ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

তোমাকে ভুলবো না টিংকু ভাই

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬০৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৮, ২০১২
তোমাকে ভুলবো না টিংকু ভাই

এরশাদবিরোধী আন্দোলনের অকুতোভয় ছাত্রনেতা জাহাঙ্গীর সাত্তার টিঙ্কু আর নেই। বুধবার তার এক শুভাকাঙ্ক্ষী খবরটি দিলে স্মৃতির সবটা আচ্ছন্ন হয়।

সৃষ্টি করে অশ্রুবিন্দুর। প্রয়াত নেতা আব্দুর রাজ্জাকের কথা আরও বেশি মনে পড়ে।

আব্দুর রাজ্জাকের মৃত্যুর পর তোফায়েল আহমদ বলেছেন, ‘তিনি আমার নেতা’। জাহাঙ্গীর সাত্তার টিঙ্কুদের নেতাও রাজ্জাক ভাই। আশি-নব্বুইয়ের দশকে যাদের তিনি নিজের হাতে গড়েছিলেন, ডা. টিংকু তাদের মধ্যে উজ্জ্বলতম। টিংকু ভাই গড়েছেন মোজাম্মেল বাবু, ইউসুফ হাসান, আনিসুল হক, তারিক সুজাত, নুরুল ফজল বুলবুল, ওহিদুজ্জামান চানসহ আরও অনেককে। নেতা আব্দুর রাজ্জাক অসুস্থ হবার পর বারবার টিংকু ভাইয়ের কথা মনে পড়েছে। টিংকু ভাই নিজেও তখন অসুস্থ। বারবার মনে হয়েছে টিংকু ভাই সুস্থ থাকলে তার নেতা আব্দুর রাজ্জাকের ট্রিটমেন্ট নিয়ে কাউকে ভাবতে দিতেন না। সব দায়িত্ব একা নিজের কাঁধে নিয়ে সমুদ্রঝড় সামাল দিতে পারতেন।

টিংকু ভাইয়ের মৃত্যুর পর মুখ খুলেছেন তার অনেক স্বজন-শুভাকাঙ্ক্ষী। আওয়ামী লীগের নেতৃ্ত্বের বিরুদ্ধে বলা শুরু করেছেন সব ক্ষোভ। নব্বুইয়ের গণঅভ্যুত্থান বিজয়ী এই ছাত্রনেতা এমন পরিত্যক্ত-নিঃসঙ্গ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলেন যখন তিনি আওয়ামী লীগের কোনো একটি জেলা কমিটির সদস্যও ছিলেন না। অসুস্থতার সময়ও তার পাশে দাঁড়ায়নি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ! মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলটি দিনে দিনে এমন একটি নির্লিপ্ত-নিষ্ঠুর অবয়ব নিয়েছে!

এরশাদবিরোধী আন্দোলন ছাত্র নেতৃ্ত্বের পাশাপাশি দেশের মিডিয়া, শিল্প-সাহিত্যের জগতেও নতুন একটি জেনারেশন সৃষ্টি করে। এরপর আর কোনো গণআন্দোলন হয়নি দেশে। গণআন্দোলনে পোড় খাওয়া জেনারেশনও আর হয়নি। সেই আন্দোলনের জেনারেশনের কোনো সদস্য তিনি সাংবাদিক হোন, বা ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মী, কবি-সাংস্কৃতিক কর্মী যাই হোক না কেন তার সঙ্গে টিঙ্কু ভাইয়ের জানাশোনা, খাতির ছিল না এমন খোঁজে বের করা কঠিন হবে। মোজাম্মেল বাবু, ইউসুফ হাসান, আনিসুল হক, তারিক সুজাতদের নিয়ে তার বিশেষ সৃষ্টিশীল গ্রুপটির কারণে তার সংগঠন জাতীয় ছাত্রলীগ, কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, জাতীয় কবিতা পরিষদসহ আন্দোলনের সংগঠনগুলোর প্রকাশনাসমূহ ছিল কাব্যিক-শিল্প নৈপুণ্যে ভাস্বর। এই গ্রুপের সদস্য রাউফুন বসুনিয়া স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শহীদ হন।

জাতীয় কবিতা পরিষদের মঞ্চে এরশাদকে উপলক্ষ করে ‘দেশ আজ বিশ্ব বেহায়ার খপ্পরে’ অমর ছবিটি আঁকতে আঁকতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন পটুয়া কামরুল হাসান। এরপর সবাই দেখলেন, কামরুল হাসানের আঁকা সেই শেষ ছবিটি নিয়ে পোস্টার ছড়িয়ে পড়ল সবখানে। ওই কাজটি কে করেছিল? টিঙ্কুবাহিনী। স্বৈরাচারী এরশাদ আদেশ দিয়েছে, পত্রিকায় রাজনৈতিক কোনো খবর ছাপতে হলে আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তখনকার যুগ্ম-সচিব(রাজনৈতিক) আব্দুল হামিদ চৌধুরীকে তা দেখিয়ে নিতে হবে (এরশাদের সে সব নষ্টামির সহযোগী ব্যারিস্টার মওদুদ এখন সারাদিন বড় বড় কথা বলেন, ছি!!)। প্রতিবাদে সাংবাদিকরা কাজ বন্ধ করে দেন। পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। রাজপথের প্রতিবাদী সাংবাদিকরা প্রকাশ করেন আন্দোলনের বুলেটিন পত্রিকা। এসবের নেপথ্যে সবচেয়ে সক্রিয় মানুষটি কে ছিলেন? তিনি জাহাঙ্গীর সাত্তার টিঙ্কু।

এরশাদের বিদায়ের পর ঢাকার সেগুনবাগিচা থেকে বেরোয় নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকদের পত্রিকা প্রিয়প্রজন্ম। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে তখন শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃ্ত্বে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। সে আন্দোলনের ভ্যানগার্ড হয়ে ওঠে প্রিয়প্রজন্ম। গোলাম আযমের বিচারে প্রতীকী গণআদালত বসানো হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। খালেদা জিয়ার সরকার সে গণআদালতে হামলা চালিয়ে পণ্ড করতে পারে সে আশংকায় নেওয়া হয় নানা প্রস্তুতি। গণআদালতের রায় নিয়ে টেলিগ্রাম সংখ্যা বের করার প্রস্তুতি নেয় প্রিয় প্রজন্ম। আগের রাতে টিঙ্কু ভাই প্রিয় প্রজন্ম অফিসে আসেন। সিদ্ধান্ত হয়, রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে এর একটি কম্পোজকৃত কপি ডিস্কে নিয়ে আসবেন টিংকু ভাই। পরবর্তী সব কাজ হবে ঝড়ের গতিতে। তাই হয়। গণআদালত শেষে আন্দোলনের নেতাকর্মী-সমর্থকরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে বেরুবার পথেই পেয়ে যান প্রিয়প্রজন্মের টেলিগ্রাম সংখ্যা। এমন কী ঢাকার দৈনিকগুলোর সাংবাদিকরাও অফিসে যাবার পথে প্রিয় প্রজন্মের টেলিগ্রাম সংখ্যা হাতে করে নিয়ে যান। এর সবই সম্ভব হয়েছে টিংকু ভাইয়ের ঐকান্তিক সহযোগিতার কারণে। তার সঙ্গে যিনি একবার কথা বলেছেন, তাকে কোনোদিন ভুলতে পারবেন না। নেতৃ্ত্বের সঙ্গে বিশষ সম্মোহনী গুণ ছিল জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকুর।

ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।