ফৌজদারি মামলা দায়েরের পর তদন্ত শেষে প্রতিবেদন দাখিলের পর শুরু হয় বিচার। তবে, এই তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই পক্ষগুলো সংক্ষুব্ধ হয়।
তদন্ত প্রতিবেদন
ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭৩ ধারা অনুযায়ী পুলিশ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। তদন্ত প্রতিবেদন দুই ধরনের হয়ে থাকে। একটি চার্জশিট বা অভিযোগপত্র অন্যটি ফাইনাল রিপোর্ট বা চূড়ান্ত প্রতিবেদন। যখন আসামির নামে অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত মর্মে প্রতিবেদন দেওয়া হয় তাকে চার্জশিট বলা হয়। অপরদিকে প্রাথমিকভাবে অপরাধের প্রমাণ না মেলায় আসামিকে অব্যাহতির আবেদন করা হলে তাকে ফাইনাল রিপোর্ট বা চূড়ান্ত প্রতিবেদন বলা হয়।
একাধিক আসামি থাকলে কোনো আসামির বিরুদ্ধে অপরাধের প্রমাণ প্রাথমিকভাবে না পেলে তদন্ত কর্মকর্তা চার্জশিটেও এক বা একাধিক আসামির অব্যাহতি চাইতে পারেন। তদন্ত কর্মকর্তা প্রতিবেদনের সঙ্গে প্রাপ্ত দলিল বা দলিলের উদ্বৃতাংশ দাখিল করবেন। তবে, এমন দলিল বা দলিলের যে উদ্বৃতাংশ ইতোমধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠানো হয়েছে তা দিতে হবে না। এছাড়া প্রসিকিউশন বা রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী হিসেবে যাদের নাম তদন্ত কর্মকর্তা উপস্থাপন করেন ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬১ ধারায় তাদের দেওয়া বিবৃতি সঙ্গে দিতে হবে।
তদন্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি
ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় তদন্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে বাদীর আপত্তি গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। তদন্তে অসন্তুষ্ট হলে বাদীপক্ষ এই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে আপত্তি দাখিল করতে পারেন। তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের পর ম্যাজিস্ট্রেট/বিচারক এটা গ্রহণের পর চার্জগঠনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। তবে, প্রতিবেদন গ্রহণের দিন তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে কোনো আপত্তি আছে কিনা ম্যাজিস্ট্রেট/বিচারক তা জানতে চাইবেন। বাদীর আপত্তি থাকলে তিনি তা লিখিতভাবে দাখিল করবেন। এই লিখিত আপত্তিকেই ‘নারাজি’ বলা হয়। ফৌজদারি মামলায় নারাজি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
নারাজির গুরুত্ব
নারাজি এমনভাবে দাখিল করতে হয় যেন তা একটি নতুন আরজি এবং এর মাধ্যমে একটি কমপ্লেইন্ট রেজিস্ট্রার (সিআর) কেইস বা নালিশী মামলার উদ্ভব হয়। মামলার বিবরণ, তদন্ত প্রতিবেদন এবং প্রতিবেদন কেন যথাযথ ও নিরপেক্ষ হয়নি উহার বিবরণসহ নারাজি দাখিল করতে হয়। ম্যাজিস্ট্রেট/বিচারক নারাজির দরখাস্ত পাওয়া বাদী এবং প্রয়োজন মনে করলে উপস্থিত সাক্ষীদেরকে ফৌজদারি কার্যবিধির ২০০ ধারায় জবানবন্দি গ্রহণ করবেন। নারাজি মঞ্জুর হলে তিনি এমনভাবে আদেশ দেবেন যেন একটি নালিশী মামলার উদ্ভব হয়েছে। এক্ষেত্রে তিনি ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯০ (আই) (এ) ধারা মোতাবেক তিনি দরখাস্ত গ্রহণ করে আসামির বিরুদ্ধে সমন বা গ্রেফতারি পরোয়ানা ইস্যু করতে পারেন। অথবা তিনি নিজে বা তার অধস্তন কোনো বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটকে অভিযোগ তদন্তের আদেশ দিতে পারেন। অথবা সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তা বা তার পরিবর্তে অন্য কোনো কর্মকর্তা বা অন্য কোনো তদন্ত সংস্থাকে অধিকতর তদন্তের আদেশ দিতে পারেন। বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় নারাজি মঞ্জুর হলে সাধারণত অধিকতর তদন্তের জন্য অন্য কোনো সংস্থার কাছে পাঠানো হয়।
বিচারক কী নারাজি গ্রহণে বাধ্য হবেন?
নারাজি গ্রহণ করা বিচারকের জন্য বাধ্যকর নয়। ম্যাজিস্ট্রেট/বিচারক যদি মনে করেন, নারাজি গ্রহণ করার মতো যথেষ্ট পরিমাণ কারণ নেই; তবে তিনি নারাজি নামঞ্জুর করে আদেশ দিতে পারেন। নারাজি নামঞ্জুর হলে উহার বিরুদ্ধে দায়রা আদালত বা ক্ষেত্র বিশেষে হাইকোর্ট বিভাগে রিভিশন দায়ের করা যায়। আর যদি নারাজি আমলে না নিয়ে আসামিকে অব্যাহতি দেন,তবে পুনরায় নালিশী মামলা রুজু বা থানায় এজাহার দায়ের করতে পারেন।
আসামি কী নারাজি দিতে পারেন?
তদন্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে আসামি নারাজি দিতে পারেন কিনা-প্রায়ই তেমন প্রশ্নে ধোঁয়াশা দেখা দেয়। তবে এরূপ সংশয়ের কোনো কারণ নেই। আসামিপক্ষ কখনো নারাজি দিতে পারেন না। এটা একমাত্র বাদীর এখতিয়ার। এমনকি ফাইনাল রিপোর্টের ভিত্তিতে অপরাধ আমলে নেওয়া হলেও আসামি নারাজি দিতে পারেন না। তবে আসামি চার্জগঠনের সময় অব্যাহতির (ডিসচার্জ) আবেদন করতে পারবেন।
লেখক: আইনজীবী এবং বাংলানিউজের আইন ও আদালত প্রতিবেদক।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৫০ ঘণ্টা, মার্চ ২৭, ২০২২
এএটি