদেরা। দক্ষ ও পোড় খাওয়া কুটনীতিকরা জানেনই না কি হচ্ছে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা।
 
মেরুদণ্ডহীন বাংলাদেশ সরকারগুলোর অব্যাহত পিছু হটার নতজানুতায় ‘দাদা’ ভারত বাংলাদেশকে বিভিন্ন ইস্যুতে অব্যাহত চাপের মূখে রাখে। কখনো ফারাক্কা। কখনো টিপাইমূখ বাঁধ। কখনো তিস্তার পানি বন্টন। কখনো সীমান্তে নির্যাতন। এভাবেই বাংলাদেশকে চাপের মূখে রেখে ভারত নিজেদের অন্যান্য বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলে নামে। আমাদের কোনো ‘ভারতের দালাল` কিংবা `ভারত-বিরোধী’ সরকারই প্রতিবাদী হয় না। আমাদের বিরোধী দল ও সরকার উভয়ের ভাষা ভারত প্রশ্নে ভিন্ন। দুই দল কখনোই ভারতের সাথে বাংলাদেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রশ্নে দেশপ্রেমে ঐকমত্য হন না। কেবল পরস্পরের দোষারোপে থাকেন। সব সরকারের মন্ত্রীদের ভাষা ভারতের এতো স্বপক্ষে যে ভারতীয় মন্ত্রীদের মুখ খোলার প্রয়োজনই  হয় না! আজ আওয়ামী সরকারের মন্ত্রীরা-উপদেষ্টারা ভারতের পক্ষে ওকালতি করছেন, অতীতে করেছিলেন ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াতী সরকার। আশঙ্কা করি আগামী সরকারের ভাষাও একই হবে।
রাজনৈতিক দলগুলো ও সরকার কেউই কুটনৈতিক ভাষা ও উদ্যোগের দক্ষতা অর্জন করেন নি। তারা জানেনও না নিজেদের কর্তব্য। সরকারি প্রতিবাদ ও কুটনৈতিক উদ্যোগের ব্যর্থতায় আম-জনতা কিন্তু রাজপথে স্লোগানে মাতেন। ভারতীয় পণ্য বর্জনের দেশপ্রেমিক বর্জনের ডাক দেন।
 
এই সুযোগে দেশের স্বার্থবিরোধী একদল মানুষ দেশের সম্মান বিনষ্টের প্রতিবাদে নামে। ভারত-বাংলাদেশ দ্বি-পাক্ষিক টানাপোড়নকে ধর্মীয় উন্মাদনার বিভক্তিতে উস্কে দেয়। যেন বাংলাদেশের মানুষ মুসলমান বলেই হিন্দু ভারতের এতো দাপট!  যারা ‘অতি প্রকাশ্য’ ভারত বিরোধিতার নামে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কুটনেতিক ভাষা পরিহার করে তাদের নিয়ত সহি মালুম হয়না। বাংলাদেশের প্রতি ভারতীয় অন্যায় আজ নতুন কিছু নয়। গঙ্গার পানির হিস্যা কিংবা তিস্তার পানি বন্টনে ভারতীয় অনাগ্রহ কিন্তু অনেক পুরোনো। তখন ভারত বিরোধিতা এতোটা তীব্র হয়ে ওঠেনি। ভারত বিরোধী জিগির তীব্র হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের গ্রেপ্তারের পরপরই। পালের গোদা গোলাম আযম গ্রেপ্তার হওয়ার পর একদল মরিয়া হয়ে উঠেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। আওয়ামী বিরোধিতার সুত্রেই ভারত বিরোধিতা।
 
আজব ব্যাপার হচ্ছে, জামায়াত ও তাদের অদৃশ্য সংগঠন হিজবুত তাহরীরও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায়! জামায়াত কিংবা হিজবুত কী খোলাসা করবে, যুদ্ধাপরাধের সংজ্ঞাটা কি? কিংবা কাদের যুদ্ধাপরাধের কাতারে ফেলা হবে? মানদণ্ডটা কি হবে? রাজনৈতিক মহলে গুজব-গুঞ্জন যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ব্যাহত করার অপচেষ্টার অংশ হিসেবেই ভারত বিরোধিতা। উল্টো ভারতকে চাপের মূখে রেখে যদি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধে ভারতের সহায়তা পাওয়া যায়?
 
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ভারতীয় অন্যায়ের প্রতিবাদে সব সময় একাট্টা। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতায় আমাদের উচ্চারণ, অসন্তুষ্টি ও প্রতিবাদ দৃশ্যমান হয় না। ভারতের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টিতে আসুন প্রভাবশালী দেশগুলোর পররাষ্ট্র দফতরে, বিভিন্ন দেশে থাকা ভারতীয় দূতাবাসে এবং বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতে প্রতিবাদলিপি দেই। খালেদা-হাসিনার মুক্তির দাবিতে যদি ওয়ান ইলেভেনের সময় আন্তর্জাতিক তদবির করা যায়, তাহলে এখন কেন ভারতের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির সূচনা করা যাবে না? জামায়াতী নেতাদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে-যুদ্ধাপরাধের বিচার ভূণ্ডুল করতে তো জামায়াতীরা পানির মতো টাকা খর্চা করতে পারছে। ভারত প্রশ্নে কেনো পারবে না?
 
যুগপৎ আসুন দেশে ভারতীয় পণ্য বর্জনের সূচনা করি। রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতায় আমাদের অর্থনীতির আষ্টেপৃষ্ঠে ভারতীয় পণ্য। ভারতের স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো বর্জন করি। অস্বীকার করি টাটা-মারুতির বাস-ট্যাক্সি-সিএনজি যাত্রা। সামাজিকভাবে দোকানীদের নিরুৎসাহিত করি ভারতীয় পণ্য বর্জনে। ভারতীয় মোবাইল কোম্পানির লোভনীয় মোবাইল অফারে মুখ ফিরিয়ে রাখি। অর্থনৈতিকভাবে প্রত্যাখানের মাধ্যমেই ভারতকে জানিয়ে দেই আমাদের অসন্তুষ্টির কথা। আমাদের প্রতিবাদ।
 
কিন্তু দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করে বিদেশের নাগরিকদের বিব্রত করার নামের প্রতিবাদে কী লাভ? প্রতিবাদে জনমত তৈরি খুবই জরুরি তবে সেটা কখনোই অন্যকে বিব্রত-বিরক্ত করে নয়। সভ্য দুনিয়ায় প্রতিবাদের ভাষারও একটা ব্যাকরণ আছে। অসন্তুষ্টি প্রকাশেও রয়েছে নিয়মরীতি। সেগুলোকে অস্বীকার-অগ্রাহ্য করে দেশের সম্মান বাড়ে না।
 
ভারতের অন্যায়ের প্রতিবাদে দলীয় কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের বদলে দেশের সম্মান অক্ষুন্নকারী কর্মকাণ্ড প্রত্যাশা করি। হিজবুতেরা কি শুনবে ? শত হোক তাদের পালের গোদার সামনে ঝুলছে ফাঁসির দড়ি।
 
ইমেলঃ abid.rahman@ymail.com

বাংলাদেশ সময় ১১৪৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৬, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।