‘আমি পেছন ফিরে ঘরে ঢুকবো— এমন সময় দেখি কি দরজার পাশে বারান্দার দেয়ালে যীশুর জন্মক্ষণের একটি দৃশ্য—কুঁড়েঘরে মেরীর কোলে সদ্যজাত যীশুর একটি রেপ্লিকা মূর্তি। সেটি গুলিবিদ্ধ হয়ে ভেঙে গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে একাত্তর সালে সেই গুলিটি করেছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ‘একাত্তরের স্মৃতি’ লিখতে গিয়ে এভাবেই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন তার স্ত্রী বাসন্তী গুহঠাকুরতা।
ওই দিন জ্যোতির্ময় বেঁচে যান। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসার তৃতীয় দিনে তার মৃত্যু হয়।
একাত্তরের শহীদ এই বুদ্ধিজীবীর মরদেহ ফেরত পায়নি তার পরিবারের সদস্যরা। অনেক চেষ্টা করেও সে বিষয়ে কিছু তারা জানতেও পারেনি। এমনকি তিনি যে পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে নিহত হয়েছেন, সে বিষয়ে মৃত্যুসনদ বা ডেথ সার্টিফিকেট আজও পায়নি তার পরিবার।
পাকিস্তানি নির্মমতার শুরু
একাত্তরের ২৫ মার্চের রাত ১২টা কিংবা ১টা। জ্যোতির্ময় ছাড়া বাসার সবাই ঘুমিয়ে পড়েছেন। তিনি পরীক্ষার খাতা দেখছিলেন। এমন সময় চারপাশে গুলির শব্দে সবার ঘুম ভেঙে যায়। সেই শব্দ ধীরে ধীরে আরও কাছে চলে আসে। গুলি থেকে বাঁচতে মেয়ে স্কুলছাত্রী মেঘনা ও স্ত্রী বাসন্তীকে নিয়ে খাটের নিচে আশ্রয় নিলেন অধ্যাপক। বাসার কাজের মেয়ে স্বর্ণ ও গাড়িচালক তখনও সেই ঘরে আসেনি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকিস্তানি সেনারা ৩৪ নম্বর বিল্ডিংয়ের নিচে জড়ো হয়। প্রতিটি ফ্ল্যাটের দরজায় লাথি শুরু হলো। অধ্যাপকের গেটের দরজার শিকল ছিঁড়ে ফেলে তারা। তখন বাসন্তী গুহঠাকুরতা অধ্যাপককে বলেন, ‘তোমাকে গ্রেফতার করতে এসেছে, তৈরি হয়ে নাও। ’
অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা তৈরি হয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু পাকিস্তানি সেনারা তাকে নিয়ে যায়নি। হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করে ফেলে রেখে চলে যায়। পাকিস্তানি সেনারা চলে গেলে রক্তমাখা অধ্যাপককে টেনে ঘরে নিয়ে যান তার স্ত্রী, মেয়ে স্কুলছাত্রী মেঘনা ও বাড়ির কাজের মেয়ে স্বর্ণা। ২৭ মার্চ সকাল পর্যন্ত অধ্যাপক বাসায় পড়েছিলেন। কোনো চিকিৎসা করানোর সুযোগ হয়নি। চারিদিকে গোলাগুলি ও অগ্নিকাণ্ডের ভয়ে কেউ বের হয়নি।
‘একাত্তরের স্মৃতি’ গ্রন্থে বাসন্তী গুহঠাকুরতা লিখেছেন, ‘২৭ তারিখ সকাল সাড়ে আটটার দিকে দেখতে পেলাম শহীদ মিনারের ফুটপাথ দিয়ে একজন মহিলা টিফিন ক্যারিয়ার হাতে আমিজপুরের দিকে যাচ্ছে। তাকে হাততালি দিয়ে ইশারায় কাছে ডেকে আনলাম। বললাম, “আপনি হাসপাতালে একটু খবর দেন। ” সে বললো, “স্লিপ দেন। ” আমি দৌড়ে কাগজের টুকরায় লিখে দিলাম, “আধ্যাপক আহত, নিয়ে যান। ” মিনিট পনেরর মধ্যে চারজন স্ট্রেচার নিয়ে... আমি জ্যোতির্ময়ের জামাটা বদলে দিলাম, ওরা গেট দিয়ে চলে গেল। ’
মেঘনা ও স্বর্ণাকে নিয়ে বাসন্তী গুহঠাকুরতা চলে যান ঢাকা মেডিক্যালে। অধ্যাপক জ্যোতির্ময়কে জরুরি বিভাগ থেকে সেদিন দুপুরে নেওয়া হয় সার্জারি বিভাগের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ২ নম্বর বেডে। সেখানকার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘বিকেল ৩টার দিকে একটি ছেলে দৌড়ে এসে জানালো, “জ্যোতির্ময় স্যারকে ৭ নম্বর রুমে এনেছে। ওনার অবস্থা খারাপ। ” আমি, স্বর্ণ ও মেয়ে দৌড়ে গেলাম। তখন তার বড় বড় শ্বাস পড়ছে। সে জল চাইলো, পাশের এক মহিলা আমার গ্লাসে জল দিলেন। ’
হাসপাতালে নেওয়ার দুই দিন পর থেকে জ্যোতির্ময়ের শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। এভাবে পাঁচ দিন গুরুতর অসুস্থ থেকে ৩০ মার্চ সকালে তিনি মারা যান। কিন্তু সেই মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। মরদেহ না পেয়ে ডা. টি হোসেনকে অধ্যাপকের স্ত্রী বাসন্তী বলেন, “আচ্ছা! কেন লাশটা আমাদের দিলো না, কেনই বা এখনো পোস্টমর্টেম করেনি। ” তখন ডাক্তার তাদের বলেন, “দিতে পারলে তো আমাকেই দিতো। আমি কি কম চেষ্টা করেছি। ”
বাসন্তী লিখেছেন, ‘একাত্তরের ৩০শে মার্চ থেকে যাযাবরের পথ বেছে নিলাম। গোলাপ (গাড়িচালক) বললো, চারদিন লাশ মেডিক্যালের বারান্দায় ছিলো। তারপর আর আমাদের সাহস ছিলো না মর্গে গিয়ে খোঁজ নেবার। তখন তো হিন্দুরা শ্মশানে যেতেই পারতো না। তবুও বিজয়ের পরে বন্ধু ডাক্তার শহিদুল্লাহকে নিয়ে একদিন মর্গে গিয়েছিলাম। জিজ্ঞেস করামাত্র ওরা বলেছিলো, “ওঃ অধ্যাপক? হিন্দু? আমরা তাকে লালবাগের শ্মশানে পোড়াই দিছি”। ’
মৃত্যুসনদ নিয়ে আরেক যুদ্ধ
বাসন্তী গুহঠাকুরতা স্মতিগ্রন্থে লেখেন, ‘৩০শে মার্চ ডাক্তার ওয়াহিদ যখন ঢাকা মেডিক্যালে দেখে এলেন ডাক্তাররা জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার ডেথ সার্টিফিকেট সই দিচ্ছে না, তখন আমাকে বলে এলেন, “আমি শ্মশান ঘাটে খোঁজ নেব”। ’
‘রাতেরবেলায় সেই পোস্তগোলার শ্মশানের ছবিটা চোখে ভেসে উঠলো। ডাক্তার সাহেব ২৯শে এপ্রিল তাঁর জামাইয়ের লাশ খুঁজতে খুঁজতে পাগলা ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। সে কী করুণ, বীভৎস দৃশ্য। শ্মশানে কেন ওরা ক্যাম্প করলো। হিন্দুরা মরলে পরে কি পোড়াতে আসবে না? আর যারা পোড়াতে আসবে তাদের কি ওরা মেরে ফেলবে? ডাক্তার ওয়াহিদ আমার খুড়তুতো ভাইকে তাই বলে দিলেন, “তুমি শ্মশানমুখী হবে না। যাও! গ্রামে চলে যাও”। ’
মৃত্যু-পরবর্তী আর্থিক সুবিধা পেতে অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার মৃত্যুসনদ প্রয়োজন হয়। কিন্তু সেই সনদ দেয়নি ঢাকা মেডিক্যাল। শুধু তাই নয়, অধ্যাপকের মরদেহও পাওয়া যায়নি। তাই অধ্যাপকের মৃত্যুর বিষয়ে কোনো প্রমাণ পরিবারের হাতে নেই। এভাবে চলল কয়েক মাস।
ওদিকে ইনস্যুরেন্স কোম্পানি বাসন্তী গুহঠাকুরতাকে জানায়, অধ্যাপকের ইন্সুরেন্সের টাকা পেতে হলে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাড়পত্রে হবে না, তার মৃত্যু নিশ্চিত করতে একজন চিকিৎসকের উপস্থিতিতে আরেকজন চিকিৎসককে একটি ফরম পূরণ করতে হবে।
এমন পরিস্থিতিতে জ্যোতির্ময়ের মৃত্যুসনদ উদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে যান বাসন্তী গুহঠাকুরতা। আনুষ্ঠানিক মৃত্যুসনদ তারা পাননি। তবে বীমার ফরমে জ্যোতির্ময়ের মৃত্যুসংক্রান্ত স্বাক্ষর করতে রাজি হয়েছিলেন ঢাকা মেডিক্যালের সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক আলী আশরাফ এবং ক্লিনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ডা. এম এ আবদুল মজিদ। সেই সনদকে ‘মিথ্যা ডেথ সার্টিফিকেট’ বলে উল্লেখ করেছেন বাসন্তী।
জ্যোতির্ময়ের মৃত্যুবিষয়ক ফরমে মৃত্যুর কারণ হিসেবে লেখা হয়েছিল, ‘স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি’। তবে মৃত্যুর কারণে ‘বুলেট ইনজুরি’ কথাটির উল্লেখ না করায় পাকিস্তানি নৃশংসতার উল্লেখ মেলে না।
তবুও সেই ফরমের কারণেই ২৯ অক্টোবর জীবনবীমার চেক হাতে পান বাসন্তী গুহঠাকুরতা। বাসন্তী লিখেছেন, ‘খুশি মনে বোর্ডে গিয়ে বসে থেকে স্কুলের রেজাল্টশিট দিয়ে আমি ইনকাম ট্যাক্স অফিসে গিয়ে আমার নিজের Income Tax ও Finance Tax দিলাম। জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার Tax-এর সঙ্গে একটি চিঠি দিয়ে তার Income Tax Account বন্ধ করে দিতে হবে। তার জন্যে একটি চিঠি ও Death Certificate দিতে হবে। তার কাজটা অসম্পূর্ণ রইলো, আগামীকাল শেষ করতে হবে। ’
মৃত্যু সনদ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘ঢাকা মেডিক্যালের সেই মিথ্যা Death Certificate-এর ফটোকপি দিয়ে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যাশনাল ব্যাংকের ২০৭ নম্বর অ্যাকাউন্টের চেক লিখে দিলাম। ভাগ্যিস আমাদের Joint Account ছিলো। ৩১শে অক্টোবর আমার স্বামীর হিসাব-নিকাশ চুকিয়ে দিলাম, এই পৃথিবীর লেনদেন তার মিটে গেলো। ’
লেখক: সিনিয়র নিউজরুম এডিটর, বাংলানিউজ
jhtomal.bd@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১৮১২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০২১
নিউজ ডেস্ক